Ajker Patrika

কিশোর ত্বকী পড়ে থাকে লাশকাটা ঘরে!

মফিদুল হক
কিশোর ত্বকী পড়ে থাকে লাশকাটা ঘরে!

আট বছর আগের এক দিন লাশকাটা ঘরে শুয়েছিল ত্বকী। নবীন কিশোর, বয়স তার তখনো আঠারোয় পা রাখেনি। শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী খালে ৮ মার্চ পাওয়া গিয়েছিল তার মরদেহ। তারপর আইন ও বিচারধারা অনুসারে নিস্পন্দ ত্বকীকে নিয়ে যাওয়া হয় লাশকাটা ঘরে। উটের মতো গ্রীবা বাড়িয়ে কেউ দেখেনি লাশকাটা ঘরে কীভাবে শায়িত ছিল ত্বকী—তখনো কি তার দু্ই চোখ বিস্ফারিত ছিল মানুষের অতল নির্মমতা, পাশবিকতার পরিচয় পেয়ে। আমরা জানি না, জানার চেষ্টা করাও দুরূহ। শুধু জানতে পারি, ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারের রিপোর্ট। তিনি বলেছেন, শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে, তবে এর প্রয়োজন ছিল না।

ত্বকীর মাথায় তিন দিক থেকে আঘাত করা হয়েছিল। এই আঘাতই তার মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিল। এখানেই আমাদের থেমে যেতে হয়। আর কিছু জানা কঠিন হয়ে পড়ে, কিছু বুঝে ওঠা মুশকিল হয়ে যায়। যেমন আমরা বুঝি না শবব্যবচ্ছেদকে কেন বলা হয় ময়নাতদন্ত। ময়না পাখির এখানে কী ভূমিকা! তবে বাস্তব বড়ই নির্মম। একই সঙ্গে দলিত মানুষ বুঝি খোঁজে পাশবিকতা পেরিয়ে শীতল জলের আশ্রয়, ত্বকীর লাশ যেমন আশ্রয় পেয়েছিল নদীর জলে। এক সময় সবচেয়ে সুপেয় পানি হিসেবে যে শীতলক্ষ্যা নদীর সুনাম ছিল, এখন সেই জল রাসায়নিক দূষণে, উন্নয়নের মূল্য পরিশোধ করে হয়ে উঠেছে বিষাক্ত। এমনই বিষময়তার প্রকাশ ঘটিয়ে ঘাতকদের একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার সময় বলেছিল, গজারি কাঠের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ত্বকীকে অজ্ঞান করার পর বুকের ওপর বসে গলাটিপে তার শ্বাসরোধ করা হয়।
ডাক্তার বলেছিল, মাথার তিন দিকের আঘাতই মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট ছিল। ত্বকী তো বয়সের তুলনায় একটু বেশি ছিল সচেতন ও অনুভূতিপ্রবণ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ সে পড়েছিল, তেমনি পড়েছিল নিটশের রচনার অনুবাদ ‘জরথুস্ত্র বলছেন’। জীবনানন্দের কবিতা তখনো তার প্রিয় হয়ে উঠেছে কি না জানা নেই। তবে অন্তরে পরম বেদনার সুর সে নিশ্চয়ই বহন করত, নতুবা কেন সে ছিল এমন মৃদুভাষী, নম্রকণ্ঠ, কাউকে কষ্ট দিতে অপারগ, দেখছে চারপাশের জগৎ, শুষে নিতে চাইছে জীবনের মহিমা, খেরোখাতায় লিখছে কবিতা, স্কুলের রচনায় স্বপ্নের কথা, যে স্বপ্ন সমষ্টিমঙ্গলের। কে হত্যা করেছে ত্বকীকে? পুলিশ নিশ্চিতভাবে তাদের চেনে। র‍্যাবের তদন্তে আরও জানা গেছে, হত্যাকারীদের পেছনে কারা ছিল, কী কারণে তারা অপাপবিদ্ধ এই কিশোরকে এমনভাবে দুনিয়া থেকে চিরতরে উধাও করে দিতে চাইলো।

কাগজে-কলমে ত্বকী হত্যাকারীদের আমরা চিনি না। যদিও জানি, ৬ মার্চ বিকেলে সুধীজন পাঠাগারে যাবে বলে ঘর থেকে বের হয়েছিল এই কিশোর। বহু মানুষের বহু যত্নে বন্দর শহর নারায়ণগঞ্জে গড়ে উঠেছে এই পাঠাগার, সত্যিকার অর্থেই সুধীজনের দ্বারা নির্মিত। বন্দর ও গঞ্জ, দুই-ই জড়িত এই শহরের নামের সঙ্গে, যে দুইয়ের সঙ্গে আছে অর্থ, প্রতিপত্তি, তরক্কি ও ক্ষমতার যোগ। ত্বকী পৌঁছতে চেয়েছিল সুধীজন পাঠাগারে, অন্যদিকে আছেন অনেক প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি, ক্ষমতাধর পরিবারের সদস্য, আছে তাদের অনুসারী যুবাদল, গুরুর হাতের সামান্য ইশারায় যারা করে ফেলতে পারে অনেক দুঃসাধ্য কাজ। পাঠাগারে তারা প্রবেশ করতে পারে না, প্রবেশে আগ্রহী নয়; তবে পাঠাগারের পথের বালককে তুলে নিতে পারে দিবালোকে। হরণ করে যেখানে নিয়ে যেতে পারে, সেখানেও আছে এক কেন্দ্র, অন্যতর এক সমাবেশ, নামে ক্লাব, তবে চালচরিত্রে একেবারে আলাদা।

কে হত্যা করেছে ত্বকীকে, আমরা জানলেও অভিযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের নাম উচ্চারণ করা যাবে না। আইনের ছাতা মেলে হুংকার দেবে ক্ষমতাধর। সে হুংকারে যত তেজ ততই প্রকাশ পায় ভেতরের দুর্বলতা। অভিযুক্ত যদি কখনো কেউ হয়ে থাকেন, তাহলেও বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তিনি নির্দোষ হিসেবে গলা ফুলিয়ে বন্দর কাঁপাতে পারবেন। কিন্তু আড়ালে তো সত্য হাসে, আর সেই সত্য কতভাবেই না নিজেকে প্রকাশ করছে।

আট বছর আগের একদিন শীতলক্ষ্যার বুক থেকে তুলে লাশকাটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ত্বকীকে, সেই থেকে জীবনানন্দীয় বাস্তবতায়, উপলব্ধির নিবিড়তায় ত্বকীর কোনো বিনাশ নেই। হত্যাকারী এবং তাদের যারা পৃষ্ঠপোষক, তারা বুঝেছিলেন লোকস্মৃতি বড়ই চঞ্চল, বিস্মৃতিপ্রবণ, সময়ের প্রবাহ মুছে দেবে সব রক্তচিহ্ন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের জনমানসে ত্বকীর অবস্থান তো কিছুতেই মুছে যাওয়ার নয়। বছরান্তে শীতলক্ষ্যার জলে ত্বকী স্মরণে ভাসিয়ে দেওয়া হয় প্রদীপবাহী ছোট ভেলা, খোয়াজ-খিজিরের স্মরণে জীবনের সব দুঃখজয়ের প্রার্থনা নিয়ে যেমন জলপ্লাবিত বাংলার মানুষ ভাসানযাত্রার উৎসবে মিলিত হয়।

ত্বকীর স্মরণে প্রতিবছর আয়োজিত হয় শিশু চিত্রাঙ্কন অনুষ্ঠান। যে শিশুরা গোড়ায় যোগ দিয়েছিল তারা তখন তরুণ, ত্বকীর মতোই স্বপ্নভরা চোখে চলছে জীবনের পথে। ত্বকী স্মরণে যে গান গীত হয়েছে, পাঠ করা হয়েছে কবিতা, তুলে আনা হয়েছে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা, তা ভেসে বেড়ায় আকাশে-বাতাসে। সেই সুর, সেই স্পন্দন রোধ করে সাধ্য কার!

ত্বকী হত্যার পূর্বাপর বাস্তবতা দেখিয়ে দিচ্ছে ক্ষমতার জোরে কারা আইনের শাসন পথভ্রষ্ট করতে পারে, নিজেদের হীন স্বার্থসিদ্ধির জন্য কারা জাতির পিতার নামাবলি গায়ে দিতে পারে, শহীদের রক্তরঞ্জিত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বুলি আওড়ে যেতে পারেন হরহামেশা, নিজেদের কর্মকাণ্ড ও আচার-আচরণ আড়াল করতে জাতির সুকৃতি ও অর্জন ভাঙিয়ে চলতে পারেন তারা, সম্পদের বাজারে দাপটের সঙ্গে বেচাকেনা করতে পারেন, পারেন আইনকে তার চলার পথে থামিয়ে দিতে। তবে এতকিছুর পরও তারা শীতলক্ষ্যার জল থেকে ত্বকীকে তুলে আনতে পারেন না, খোয়াজ-খিজির ব্রতপালনে হিন্দু-মুসলমান নারী-পুরুষের ভাসানযাত্রার গান তো ফিরে ফিরে গীত হবে, প্রদীপ শিখা জলে ভাসবে, স্মৃতিতে দুলে উঠবে ত্বকী।

লাশকাটা ঘরে পড়ে থাকবে থেঁতলানো দেহ, ময়নাতদন্ত শেষ হলেও বিচার তো শেষ হয়নি, শেষ তো দূরের কথা, শুরুই হয়নি। শুরু হবে কী করে? চার্জশিটই তো দেওয়া হয়নি। আর তাই আট বছর আগের এক দিনের লাশকাটা ঘর যেমন জীবনানন্দ দাশের কবিতা হয়ে বাঙালি চিত্ত তাড়িত করে ফেরে, অবিরত তেমনি নবীন কিশোর ত্বকী পড়ে থাকে লাশকাটা ঘরে, মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকের গুলিবিদ্ধ মিছিলকারীদের মতো প্রত্যাখ্যান করে কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার নিয়তি।

আট বছর পেরিয়ে গেলেও ত্বকী হত্যার বিচারের দাবি হারিয়ে না গিয়ে বরং আরও শক্তিময়তা নিয়ে জেগে উঠছে। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে দৃঢ় হাতে রোধ করতে হবে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের দোহাই তুলে, কিংবা ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কের ঢাল হাতে নিয়ে আইনের পথচলা রুদ্ধ করা অথবা পথভ্রষ্ট করার প্রয়াস। এই প্রবণতা এক জায়গায় প্রশ্রয় পেলে দশ জায়গায় তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমরা সমাজে এমনই দুরাচারের বিস্তার লক্ষ করছি—রাজনীতির সঙ্গে দুর্বৃত্তের সংযোগ জন্ম দিচ্ছে বহু ধরনের অপরাধের। এর ফলে সদর্থক রাজনীতি হারিয়ে ফেলছে নৈতিক অবস্থান, ক্ষয়িত হচ্ছে মানুষের মনে তার অবস্থান। আজ বাংলাদেশকে অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আর ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সফলতা-বিফলতা নির্ধারণ করে দেবে আগামী দিনের রাজনীতির ভাগ্য। ত্বকী হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে সেটা আমাদের সবার জন্য হবে আস্থার পুনর্বাসন, ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা। এই বার্তার অপেক্ষায় কেটে গেছে আট বছর। আর বিলম্ব সমাজের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলকর হবে না। নিপাত যাক দুর্বৃত্তের জয় বাংলা, আকাশ-বাতাস কম্পিত হোক মানুষের জয় বাংলায়।

লেখক: ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত