বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্তির পরও কর্মহীন থাকলে তা তরুণদের মধ্যে একটা হতাশার সৃষ্টি করে। সে কর্মহীনতার সময়কাল দীর্ঘায়িত হলে তা উপর্যুক্ত হতাশাকে আরও গভীর করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সে হতাশার আর্থিক ও মানসিক মাত্রিকতা রয়েছে; কিন্তু সামষ্টিক পর্যায়ে সে হতাশার সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রিকতা রয়েছে। তারুণ্যের হতাশা শুধু নেতিবাচক নয়; কাঙ্ক্ষিতও নয় মোটে।
সেলিম জাহান
সংবাদটি অনেকটা নীরবেই এসেছে সংবাদপত্রে—দৃষ্টিও কাড়েনি তা বড় একটা। হয়তো সেটি তেমন কোনো উত্তেজক বিষয় নয় বলে; কিংবা তা সরব কোনো সংকট না হওয়ার কারণে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে, সংবাদটি একটি অশনিসংকেত বয়ে আনে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সনদপ্রাপ্ত প্রায় ৯ লাখ তরুণ কর্মহীন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণের সংখ্যা ছিল ২ লাখ। সুতরাং গত ১২ বছরে সংখ্যাটি চার গুণের বেশি বেড়েছে। দেশে কর্মহীন লোকের সংখ্যা যদি ২৭ লাখ হয়, তাহলে তার এক-তৃতীয়াংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত। এ চিত্রটি স্বাভাবিকভাবেই কতগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেমন দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা যদি তরুণদের কর্মনিয়োজন নিশ্চিত না করতে পারে, তাহলে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কি ব্যর্থ, সেটা কি তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে? এই বিপুল কর্মহীন তারুণ্য কি সম্পদের, সুযোগের অপচয় নয়? কিংবা এমন একটি চালচিত্র নিয়ে বাংলাদেশ কি করে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে প্রতিযোগিতা করবে?
এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য তারুণ্যের কর্মহীনতার সামষ্টিক এ চিত্রটিকে একটু বিভাজিতভাবে দেখা যাক। এক. উপাত্ত বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৬ লাখ, নারীদের সংখ্যা ৩ লাখ। এর দুটো কারণ থাকতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পেয়েও মেয়েরা কম সংখ্যায় শ্রমবাজারে আসে। ফলে তাঁরা যে কর্মহীনতায় কম সংখ্যক, সেটা সেই বাস্তবতার প্রতিফলন হতে পারে। কিংবা সত্যি সত্যিই কমসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণী কর্মহীন। দুই. নানা স্তরের শিক্ষাপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত তরুণদের হার সবচেয়ে বেশি। মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার যেখানে ৩ শতাংশ, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে সে হার হচ্ছে ১৪ শতাংশ—চার গুণের বেশি। তিন. বাংলাদেশে প্রায় ৮৬ লাখ তরুণ শিক্ষায়, কাজে বা প্রশিক্ষণে রত নয়—এর মধ্যে ২৮ লাখ পুরুষ এবং ৫৮ লাখ নারী।
এ প্রেক্ষাপটকে পেছনে রেখে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোকে বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার পরিশীলিত সূক্ষ্ম উদ্দেশ্যগুলোকে আপাতত পাশে রেখে যদি ধরে নেই, বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্তির একটি অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে একটি ভালো কর্মে নিয়োজন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ৯ লাখ তরুণের জন্য সে লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, যাঁদের কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, যাঁদের প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা আছে, তাঁরা কর্মে নিয়োজিত হচ্ছেন; কিন্তু উচ্চশিক্ষিতরা কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেকে এটাকে একটা ধাঁধা বলে অভিহিত করেছেন, আবার অনেকে কাজের ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার প্রাসঙ্গিকতার বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, প্রাথমিক শিক্ষা বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত শ্রমিকেরা যে কর্মবাজারে কাজ করেন, সেখানে দক্ষতা-চাহিদা সাধারণ, যা দিয়ে সাধারণ কাজ সম্পন্ন করা যায়। সে বাজারে উচ্চমানের বিশেষায়িত দক্ষতার প্রয়োজন নেই। সুতরাং সে বাজারে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষেরাও কাজ খুঁজে পান। সেখানে শ্রমবাজারের দক্ষতা চাহিদার সঙ্গে শ্রমবাজারের জোগানের দক্ষতার একটা সম্পৃক্ততা আছে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত জনসম্পদের যে শ্রমবাজার, সেখানে কর্মনিয়োজনের জন্য যে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রত্যাশিত, তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণেরা যে জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে বেরিয়ে আসেন, তার মধ্যে যথেষ্ট ফারাক থাকে। আমাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মাধ্যক্ষেরা প্রায়ই অভিযোগ করেন, তাঁদের যে ধরনের পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন, দেশের উচ্চশিক্ষা খাত তা সরবরাহ করতে পারে না। ফলে আমাদের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের কর্মনিয়োজন বিঘ্নিত হয়।
সে সঙ্গে কোন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সনদ পাওয়া গেছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সনদপ্রাপ্ত স্নাতকদের ২৩ শতাংশই বেকার অথচ ইংরেজিতে স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ০.১৭ শতাংশ। মনে রাখা দরকার, বর্তমান বিশ্বের কর্মজগৎ, কর্মবিষয় ও কর্মধারা দ্রুত বদলাচ্ছে। এর একটি কারণ অবশ্যই তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব, কিন্তু এর অন্যতম কারণ হচ্ছে উৎপাদন ও সেবা খাতের কাঠামোগত পরিবর্তন। ফলে নতুন নতুন পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাকাঠামো সে জ্ঞান ও দক্ষতা সৃষ্টি করতে পারছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে এবং সেই সঙ্গে কর্মনিয়োজনের ক্ষেত্রে বর্তমান উচ্চশিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে।
উচ্চশিক্ষা এবং কর্মনিয়োজনের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতার অন্যান্য মাত্রিকতা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে ৩ লাখ স্নাতককে কর্মনিয়োজনে আত্মস্থ করতে পারে। অথচ বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাকাঠামো শুধু ২০২২ সালেই প্রায় ৭ লাখ স্নাতকের জন্ম দিয়েছে। জোগান যেখানে চাহিদার দ্বিগুণের চেয়ে বেশি, সেখানে উচ্চ কর্মহীনতা ঘটতে বাধ্য। এই বিশাল জোগানের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অভাবনীয় বিস্তার।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৫৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তিন বছর আগে যেটা ছিল ৫৩। গত তিন বছরে আরও ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে বর্তমানে আমাদের দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৬টি। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় অংশই সনদ প্রদান করে; কিন্তু প্রার্থিত দক্ষতা সৃষ্টি করে না। যেমন বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২০২২ সালে দেশের ৭ লাখ স্নাতকের ৬১ শতাংশের জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে কর্মবিহীন স্নাতকদের ১৬ শতাংশ ওই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্নাতক।
বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের উচ্চ কর্মহীনতার একটি সামষ্টিক পরিপ্রেক্ষিতও রয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে; কিন্তু তা কর্মনিয়োজন সৃষ্টি করেনি। সরকারি মনোযোগের পুরোটাই ছিল প্রবৃদ্ধির দিকে, কর্মসৃষ্টির দিকে নয়। বর্তমান সময়ে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে গেছে, কমে গেছে কর্মনিয়োজনের সুযোগ। বাংলাদেশের খাতগুলোতেও জাতীয় আয় ও কর্মনিয়োজনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। দেশের কৃষি খাত জাতীয় আয়ের মাত্র ১১ শতাংশ অবদান রাখে; কিন্তু ৪৫ শতাংশ মানুষকে কর্মনিয়োজিত করে, তবে সেখানে ছদ্ম বেকারত্ব এবং অপরিপূর্ণ কর্মনিয়োজন রয়েছে। শিল্প খাত জাতীয় আয়ে ৩৭ শতাংশ অবদান রাখে; কিন্তু কর্মনিয়োজনে তার ভাগ মাত্র ১৭ শতাংশ। যদিও সেবা খাত জাতীয় আয়ে ৫১ শতাংশ অবদান রাখে, কর্মনিয়োজনে তার অংশ ৩৮ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের আরও একটি কারণ রয়েছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাঁদের কর্মনিয়োজনের ক্ষেত্রে অত বেশি যাচাই-বাছাই করেন না। যা লভ্য, সেটাই তাঁরা নিয়ে নেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণেরা কর্মগ্রহণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নানা বিষয় বিবেচনা করেন, যার মধ্যে কাজসংশ্লিষ্ট সামাজিক মর্যাদাও রয়েছে। সব রকমের লভ্য কাজকে তাঁরা বিবেচ্য মনে করেন না। এবং তাঁদের যাচাই-বাছাইও বেশ কঠিন। ফলে তাঁদের কর্মগ্রহণ সিদ্ধান্ত অত বেশি নমনীয় হয় না।
এই বিস্তৃত চালচিত্রের দুটো মাত্রিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্তির পরও কর্মহীন থাকলে তা তরুণদের মধ্যে একটা হতাশার সৃষ্টি করে। সে কর্মহীনতার সময়কাল দীর্ঘায়িত হলে তা উপর্যুক্ত হতাশাকে আরও গভীর করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সে হতাশার আর্থিক ও মানসিক মাত্রিকতা রয়েছে; কিন্তু সামষ্টিক পর্যায়ে সে হতাশার সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রিকতা রয়েছে। তারুণ্যের হতাশা শুধু নেতিবাচক নয়; কাঙ্ক্ষিতও নয় মোটে।
সেই সঙ্গে যে দেশে ৯ লাখ উচ্চশিক্ষিত তরুণ কর্মহীন ও যেখানে ৮৬ লাখ তরুণ শিক্ষা, কর্মনিয়োজন ও প্রশিক্ষণের বাইরে আছে, সেটা সম্পদের একটি বিরাট অপচয়। অথচ অর্থনৈতিক গতিময়তা এবং সমাজ পরিবর্তনে তারুণ্য একটি বড় সম্পদ। তরুণদের প্রাণশক্তি, ঝুঁকি নেওয়ার সক্ষমতা, সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতা, সাহস ও মনোবল অপ্রথাগত চিন্তা করার ক্ষমতার সুচারু ব্যবহার না হলে সেটা দুর্লভ এক সম্পদের অভাবনীয় অপচয়।
বিশ্ব বদলাচ্ছে দ্রুত। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের তরুণদের প্রতিযোগিতা করতে হবে একটি গতিময় বিশ্বের মধ্যে। সে জন্য তারুণ্যের শক্তির অপচয় রোধ করে, তাঁদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, তাঁদের কাজে লাগিয়ে আমাদের দ্রুত প্রস্তুত হতে হবে। কারণ, হাতে আমাদের সময় খুব একটা বেশি নেই।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
সংবাদটি অনেকটা নীরবেই এসেছে সংবাদপত্রে—দৃষ্টিও কাড়েনি তা বড় একটা। হয়তো সেটি তেমন কোনো উত্তেজক বিষয় নয় বলে; কিংবা তা সরব কোনো সংকট না হওয়ার কারণে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে, সংবাদটি একটি অশনিসংকেত বয়ে আনে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সনদপ্রাপ্ত প্রায় ৯ লাখ তরুণ কর্মহীন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণের সংখ্যা ছিল ২ লাখ। সুতরাং গত ১২ বছরে সংখ্যাটি চার গুণের বেশি বেড়েছে। দেশে কর্মহীন লোকের সংখ্যা যদি ২৭ লাখ হয়, তাহলে তার এক-তৃতীয়াংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত। এ চিত্রটি স্বাভাবিকভাবেই কতগুলো প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেমন দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা যদি তরুণদের কর্মনিয়োজন নিশ্চিত না করতে পারে, তাহলে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কি ব্যর্থ, সেটা কি তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে? এই বিপুল কর্মহীন তারুণ্য কি সম্পদের, সুযোগের অপচয় নয়? কিংবা এমন একটি চালচিত্র নিয়ে বাংলাদেশ কি করে একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে প্রতিযোগিতা করবে?
এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য তারুণ্যের কর্মহীনতার সামষ্টিক এ চিত্রটিকে একটু বিভাজিতভাবে দেখা যাক। এক. উপাত্ত বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৬ লাখ, নারীদের সংখ্যা ৩ লাখ। এর দুটো কারণ থাকতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পেয়েও মেয়েরা কম সংখ্যায় শ্রমবাজারে আসে। ফলে তাঁরা যে কর্মহীনতায় কম সংখ্যক, সেটা সেই বাস্তবতার প্রতিফলন হতে পারে। কিংবা সত্যি সত্যিই কমসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণী কর্মহীন। দুই. নানা স্তরের শিক্ষাপ্রাপ্ত কর্মহীন তরুণদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত তরুণদের হার সবচেয়ে বেশি। মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার যেখানে ৩ শতাংশ, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে সে হার হচ্ছে ১৪ শতাংশ—চার গুণের বেশি। তিন. বাংলাদেশে প্রায় ৮৬ লাখ তরুণ শিক্ষায়, কাজে বা প্রশিক্ষণে রত নয়—এর মধ্যে ২৮ লাখ পুরুষ এবং ৫৮ লাখ নারী।
এ প্রেক্ষাপটকে পেছনে রেখে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোকে বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার পরিশীলিত সূক্ষ্ম উদ্দেশ্যগুলোকে আপাতত পাশে রেখে যদি ধরে নেই, বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্তির একটি অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে একটি ভালো কর্মে নিয়োজন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ৯ লাখ তরুণের জন্য সে লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, যাঁদের কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, যাঁদের প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা আছে, তাঁরা কর্মে নিয়োজিত হচ্ছেন; কিন্তু উচ্চশিক্ষিতরা কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেকে এটাকে একটা ধাঁধা বলে অভিহিত করেছেন, আবার অনেকে কাজের ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার প্রাসঙ্গিকতার বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, প্রাথমিক শিক্ষা বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত শ্রমিকেরা যে কর্মবাজারে কাজ করেন, সেখানে দক্ষতা-চাহিদা সাধারণ, যা দিয়ে সাধারণ কাজ সম্পন্ন করা যায়। সে বাজারে উচ্চমানের বিশেষায়িত দক্ষতার প্রয়োজন নেই। সুতরাং সে বাজারে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত মানুষেরাও কাজ খুঁজে পান। সেখানে শ্রমবাজারের দক্ষতা চাহিদার সঙ্গে শ্রমবাজারের জোগানের দক্ষতার একটা সম্পৃক্ততা আছে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত জনসম্পদের যে শ্রমবাজার, সেখানে কর্মনিয়োজনের জন্য যে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রত্যাশিত, তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণেরা যে জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে বেরিয়ে আসেন, তার মধ্যে যথেষ্ট ফারাক থাকে। আমাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মাধ্যক্ষেরা প্রায়ই অভিযোগ করেন, তাঁদের যে ধরনের পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন, দেশের উচ্চশিক্ষা খাত তা সরবরাহ করতে পারে না। ফলে আমাদের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের কর্মনিয়োজন বিঘ্নিত হয়।
সে সঙ্গে কোন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সনদ পাওয়া গেছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সনদপ্রাপ্ত স্নাতকদের ২৩ শতাংশই বেকার অথচ ইংরেজিতে স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ০.১৭ শতাংশ। মনে রাখা দরকার, বর্তমান বিশ্বের কর্মজগৎ, কর্মবিষয় ও কর্মধারা দ্রুত বদলাচ্ছে। এর একটি কারণ অবশ্যই তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব, কিন্তু এর অন্যতম কারণ হচ্ছে উৎপাদন ও সেবা খাতের কাঠামোগত পরিবর্তন। ফলে নতুন নতুন পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতার চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাকাঠামো সে জ্ঞান ও দক্ষতা সৃষ্টি করতে পারছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত কর্মহীন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে এবং সেই সঙ্গে কর্মনিয়োজনের ক্ষেত্রে বর্তমান উচ্চশিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে।
উচ্চশিক্ষা এবং কর্মনিয়োজনের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতার অন্যান্য মাত্রিকতা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে ৩ লাখ স্নাতককে কর্মনিয়োজনে আত্মস্থ করতে পারে। অথচ বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাকাঠামো শুধু ২০২২ সালেই প্রায় ৭ লাখ স্নাতকের জন্ম দিয়েছে। জোগান যেখানে চাহিদার দ্বিগুণের চেয়ে বেশি, সেখানে উচ্চ কর্মহীনতা ঘটতে বাধ্য। এই বিশাল জোগানের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অভাবনীয় বিস্তার।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৫৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তিন বছর আগে যেটা ছিল ৫৩। গত তিন বছরে আরও ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে বর্তমানে আমাদের দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৬টি। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় অংশই সনদ প্রদান করে; কিন্তু প্রার্থিত দক্ষতা সৃষ্টি করে না। যেমন বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২০২২ সালে দেশের ৭ লাখ স্নাতকের ৬১ শতাংশের জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে কর্মবিহীন স্নাতকদের ১৬ শতাংশ ওই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্নাতক।
বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের উচ্চ কর্মহীনতার একটি সামষ্টিক পরিপ্রেক্ষিতও রয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কর্মবিহীন প্রবৃদ্ধি। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে; কিন্তু তা কর্মনিয়োজন সৃষ্টি করেনি। সরকারি মনোযোগের পুরোটাই ছিল প্রবৃদ্ধির দিকে, কর্মসৃষ্টির দিকে নয়। বর্তমান সময়ে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে গেছে, কমে গেছে কর্মনিয়োজনের সুযোগ। বাংলাদেশের খাতগুলোতেও জাতীয় আয় ও কর্মনিয়োজনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। দেশের কৃষি খাত জাতীয় আয়ের মাত্র ১১ শতাংশ অবদান রাখে; কিন্তু ৪৫ শতাংশ মানুষকে কর্মনিয়োজিত করে, তবে সেখানে ছদ্ম বেকারত্ব এবং অপরিপূর্ণ কর্মনিয়োজন রয়েছে। শিল্প খাত জাতীয় আয়ে ৩৭ শতাংশ অবদান রাখে; কিন্তু কর্মনিয়োজনে তার ভাগ মাত্র ১৭ শতাংশ। যদিও সেবা খাত জাতীয় আয়ে ৫১ শতাংশ অবদান রাখে, কর্মনিয়োজনে তার অংশ ৩৮ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্বের আরও একটি কারণ রয়েছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন, প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাঁদের কর্মনিয়োজনের ক্ষেত্রে অত বেশি যাচাই-বাছাই করেন না। যা লভ্য, সেটাই তাঁরা নিয়ে নেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্ত তরুণেরা কর্মগ্রহণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নানা বিষয় বিবেচনা করেন, যার মধ্যে কাজসংশ্লিষ্ট সামাজিক মর্যাদাও রয়েছে। সব রকমের লভ্য কাজকে তাঁরা বিবেচ্য মনে করেন না। এবং তাঁদের যাচাই-বাছাইও বেশ কঠিন। ফলে তাঁদের কর্মগ্রহণ সিদ্ধান্ত অত বেশি নমনীয় হয় না।
এই বিস্তৃত চালচিত্রের দুটো মাত্রিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় সনদপ্রাপ্তির পরও কর্মহীন থাকলে তা তরুণদের মধ্যে একটা হতাশার সৃষ্টি করে। সে কর্মহীনতার সময়কাল দীর্ঘায়িত হলে তা উপর্যুক্ত হতাশাকে আরও গভীর করে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সে হতাশার আর্থিক ও মানসিক মাত্রিকতা রয়েছে; কিন্তু সামষ্টিক পর্যায়ে সে হতাশার সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রিকতা রয়েছে। তারুণ্যের হতাশা শুধু নেতিবাচক নয়; কাঙ্ক্ষিতও নয় মোটে।
সেই সঙ্গে যে দেশে ৯ লাখ উচ্চশিক্ষিত তরুণ কর্মহীন ও যেখানে ৮৬ লাখ তরুণ শিক্ষা, কর্মনিয়োজন ও প্রশিক্ষণের বাইরে আছে, সেটা সম্পদের একটি বিরাট অপচয়। অথচ অর্থনৈতিক গতিময়তা এবং সমাজ পরিবর্তনে তারুণ্য একটি বড় সম্পদ। তরুণদের প্রাণশক্তি, ঝুঁকি নেওয়ার সক্ষমতা, সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতা, সাহস ও মনোবল অপ্রথাগত চিন্তা করার ক্ষমতার সুচারু ব্যবহার না হলে সেটা দুর্লভ এক সম্পদের অভাবনীয় অপচয়।
বিশ্ব বদলাচ্ছে দ্রুত। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের তরুণদের প্রতিযোগিতা করতে হবে একটি গতিময় বিশ্বের মধ্যে। সে জন্য তারুণ্যের শক্তির অপচয় রোধ করে, তাঁদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, তাঁদের কাজে লাগিয়ে আমাদের দ্রুত প্রস্তুত হতে হবে। কারণ, হাতে আমাদের সময় খুব একটা বেশি নেই।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
গাজায় চলমান যুদ্ধের কারণে ইসরায়েল দিন দিন একঘরে হয়ে পড়ছে। চাপ বাড়ছে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর। সম্প্রতি স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়ে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি রাষ্ট্র স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, গাজায় যা ঘটছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
৭ ঘণ্টা আগেশরৎ এসেছে। এ যেন এক অনুপম কবিতা, যা বারবার নতুন করে ছুঁয়ে যায় মনকে। তপ্ত গ্রীষ্মের দীর্ঘ দাবদাহ থেকে মুক্তি আর শীতের কোমল আগমনী বার্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে মোহময় এক অপরূপ সুরে। নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো তুলোর মতো শুভ্র সাদা মেঘ, দোল খাওয়া কাশফুলের সমারোহ—সব মিলিয়ে শরৎ প্রকৃতিকে সাজায় শান্তি...
৭ ঘণ্টা আগেবাঙালি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতার দিক থেকে দুর্গাপূজাই বড় পরিসরে উদ্যাপিত হয়ে থাকে। দুর্গাপূজার প্রধান আবেদন হলো, সব অশুভ শক্তি নির্মূল করা। হিন্দু পুরাণ মতে, রামচন্দ্র রাক্ষস রাজা রাবণকে বধ করার জন্য আশ্বিন মাসে মা দুর্গার আরাধনা করেছিলেন; তখন থেকে দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয়।
৮ ঘণ্টা আগেগত সরকারের আমলে দেশের অনেক বেসরকারি কলেজ সরকারীকরণ করা হয়। তবে ২০১৮ সালে সরকারি হওয়ার আদেশ জারির পর থেকে সংশ্লিষ্ট কলেজগুলোতে এক নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকদের সুযোগ-সুবিধা ও কল্যাণের কথা বিবেচনা করেই তো সরকারীকরণ করা হয়েছিল...
১ দিন আগে