Ajker Patrika

যমুনা রেলসেতু: পৌনে ১৭ হাজার কোটির সেতুতে চলে ৩৫ ট্রেন

  • প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় উদ্বোধনের পর দিনে ৮৮ ট্রেন চলার লক্ষ্যমাত্রা ছিল।
  • সেতুতে একসঙ্গে একাধিক ট্রেন চলার সক্ষমতা থাকলেও দুই পাশের লাইন সিঙ্গেল।
  • চাহিদা থাকলেও নতুন ট্রেন চালানোর মতো ইঞ্জিন ও কোচ নেই রেলওয়ের হাতে।
তৌফিকুল ইসলাম, ঢাকা 
নবনির্মিত যমুনা রেলসেতুতে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে গতকাল। নতুন সেতুতে প্রতিটি ট্রেন পারাপারে ৩০-৩৫ মিনিট সময় বাঁচবে বলে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে। ছবি: আজকের পত্রিকা
নবনির্মিত যমুনা রেলসেতুতে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে গতকাল। নতুন সেতুতে প্রতিটি ট্রেন পারাপারে ৩০-৩৫ মিনিট সময় বাঁচবে বলে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে। ছবি: আজকের পত্রিকা

প্রায় পৌনে ১৭ হাজার কোটি টাকায় নির্মিত যমুনা রেলসেতুতে দৈনিক গড়ে ট্রেন চলছে মাত্র ৩৫টি। প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় দেশের দীর্ঘতম এই রেলসেতু উদ্বোধনের পর প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৮৮টি ট্রেন চলার কথা বলা হয়েছিল। অথচ উদ্বোধনের প্রায় ছয় মাস পর চলছে ওই লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের কম ট্রেন।

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র বলছে, লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) ও বগি-সংকট, ডাবল লাইন না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে যমুনা রেলসেতুতে ট্রেন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। এই সেতু হওয়ায় যমুনা পাড়ি দেওয়া ট্রেনের যাত্রার সময় কমাসহ ক্রসিং-জটও কিছুটা কমেছে। বিভিন্ন রুট ডাবল লাইন ও সংকেত (সিগন্যাল) ব্যবস্থা আধুনিক করা হলে এই রেলসেতু পূর্ণ সক্ষমতা পাবে।

যমুনা রেলসেতুর মূল নির্মাণকাজ শেষ হলেও সংকেতব্যবস্থাসহ ছোটখাটো কিছু কাজ বাকি। এই প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৯৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। প্রকল্প সূত্র জানায়, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অতিরিক্ত কাজ বাকি থাকায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও দেড় বছর বাড়িয়ে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হবে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, শুধু সেতুর সক্ষমতা বাড়ালেই হবে না, পুরো করিডরে ডাবল লাইনের সুবিধা আছে কি না, সেটি বিবেচনায় নিয়েই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত। সমীক্ষায় বিষয়টি যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়েছিল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সেতুর আগে-পরে সিঙ্গেল লাইন থাকায় পূর্ণ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ হলেও রেলওয়ের আলাদা কোনো আয়ের উৎস না থাকায় বেশি ট্রেন না চালাতে পারলে আয় বাড়বে না, বিনিয়োগও উঠবে না।

একসময় যমুনা বহুমুখী সেতুর সঙ্গে সংযুক্ত রেললাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল করত। চলতি বছরের ১৮ মার্চ যমুনা রেলসেতু উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে এই সেতু দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩৫টি ট্রেন চলাচল করছে। অথচ সমীক্ষার লক্ষ্যমাত্রা ছিল গড়ে ৮৮টি।

রেলওয়ের সূত্র বলছে, যমুনা রেলসেতুতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ট্রেন চলার একাধিক কারণ রয়েছে। মূলত গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রেল করিডর এখনো সিঙ্গেল লাইন। ফলে সেতুতে একসঙ্গে অনেক ট্রেন চলতে পারছে না; পাশাপাশি পর্যাপ্ত লোকোমোটিভ ও কোচের ঘাটতির কারণে নতুন ট্রেন চালু করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া সেতুর জন্য স্থাপিত আধুনিক সংকেত এবং যোগাযোগব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় নিরাপত্তার কারণে বাধ্য হয়ে ট্রেনের সংখ্যা সীমিত রাখতে হচ্ছে। মূল রেললাইন ও স্টেশনগুলোর পুরোনো অবকাঠামোর কারণে নতুন ও দ্রুত ট্রেন চালাতে সীমাবদ্ধতা আছে। এসব কারণ একত্র হয়ে এই সেতুর পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করতে দিচ্ছে না। ডাবল লাইন, আধুনিক লোকোমোটিভ ও কোচ এবং সিগন্যাল ব্যবস্থার পূর্ণ বাস্তবায়ন করলে সহজে সক্ষমতা অর্জন সম্ভব।

যমুনা রেলসেতুর আগে ও পরের দুই স্টেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন যমুনা রেলসেতু কার্যকরভাবে ট্রেন যাত্রার সময় কমানোর পাশাপাশি অপেক্ষা এবং ক্রসিং-জট কিছুটা দূর করেছে। এখন সেতুর দুই পাশে ট্রেনকে দীর্ঘ সময় আটকে থাকতে হয় না। বর্তমানে ম্যানুয়াল সংকেত ব্যবস্থায় চলছে। স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটিক) সংকেত ব্যবস্থা চালু হলে ট্রেন চলাচলের সময় আরও কমতে পারে।

যমুনা রেলসেতুকে পূর্ণ সক্ষমতা দিতে রেল বিভাগের পরিকল্পনায় ছিল জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ এবং পার্বতীপুর-কাউনিয়া রুট ডাবল লাইন করার। একই সঙ্গে পর্যাপ্ত লোকোমোটিভ ও কোচ সংগ্রহ এবং আধুনিক সংকেত কার্যকর করা। তবে এসব প্রকল্প এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আফজাল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, বর্তমানে ইঞ্জিন ও কোচের সংকট রয়েছে। উত্তরাঞ্চলের করিডরে এখনো ডাবল লাইন হয়নি। ফলে চাহিদা ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যমুনা রেলসেতুতে পর্যাপ্ত ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন কোচ আনার প্রকল্প চলমান এবং জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইনের কাজও শিগগির শুরু হবে। এসব কাজ সম্পন্ন হলে ট্রেন চলাচল বাড়ানো সম্ভব হবে।

যমুনা রেলসেতু প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে

সূত্র জানায়, যমুনা রেলসেতুর মূল নির্মাণকাজ শেষ হলেও প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৯৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। তবে সংকেতসহ কিছু ছোটখাটো কাজ বাকি আছে। এই প্রকল্পের আওতায় রেলওয়ে ব্রিজ মিউজিয়াম, ইন্সপেকশন বাংলো, ক্যাফেটেরিয়া, অভ্যন্তরীণ সড়ক, মাটি ভরাট ও ড্রেনেজ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। বিশেষ এই নির্মাণ প্যাকেজের জন্য ৭৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই প্যাকেজে পরিবর্তন আনা হয়। নতুনভাবে এখানে ইন্সপেকশন বাংলো, এক্সিবিশন হল, ক্যাফেটেরিয়া ইত্যাদি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিবর্তিত পরিকল্পনায় ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৫৮ কোটি টাকা। এখনো এই কাজের দরপত্র হয়নি। দরপত্র ও নির্মাণ শেষ করতে বাড়তি সময় লাগবে।

প্রকল্প সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের জুনে এই প্রকল্প অনুমোদিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু অতিরিক্ত কাজ বাকি থাকায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও দেড় বছর বাড়িয়ে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হবে।

জানতে চাইলে যমুনা রেলসেতুর প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান আজকের পত্রিকা'কে বলেন, ডব্লিউডি-৫ প্যাকেজের কাজ বাকি আছে। সেগুলো শেষ করতে সময় লাগবে। এ জন্য ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হবে। তবে সংকেতের কাজ আগামী অক্টোবরের মধ্যে শেষ হবে। ব্যয় কিছুটা কমেছে। তবে চূড়ান্ত হিসাব না করে এখনই সঠিক অঙ্ক বলা যাচ্ছে না।

এই প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকায়। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ অর্থায়ন এসেছে দেশীয় উৎস থেকে এবং ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ ঋণ দিয়েছে জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত