আবেদীন কাদের
গত সাড়ে তিন মাসে এটা আমার তৃতীয়বার হাসপাতাল বাস। এবং নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ‘বেদনাদায়ক’ স্মৃতি। বেদনাদায়ক মানে সত্যিকার শারীরিক ও মানসিক কষ্টের স্মৃতি। এবারের এই দীর্ঘ অ্যানেস্থেসিয়া এবং সার্জারি বা অজ্ঞান অবস্থা থেকে ফিরে আসা এসব নিয়ে অবশ্যই লিখব। এবং নিজেকে যেমন, তেমনি এক বিদগ্ধ পণ্ডিত অধ্যাপক বন্ধুকেও কথা দিয়েছি লিখব। একটা সময় তাঁকেও শারীরিক বৈকল্য ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু দমে যাননি, শীর্ষ ডিগ্রি করা, উঁচু মানের গবেষণা করা বা বই লেখা সবই করেছেন কিছুটা অসুস্থ শরীর নিয়েই। তিনি আমার কাছে নমস্য!
কাল বিকেলে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি, শোয়াটা ভীষণ কষ্টের। কারণ, কাটাছেঁড়া পিঠের নিচের দুই দিকে, কিডনি বরাবর। সেখানে ব্যান্ডেজ, তার ভেতর থেকে নল বের করে পায়ের কাছে একটি ব্যাগে সংযোগ দেওয়া। একেবারেই নড়তে পারি না। বাম হাতে ইন্ট্রাভেনাস নল লাগানো ঝুলন্ত ব্যাগের সঙ্গে, ডান হাতে কয়েক ঘণ্টা পরপর ফুঁড়ে ফুঁড়ে রক্ত নিচ্ছেন নার্স। আমি কাত হয়ে শুয়ে আছি দিনের পুরোটা সময়। কখনো ঘুম আর জাগরণের ঠিক মাঝে আমার চেতন! কী ভাবছিলাম জানি না, কিন্তু নার্স একগাদা সুঁই আর যন্ত্র নিয়ে এসে বললেন, ‘তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? কাঁদছ কেন?’ আমি একটু বিব্রত হই, সত্যিই এটা কী করছি! আমার চোখ থেকে গাল গড়িয়ে জল পড়ছে, সত্যিই একটু অসহায় বোধ করলাম। এত বয়সে ব্যক্তিগত কষ্ট পাবলিকলি সামলাতে না পারা ঠিক শোভন নয়। নার্সকে কিছু বলিনি, তিনি আমার লজ্জাবনত মুখ চোখ বা অসহায়ত্ব কিছুটা বুঝতে পারছেন মনে হয়! হাত এগিয়ে দিলাম, তিনি অনেক খোঁড়াখুঁড়ি করে শিরা পেলেন, রক্ত নিলেন।
আজকাল আর শিরা পাওয়া যায় না, খুঁড়তে খুঁড়তে দুটো হাতেই একেবারে ঘন কালো দাগে ভরে গেছে। সারাদিন বা রাতের অনেকটা সময় নিজের হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকি আর বিস্মিত হই। ছেলেবেলা থেকে দেখে আসা আমার মায়ের দুটো হাত আর আঙুলগুলো আমার ভীষণ পরিচিত! এর প্রতিটি কণা-ত্বকের ছবি আমার মুখস্থ। বছরের পর বছর ছেলেবেলায় রোগশয্যায় থেকে দেখেছি, সেই হাত দুটি আমাকে খাবার-ওষুধ দিচ্ছে। কিন্তু গত তিন-চার দিনের মতো এত নিবিড়ভাবে খেয়াল করিনি আমার হাত দুটো; এর ত্বকের রং ও আঙুলগুলো অবিকল মায়ের হাত দুটোর একেবারে জেরক্স কপি। কী করে ৬০ বছরের বেশি সময় আমার চোখ এই অবিকল সাদৃশ্যের ছবি এড়িয়ে গেল! গত আড়াই মাসের অধিক সময় আমি একটি মুহূর্তের জন্য মায়ের মুখখানা ভুলতে পারিনি।
কিন্তু হাসপাতাল শয্যায় শুয়ে কেন জানি না মা আমাকে একেবারে তীব্রভাবে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখলেন! তাঁর চলে যাওয়ার আগে কয়েকটা দিন ডাক্তাররা বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য তাঁর শরীরে এত খোঁড়াখুঁড়ি করেছিলেন যে তিনি বারবার ইনটেনসিভ কেয়ার থেকে আমার ডাক্তার ভাইঝি আদৃতা আবেদীনকে অনুরোধ করতেন, তাঁকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য! তিনি কষ্টটা সহ্য করতে পারছিলেন না। আমার হাতে নার্স দিনে কয়েকবার সুঁই ফুঁড়লেই আমার মায়ের সেই আকুতির কথা মনে পড়ে, বুকটা কান্নায় অসহ্য ভার হয়ে ওঠে! আমার মা ছিলেন হাইপোকনড্রিয়াক।
আমি মায়ের চেয়ে বেশি হাইপোকনড্রিয়াক। ডাক্তার-হাসপাতাল শুনলেই আমার ভীষণ দীর্ঘসূত্রতা শুরু হয় ভয়ে। বিধাতা সে জন্যই হয়তো জীবনে এত বেশি শারীরিক বৈকল্য নিয়ে আমাকে বাঁচতে শেখালেন। কিন্তু মা ছিলেন শারীরিকভাবে খুব সুস্থ, রোগ তেমন কখনোই ছিল না। বারদুয়েক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে এবং নব্বইয়ের কাছাকাছি বয়সে একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, হাসপাতালে যেতে হয়েছে, এই যা। সারাজীবন স্বল্পাহারী, রোগহীন, শান্ত, নীরব এক মানুষ। কিন্তু যখনই কাছে গিয়েছি চোখটা জলে ভেজা দেখতাম। আমার কাছে কী চাইতেন, বুঝতে পারতাম, কিন্তু বলতেন না। যখন সব গুছিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম তাঁর চাওয়ার মূল্য দিতে, তখনই তিনি চলে গেলেন! হাসপাতালে আর কাউকে বা কোনো কিছু আমার মনে পড়ে না, বেঁচে থাকব কদিন, কী হবে শরীরের, কিছুই আমাকে ভাবায় না, সারাক্ষণ মায়ের মুখখানা মনে পড়ে!
গত সাড়ে তিন মাসে এটা আমার তৃতীয়বার হাসপাতাল বাস। এবং নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ‘বেদনাদায়ক’ স্মৃতি। বেদনাদায়ক মানে সত্যিকার শারীরিক ও মানসিক কষ্টের স্মৃতি। এবারের এই দীর্ঘ অ্যানেস্থেসিয়া এবং সার্জারি বা অজ্ঞান অবস্থা থেকে ফিরে আসা এসব নিয়ে অবশ্যই লিখব। এবং নিজেকে যেমন, তেমনি এক বিদগ্ধ পণ্ডিত অধ্যাপক বন্ধুকেও কথা দিয়েছি লিখব। একটা সময় তাঁকেও শারীরিক বৈকল্য ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু দমে যাননি, শীর্ষ ডিগ্রি করা, উঁচু মানের গবেষণা করা বা বই লেখা সবই করেছেন কিছুটা অসুস্থ শরীর নিয়েই। তিনি আমার কাছে নমস্য!
কাল বিকেলে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছি, শোয়াটা ভীষণ কষ্টের। কারণ, কাটাছেঁড়া পিঠের নিচের দুই দিকে, কিডনি বরাবর। সেখানে ব্যান্ডেজ, তার ভেতর থেকে নল বের করে পায়ের কাছে একটি ব্যাগে সংযোগ দেওয়া। একেবারেই নড়তে পারি না। বাম হাতে ইন্ট্রাভেনাস নল লাগানো ঝুলন্ত ব্যাগের সঙ্গে, ডান হাতে কয়েক ঘণ্টা পরপর ফুঁড়ে ফুঁড়ে রক্ত নিচ্ছেন নার্স। আমি কাত হয়ে শুয়ে আছি দিনের পুরোটা সময়। কখনো ঘুম আর জাগরণের ঠিক মাঝে আমার চেতন! কী ভাবছিলাম জানি না, কিন্তু নার্স একগাদা সুঁই আর যন্ত্র নিয়ে এসে বললেন, ‘তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? কাঁদছ কেন?’ আমি একটু বিব্রত হই, সত্যিই এটা কী করছি! আমার চোখ থেকে গাল গড়িয়ে জল পড়ছে, সত্যিই একটু অসহায় বোধ করলাম। এত বয়সে ব্যক্তিগত কষ্ট পাবলিকলি সামলাতে না পারা ঠিক শোভন নয়। নার্সকে কিছু বলিনি, তিনি আমার লজ্জাবনত মুখ চোখ বা অসহায়ত্ব কিছুটা বুঝতে পারছেন মনে হয়! হাত এগিয়ে দিলাম, তিনি অনেক খোঁড়াখুঁড়ি করে শিরা পেলেন, রক্ত নিলেন।
আজকাল আর শিরা পাওয়া যায় না, খুঁড়তে খুঁড়তে দুটো হাতেই একেবারে ঘন কালো দাগে ভরে গেছে। সারাদিন বা রাতের অনেকটা সময় নিজের হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকি আর বিস্মিত হই। ছেলেবেলা থেকে দেখে আসা আমার মায়ের দুটো হাত আর আঙুলগুলো আমার ভীষণ পরিচিত! এর প্রতিটি কণা-ত্বকের ছবি আমার মুখস্থ। বছরের পর বছর ছেলেবেলায় রোগশয্যায় থেকে দেখেছি, সেই হাত দুটি আমাকে খাবার-ওষুধ দিচ্ছে। কিন্তু গত তিন-চার দিনের মতো এত নিবিড়ভাবে খেয়াল করিনি আমার হাত দুটো; এর ত্বকের রং ও আঙুলগুলো অবিকল মায়ের হাত দুটোর একেবারে জেরক্স কপি। কী করে ৬০ বছরের বেশি সময় আমার চোখ এই অবিকল সাদৃশ্যের ছবি এড়িয়ে গেল! গত আড়াই মাসের অধিক সময় আমি একটি মুহূর্তের জন্য মায়ের মুখখানা ভুলতে পারিনি।
কিন্তু হাসপাতাল শয্যায় শুয়ে কেন জানি না মা আমাকে একেবারে তীব্রভাবে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখলেন! তাঁর চলে যাওয়ার আগে কয়েকটা দিন ডাক্তাররা বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য তাঁর শরীরে এত খোঁড়াখুঁড়ি করেছিলেন যে তিনি বারবার ইনটেনসিভ কেয়ার থেকে আমার ডাক্তার ভাইঝি আদৃতা আবেদীনকে অনুরোধ করতেন, তাঁকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য! তিনি কষ্টটা সহ্য করতে পারছিলেন না। আমার হাতে নার্স দিনে কয়েকবার সুঁই ফুঁড়লেই আমার মায়ের সেই আকুতির কথা মনে পড়ে, বুকটা কান্নায় অসহ্য ভার হয়ে ওঠে! আমার মা ছিলেন হাইপোকনড্রিয়াক।
আমি মায়ের চেয়ে বেশি হাইপোকনড্রিয়াক। ডাক্তার-হাসপাতাল শুনলেই আমার ভীষণ দীর্ঘসূত্রতা শুরু হয় ভয়ে। বিধাতা সে জন্যই হয়তো জীবনে এত বেশি শারীরিক বৈকল্য নিয়ে আমাকে বাঁচতে শেখালেন। কিন্তু মা ছিলেন শারীরিকভাবে খুব সুস্থ, রোগ তেমন কখনোই ছিল না। বারদুয়েক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে এবং নব্বইয়ের কাছাকাছি বয়সে একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, হাসপাতালে যেতে হয়েছে, এই যা। সারাজীবন স্বল্পাহারী, রোগহীন, শান্ত, নীরব এক মানুষ। কিন্তু যখনই কাছে গিয়েছি চোখটা জলে ভেজা দেখতাম। আমার কাছে কী চাইতেন, বুঝতে পারতাম, কিন্তু বলতেন না। যখন সব গুছিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম তাঁর চাওয়ার মূল্য দিতে, তখনই তিনি চলে গেলেন! হাসপাতালে আর কাউকে বা কোনো কিছু আমার মনে পড়ে না, বেঁচে থাকব কদিন, কী হবে শরীরের, কিছুই আমাকে ভাবায় না, সারাক্ষণ মায়ের মুখখানা মনে পড়ে!
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এই বিভাগ থেকেই অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করে নরওয়ের বারগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাইব্রিড...
২১ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশে প্রায় ৬ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ আছে, যার মধ্যে কমপক্ষে ৩০০ প্রজাতির বিদেশি উদ্ভিদ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেসব গাছপালা রয়েছে, তার ৪১ শতাংশই বিদেশি উদ্ভিদ। ঢাকার সড়ক বিভাজকে লাগানো ৫৬ শতাংশ গাছ বিদেশি।
২১ ঘণ্টা আগেসাতক্ষীরার কালীগঞ্জে পাঁচ বছর বয়সী যে শিশুটি গত বৃহস্পতিবার দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, সে বেঁচে আছে বটে; কিন্তু শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শিশুটির অবস্থা স্থিতিশীল ছিল না। চিকিৎসকেরা শিশুটির শুশ্রূষা করছেন।
২১ ঘণ্টা আগেঅন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্বয়ং একাধিকবার বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন এমন এক আবহে অনুষ্ঠিত হবে যে তা শুধু দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও সর্বজনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এটা তাঁর নিজের এবং অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে
২ দিন আগে