Ajker Patrika

দারুণ ভয়!

আবেদীন কাদের
দারুণ ভয়!

আমার একটি ফেবু স্টেটাসের বিষয়ে আমার এক শ্রদ্ধেয় বন্ধু কিছুটা আহত হয়ে বলেছেন: আমাদের সবার ত্রুটি আছে, তাই সেসব ভুলে কীভাবে এগোতে পারব, সে বিষয়ে যেন চিন্তা করি। আমার এই বন্ধুর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে। তাঁর মনোবেদনার জন্য আমি ব্যথিত। আরেক বড়ভাই বলেছেন: মানুষকে একটি ঘটনা দিয়ে চরিত্র বিচার ঠিক নয়; আর যে সরকার এই নৈতিকতাহীন কবিকে সাহায্য করে রাষ্ট্রীয়ভাবে, তা টেনে আনা ঠিক নয়। জানি না, হয়তো তাঁরা ঠিক বলেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র যখন করদাতাদের টাকা অসৎ শিল্পীকে দান করে, তার মধ্যদিয়ে রাষ্ট্র জানিয়ে দেয় কাকে সে পুরস্কার দেয়! কিন্তু আমাদের স্খলনগুলো যদি আমরা না বলি—কে বলবে! সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, সমাজ কখনো কখনো ভীষণ চাবুকপেটানো দাবি করে। দারুণ বেদনার হলেও কাউকে না কাউকে চাবুকটা নিয়ে এগোতে হয়! আমি চাবুকধারী দাবি করব না নিজেকে। সে যোগ্যতা বা আত্মত্যাগ আমার নেই; কিন্তু আমার সেই বন্ধুর মতোই আমি বেদনাক্রান্ত! একজন অধ্যাপক আহমদ শরীফ বা একজন–দুজন বদরুদ্দীন উমর লড়ে লড়ে ক্লান্ত হয়ে নিঃশেষ হয়ে যান; কিন্তু সমাজে সামান্য আঁচড় রেখে যান। আর তেমন কিছু নয়! আমাদের সমাজ বিষে আক্রান্ত, আজ নতুন নয়।

একসময় সিআইএ অঢেল টাকা ঢালত জগৎজুড়ে বুদ্ধিজীবীদের কিনতে। তা বুদ্ধিজীবীরা জানতেন না তা নয়, তবুও তাঁরা জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হতেন। কিন্তু তাঁদের সমসাময়িক আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর বা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘মোহের কাছে পরাজিত’ হননি। সে সময় সৈয়দ আলী আহসানের নেতৃত্বে পিইএন সিআইএ-র টাকায় এসব কাজই করত। ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনের মাধ্যমে বই অনুবাদ করাত বিপুল টাকার বিনিময়ে। আমার বন্ধু একটি কথা বলেননি, বিএনআর (ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন) সিআইএ-র টাকায় আরও অনেক কিছু করেছে। সে সময়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ লেখক-বুদ্ধিজীবীর বই ছাপিয়ে, বিদেশি বই অনুবাদ করিয়ে বিপুল টাকা বিলাতো। আমাদের অধিকাংশ লেখক বুদ্ধিজীবী টাকার উৎস জেনেও নিজের মনকে চোখ ঠারতো সেসব দিনে। সবচেয়ে বড় খবর ছিল, বিলেতে স্পেনডার সম্পাদিত ‘এনকাউন্টার’ পত্রিকা যে সিআইএ-র টাকায় প্রকাশিত হতো তা সম্পাদক জানতেন না। জানার পর তিনি সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ভারতে দুজন বড় অধ্যাপক বুদ্ধিজীবী অম্লান দত্ত এবং আবু সয়ীদ আইয়ুব বোম্বে থেকে প্রকাশিত ইংরেজি ‘কোয়েস্ট’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তাঁরা জানতেন না পত্রিকাটি ছাপার টাকা আসে সিআইএ থেকে। জানার পর দুজনেই পদত্যাগ করেন! মানুষ তাঁদের কথা বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু আজকের আমাদের সমাজের বুদ্ধিজীবীরা জানেন তাঁদের জন্য রাষ্ট্রের কোন জায়গা থেকে অর্থ আসে, কেন আসে! কিন্তু তাঁদের কোনো বিকার নেই। এটাই ভীষণ শঙ্কার কথা।

অনেকদিন আগে, প্রায় সাতচল্লিশ বছর আগে, গভীর রাতে তিন বন্ধু মিলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হলের একটি কামরায় বসে আড্ডা দিচ্ছি আর আমি একটি বই নাড়াচাড়া করছি। বইটি ধার এনেছিলেন আমার সহপাঠী ফারুক মেহেদী আমাদের একজন অধ্যাপিকার কাছ থেকে। আমি কোনোদিন সেই অধ্যাপিকার ক্লাসে বসিনি, যেহেতু আমি ক্লাসে তেমন যেতাম না। বইয়ের মধ্যে প্রায় দুই দশক আগের একটি রসিদ দেখি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের একটি বুক স্টোরের। পঞ্চাশের শেষদিকে আমাদের এক বুদ্ধিজীবী ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন মার্কিন বৃত্তিতে। বইটি সেখানেই কেনা। তার মাত্র ১০ বছর আগে এই অধ্যাপক জেলে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি করার কারণে। যিনি বলেছিলেন, ‘আমি জীবনের মোহের কাছে পরাজিত।’ আমাদের অধ্যাপিকা তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী। আসলে আমাদের সমাজ বেশি বদলায়নি, গত পঞ্চাশ বা সত্তর বছরে বা তার বেশি সময়ে। আর বুদ্ধিজীবীরা তো বদলাননি একেবারেই। কিন্তু আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্র নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সে বিষয়টাই কেউ বলছেন না। একজন মোরশেদ শফিউল হাসান বা আরও দু-চারজন বিবেকসম্পন্ন মানুষ ছাড়া! তা–ও ভয়ে ভয়ে আকার–ইঙ্গিতে, রূপকের সাহায্যে। কিন্তু ‘শক্তির’ বিরুদ্ধে কোদালকে কোদালই বলতে হয়, যদি ‘সেই শক্তি’ একসময় স্বাধীনতার দিশারিও হয়ে থাকে! একসময় সেই শক্তিও বিষাক্ত হতে পারে সমাজের জন্য! অন্তত গত সংসদ নির্বাচন তাই প্রমাণ করেনি কি! আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ভেবে দেখতে পারেন, আমরা কী ধরনের সমাজে বেঁচে আছি! কেনই–বা বেঁচে আছি নির্বিকার!

লেখক: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত