Ajker Patrika

শ্রদ্ধাঞ্জলি

মাটি ও মানুষের শিল্পী সুলতান

আবদুল্লাহ আল মোহন
১০ আগস্ট ১৯২৩-১০ অক্টোবর ১৯৯৪
১০ আগস্ট ১৯২৩-১০ অক্টোবর ১৯৯৪

শিল্পী এস এম সুলতান জীবনের মূল সুর-ছন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন বাংলার গ্রামীণ জীবন, কৃষক এবং কৃষিকাজের মধ্যে। ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে এসে খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে জন্মস্থান চিত্রার পাড়ে নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামেই থিতু হয়ে আজীবন শিল্পসাধনা করে গেছেন। গ্রামের শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছিলেন শিল্পশিক্ষার স্কুল। গ্রামের কৃষিজীবী মানুষ এবং তাদের জীবনসংগ্রামকে শিল্পচর্চার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যাঁরা জমি চাষ করেন, ফসল উৎপাদন করে সবার আহারের সংস্থান করেন; সেই মানুষেরাই সুলতানের রেখা-ভাবনায় উঠে আসে সমাজের চালিকাশক্তি হিসেবে। মাটিসংলগ্ন মানুষের ভেতরের অমিত শক্তিকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন পেশিবহুল শরীরী অবয়বে। এই শক্তিমত্তার প্রকাশ কেবল কৃষিজীবী মানব-মানবীতেই সীমিত নয়, বরং তা সম্প্রসারিত হয়েছে তাদের জীবনযাত্রার সহায় ও সহযোগী প্রাণ ও প্রকৃতিতেও। তাঁর আঁকা গবাদিপশু-পাখিও বলবান। চর দখলের জন্য দুই পক্ষের যে যুদ্ধের দৃশ্য তিনি এঁকেছেন, সেখানেও মাঠ ফসলে ভর্তি, নদী প্রবহমান। সুলতানের ছবিতে কোথাও ক্ষয়িষ্ণুতা, দুর্বলতা, ভঙ্গুরতার প্রকাশ নেই। আছে সব প্রতিকূলতা জয় করে জীবনের বিকাশ অব্যাহত রাখতে এক বিপুল প্রাণশক্তির অনন্য উন্মেষ। তেলরং, রেখাচিত্র, জলরং, চারকোল, কালিকলমে সৃজিত তাঁর শিল্পকর্ম যেকোনো শিল্পানুরাগীর দুঃসময় অতিক্রম করে জীবনযাত্রাকে নতুন করে এগিয়ে নেওয়ার সংগ্রামে মনের শক্তি বৃদ্ধি করে।

শিল্পী সুলতানের জন্ম ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট। শৈশবেই মাতৃহারা হন। রাজমিস্ত্রি পিতার সঙ্গে নির্মাণকাজের ভেতর দিয়েই তাঁর মনের ভেতরে শুরু হয়ে যায় বাংলার এক অনন্য শিল্পের নির্মাণ। নড়াইলের জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের সহযোগিতায় সুলতান ১৯৩৮ সালে কলকাতা আর্ট কলেজে গিয়েছিলেন শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। তখন ন্যূনতম যোগ্যতা মাধ্যমিকের সনদ ছিল না তাঁর। তবে শিল্প সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪১ সালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে। সেখানে তিনি ছিলেন মাত্র তিন বছর। আর্ট কলেজের নিয়মিত শিক্ষা-কার্যক্রমে থেকেও তিনি শিল্পী হওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানের নিয়মতান্ত্রিক লেখাপড়া আর সিলেবাসকে অপ্রয়োজনীয় ভাবলেন। তাঁর ভবঘুরে জীবনের শুরু এখান থেকেই। তিনি ভারত আর মানুষ দেখার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। অথচ সেই সময় সুলতানের একাডেমিক ফল খুব ভালো হচ্ছিল, তাঁকে নিয়ে শিক্ষকেরা আশাবাদী ছিলেন। একজন শিল্পী হওয়ার জন্য অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশই ছিল তাঁর। কিন্তু শিল্পী সুলতানকে এই সুযোগ-সুবিধা আর ভালো ফলের মোহ আটকে রাখতে পারেনি।

যাযাবর জীবনে দিল্লি, লক্ষ্ণৌ, সিমলা, দেরাদুন, মুসৌরি, কাশ্মীর ঘুরে বেড়িয়েছেন। নতুন মানুষ-বন্ধু তৈরি করেছেন। তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয়েছিল সিমলায় ১৯৪৬ সালে। জলরঙে আঁকা নিসর্গই প্রধান ছিল সে কাজগুলোতে। এ ছাড়া মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডও এঁকেছেন তিনি প্রকৃতির মধ্যে। পরে সুলতানের এই পর্যায়ের চিত্রকর্মের কোনো ডকুমেন্টেশন পাওয়া যায়নি। তখন কাশ্মীরে যুদ্ধের ডামাডোলে জীবন বাঁচানো নিয়ে সবার মধ্যে বিরাজ করছিল সংশয়। তাই সেই আঁকা ছবিগুলো হারিয়ে গিয়েছিল। কাশ্মীর থেকে লাহোরে এসে থিতু হয়েছিলেন সুলতান। ১৯৪৭ সালে সেখানে বেশ কিছু প্রদর্শনী করেছিলেন এবং করাচিতে আর্ট কলেজ নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিছুদিন শিক্ষকতাও করেন।

১৯৫০ সালে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিনিময় কর্মসূচির আওতায় তিনি পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে আমেরিকা ভ্রমণ করেন। পরে লন্ডন গিয়ে যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অন্য শিল্পীদের মধ্যে পাবলো পিকাসো, অঁরি মাতিস, সালভাদর দালি প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পীর শিল্পকর্ম ছিল। ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে ঢাকায় ফিরে আসেন ১৯৫৩ সালে। পরের বছর ফিরে যান নড়াইলে। এরপর দীর্ঘ সময় ছবি আঁকেননি বললেই চলে। তবে শিল্পের প্রসার এবং শিল্পবোধ ও রুচি নির্মাণে কাজ করে গেছেন। গ্রামে তিনি শিশুদের জন্য স্কুল করেছেন, পরে নন্দনকানন গ্রামে একটি ছবি আঁকার স্কুলও করেছেন। এরপর যশোরে একাডেমি অব ফাইন আর্টস তৈরি করেছেন। সুলতান ব্যক্তিগত উদ্যোগেই নিজ স্বপ্নের প্রসারে কাজ করেছেন জীবনের শেষ পর্যন্ত। শিল্পময়তার এ সাধনায় ব্যবসায়িক মনোভাব বা প্রাপ্তির ব্যাপার ছিল না। শিল্পের দুরন্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তৈরি করতে চেয়েছেন শিল্পের নিমিত্তে।

মাটি ও মানুষের শিল্পী সুলতান জীবনের পাশে থেকে প্রতিনিয়তই জীবনেরই প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠা সুলতান আমাদের কেবল ছবিই উপহার দেননি, দিয়েছেন জীবনবোধের আকর। পশ্চিমের শিল্প দ্বারা কখনো কখনো অনুপ্রাণিত হলেও তা দিয়ে নির্মাণ করেছেন সম্পূর্ণ নিজস্ব ভাষা, নিজ অঞ্চলের পরিপ্রেক্ষিতে। এখানেই তাঁর শিল্পীজীবনের সার্থকতা। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘ফোন বন্ধ পেলে ধরে নিবা মারা গেছি’, স্ত্রীকে বলেছিলেন ইউক্রেনে নিহত রাজবাড়ীর নজরুল

শাহবাগে গত রাতে ফুটপাত থেকে নারীসহ তিনজনের মরদেহ উদ্ধার

ফিলিস্তিনিদের বের করে দেওয়া হবে না, বরং উল্টোটা ঘটবে: ট্রাম্প

নার্সিং হোমে বয়স্ক পুরুষদের ওষুধ খেতে উৎসাহিত করতে মিনি স্কার্ট পরে তরুণীর নাচ

খতনা করা শিশুদের অটিজমের ঝুঁকি দ্বিগুণ, দাবি ট্রাম্পের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত