Ajker Patrika

দুর্গা সত্য ও সুন্দরের প্রতীক

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী
দুর্গাপূজা সব শ্রেণি, পেশা ও ধর্মের মানুষের মিলনমেলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
দুর্গাপূজা সব শ্রেণি, পেশা ও ধর্মের মানুষের মিলনমেলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

শরৎ এসেছে। এ যেন এক অনুপম কবিতা, যা বারবার নতুন করে ছুঁয়ে যায় মনকে। তপ্ত গ্রীষ্মের দীর্ঘ দাবদাহ থেকে মুক্তি আর শীতের কোমল আগমনী বার্তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে মোহময় এক অপরূপ সুরে। নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো তুলোর মতো শুভ্র সাদা মেঘ, দোল খাওয়া কাশফুলের সমারোহ—সব মিলিয়ে শরৎ প্রকৃতিকে সাজায় শান্তি ও প্রশান্তির অপরূপ রঙে। এই মনোরম ঋতুতে শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালি হৃদয়ে জাগায় এক ভিন্ন উৎসবের আবেগ। এ যেন এক অনন্য অনুভূতি। প্রকৃতির রূপ ও উৎসবের উচ্ছ্বাস যেন এক সুরেলা বন্ধনে মিলে যায়, আর তারই মাঝে বাঙালি খুঁজে পায় শারদীয় উৎসবের প্রকৃত আনন্দ ও আমেজ।

হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে, দেবী দুর্গা ‘দুর্গতিনাশিনী’ যিনি সকল দুঃখ-দুর্দশার বিনাশকারিনী, অশুভের অবসান ঘটিয়ে শুভের প্রতিষ্ঠা করেন। দেবী দুর্গা হলেন শক্তির পরম রূপ। পুরাণ কথায় আছে, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের শরীর থেকে অগ্নিতেজের মতো অসংখ্য রশ্মি নির্গত হয়ে এক বিশাল আলোকপুঞ্জে পরিণত হয়েছিল। সেই আলোকপুঞ্জ থেকেই আবির্ভূত হন মহাশক্তি, মহামায়া দুর্গা। দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত এই দেবী একে একে অসুরকুলকে বিনাশ করে স্বর্গে ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শান্তি ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

দশভুজা দুর্গার প্রতিটি হাতের অস্ত্র একেকটি দিকের প্রতীক। অর্থাৎ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্রই ঈশ্বরের উপস্থিতি বিরাজমান। মা দুর্গার ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমা সৃজন, পালন ও সংহারের প্রতীক। এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের চক্রে তিনিই নিয়ন্ত্রিণী। তিনি ব্রহ্মারূপে সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরূপে পালন করেন আর শিবরূপে সংহার করেন। অতএব, তিনি বিশ্ব প্রসারিণী, মাতৃরূপিণী শ্রীশ্রী দুর্গা।

দুর্গাপূজা মহোৎসবের মহিমা: বাঙালি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে সবচেয়ে বড় আনন্দ উৎসব হলো দুর্গাপূজা। দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশে এটি শরৎকালের মহোৎসব হিসেবে উদ্‌যাপিত হয়, তাই এর আরেক নাম শারদীয় উৎসব। আশ্বিন মাসের মহালয়ার অমাবস্যা থেকে শুরু হয়ে দশমী পর্যন্ত উৎসব চলে ধারাবাহিক আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী। অন্যদিকে, বসন্তকালে দেবীর আগমনকে বলা হয় বাসন্তীপূজা বা অকালবোধন। দেবী দুর্গা ব্রহ্মশক্তির স্বরূপিণী, বিভাসিতা মাতৃশক্তি, জগজ্জননী। তিনি জীবজগতে বিরাজমান চেতনারূপে, বুদ্ধিরূপে, শক্তিরূপে, শান্তিরূপে, দয়ারূপে ও শ্রদ্ধারূপে।

দুর্গোৎসবের মূল প্রতিপাদ্য: ২০২৫ সালের দুর্গোৎসবের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘অশুভ শক্তির বিনাশ, শুভ শক্তির জাগরণ’। আজকের পৃথিবীতে যখন অন্যায়, সহিংসতা, বৈষম্য ও অশান্তি বারবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন দুর্গোৎসব আমাদের মনে করিয়ে দেয় দেব-দেবীর মতো আমরাও অশুভকে পরাভূত করে শুভ শক্তিকে জাগ্রত করতে পারি।

দুর্গার নাম ও মাহাত্ম্য: দুর্গা নামের প্রতিটি অক্ষরেই নিহিত রয়েছে একেকটি গভীর তাৎপর্য। ‘দ’ দৈত্যনাশক, ‘উ’ বিঘ্ননাশক, ‘র’ রোগনাশক, ‘গ’ পাপনাশক, ‘আ’ ভয় ও শত্রুনাশক। অতএব, যিনি দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয় থেকে আমাদের রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। চণ্ডীতে বর্ণিত আছে—দুর্গম নামক অসুরকে বধ করার পর দেবীর নামকরণ হয় দুর্গা। দুর্গম অসুরের উদ্দেশ্য ছিল জীবজগৎকে দুর্গতিতে ফেলা। তাকে বধ করে দেবী দেবতাদের হারানো আসন ফিরিয়ে দেন, আর মানবজাতিকে অশুভের হাত থেকে রক্ষা করেন।

মহিষাসুর ও প্রতীকী তাৎপর্য: দেবীর পদতলে মহিষাসুর অশুভ ও অহংকারের প্রতীক জগতের অমঙ্গলের মূল। ত্রিনয়নী মহাদেবী দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করতে আবির্ভূত হন। তাঁর প্রতিমায় প্রতিফলিত হয় শৌর্য-বীর্য (কার্তিক), জ্ঞান-ভক্তি (সরস্বতী), সিদ্ধি (গণেশ) ও সম্পদ (লক্ষ্মী)। মানুষের ইহজীবনের কল্যাণ, ভৌতিক প্রাপ্তি এবং অন্তিমকালে মাতৃক্রোড়ে চির আশ্রয়—সবই এই পূজার আধ্যাত্মিক বার্তায় নিহিত।

আচার-অনুষ্ঠান: প্রাচীন শাস্ত্রমতে, দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষের নিচে। ষষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ, যেখানে কলাবউ সাজানো হয় বধূর আকৃতিতে এবং দেবীর পাশে স্থাপন করা হয়। অষ্টমীতে মহাষ্টমীর পূজা ও নবমী সন্ধিক্ষণে হয় সন্ধিপূজা, যা দুর্গোৎসবের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ আচার।

কুমারীপূজা: মহাষ্টমীর পূজার অন্যতম বিশেষ অংশ হলো কুমারীপূজা। পুরাণ মতে, দেবগণের প্রার্থনায় দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে আবির্ভূত হয়ে কোলাসুরকে বধ করেছিলেন। সেই থেকে মর্ত্যে কুমারীপূজার প্রচলন। এখানে ষোড়শীর কম বয়সী অরজঃস্বলা কুমারী মেয়েকে দেবীর প্রতিরূপ হিসেবে পূজা করা হয়। জাতি, বর্ণ, ধর্মভেদ না দেখে মানবিকতার প্রতীক হিসেবেই কুমারীপূজা আজও পালিত হয়ে আসছে।

দুর্গার যুগে যুগে আবির্ভাব: দুর্গা নামের আরেক অর্থ দুর্জেয়া। যুগে যুগে নানা সংকটকালে তিনি ভিন্ন ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। মহিষমর্দিনী, পার্বতী, কালিকা, অম্বিকা, বৈষ্ণবী, কৌমারী, চণ্ডী, উমা, হৈমবতী—অসংখ্য নামে তিনি পূজিতা। তিনি আদ্যাশক্তি মহামায়া, ব্রহ্ম সনাতনী। তিনি সম্পদ, মহারী, লজ্জা, পুষ্টি, তুষ্টি ও শ্রদ্ধার আধার। তিনি নিয়তি, তিনি প্রলয় রাত্রি, তিনিই সর্বময়ী। মা প্রসন্ন হলে সব বিপদ দূর হয়, আর যদি তিনি অপ্রসন্ন হন, তবে জীবনের কামনা ব্যর্থ হয়। মাতৃরূপিণী দুর্গা দশ হাতে সন্তানকে দিচ্ছেন শক্তি, প্রেরণা ও অভয়—সকল প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করে পরম লক্ষ্যে পৌঁছে দিচ্ছেন।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে দুর্গোৎসব: আজকের দিনে দুর্গা কেবল ধর্মীয় পূজার দেবী নন, বরং তিনি সত্য-সুন্দরের প্রতীক। বাংলাদেশে দুর্গাপূজা সব শ্রেণি, পেশা ও ধর্মের মানুষের মিলনমেলা। মা দুর্গার ডান পাশে লক্ষ্মী ও গণেশ, বাঁ পাশে সরস্বতী ও কার্তিকের অবস্থান প্রতীকায়িত করে—সমৃদ্ধি, জ্ঞান, সাহস ও ঐক্যের সমন্বয়েই মানবজীবন সফল হয়।

২০২৫ সালের এই শারদীয় দুর্গোৎসব আমাদের জন্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অশান্তি, সংঘাত ও বৈষম্যের আবহে মা দুর্গা যেন আবারও আহ্বান জানাচ্ছেন ‘অশুভ শক্তিকে বিনাশ করে শুভ শক্তির জাগরণ ঘটাতে হবে’।

দেবীস্তব:

শ্রীশ্রী চণ্ডীতে দেবীর মহিমা ঘোষিত হয়েছে—

‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।

যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।

যা দেবী সর্বভূতেষু শান্তিরূপেন সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।’

অর্থাৎ যিনি শক্তিরূপে, মাতৃরূপে, শান্তিরূপে সকল প্রাণীতে বিরাজমান, তাঁকেই আমরা বারবার প্রণাম জানাই।

শেষ কথা: মা দুর্গা বিশ্বজননী। তিনি জীবজগতের শক্তির আধার, সকল অকল্যাণ থেকে মুক্তির প্রতীক। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে বলা হয়েছে—‘হে দেবী, আপনি স্বর্গ ও মুক্তিদায়িনী, আপনি আমাদের শত্রু বিনাশ করে বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। তেমনি ত্রিভুবনের সকল দুঃখ-বিপদও দূর করুন’। এ বছর দুর্গোৎসব হোক শুভ শক্তির জাগরণের উৎসব, হোক শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতার জয়গান। জয় মা দুর্গা।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক ও ভিজিটিং প্রফেসর, বারডেম

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

গাজার জলসীমায় পৌঁছে গেছে ফ্লোটিলার এক জাহাজ, পথে আরও ২৩টি

ইসরায়েলি সব কূটনীতিককে দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টের

বাংলাদেশ–নেপালে সহিংস আন্দোলন হলেও পরিবর্তন আসেনি, বিদেশি হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হয়েছে: আরএসএস প্রধান

এখনো গাজা অভিমুখে চলছে ফ্লোটিলার ২৬ নৌযান, অবস্থান ৫০ কিমি দূরে

২০২৫ সালে বসবাসের জন্য সেরা ৫ দেশ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত