Ajker Patrika

জাহিলি যুগ ও রহমতের নবী (সা.)

ইসলাম ডেস্ক 
মসজিদে নববী, মদিনা। ছবি: সংগৃহীত
মসজিদে নববী, মদিনা। ছবি: সংগৃহীত

জাহিলি যুগ—অন্ধকারের এক দীর্ঘ অধ্যায়। সেই সময়ে আরবসহ গোটা পৃথিবী নিমজ্জিত ছিল ঘোর অমানিশায়। চতুর্দিকে ছিল অজ্ঞানতার কালো মেঘ, অশান্তির বিষাদময় ছায়া। ন্যায়-নীতি, মানবতা ও ভ্রাতৃত্ব ছিল বিস্মৃতপ্রায় এক কাহিনি। হত্যা, লুণ্ঠন, ব্যভিচার, নারীর অবমাননা, গোত্রীয় অহমিকা আর মূর্তিপূজা—এসব ছিল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অপরাধ-অপকর্ম চলত প্রকাশ্যে, যেন তা-ই সমাজের নিয়ম ও সংস্কৃতি।

এই আঁধারঘেরা প্রান্তরে আলোকবর্তিকার মতো আবির্ভূত হলেন নবী মুহাম্মদ (সা.)। তিনি জাহিলিয়াতের অমানিশাকে চ্যালেঞ্জ জানালেন, গ্রহণ করলেন সমাজসংস্কারের কঠিনতম দায়িত্ব। তিনি যে স্বপ্ন বুকে ধারণ করেছিলেন, তা শুধু একটি জাতির নয়; বরং গোটা মানবতার মুক্তির এক মহৎ আহ্বান। তিনি শুরু করলেন মানুষকে অন্তরকে পরিবর্তনের দাওয়াত। আত্মনিয়োগ করলেন অশান্তির স্থলে শান্তি, অন্যায়ের স্থলে ন্যায়, অন্ধকারের স্থলে আলো প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে।

দিনের পর দিন, বছরের পর বছর তাঁর অক্লান্ত শ্রম, ধৈর্য ও দাওয়াতের ফল ধীরে ধীরে রূপ নিল নতুন বাস্তবতায়। যে সমাজ একদিন নিমজ্জিত ছিল পশ্চাৎপদতায়, ধীরে ধীরে সেটি রূপান্তরিত হতে লাগল সভ্যতার আদর্শ কেন্দ্রে। অবশেষে তিনি সফল হলেন—চূড়ান্ত সাফল্যে। যে যুগে মানবতা ছিল বন্দী, যে সময়কে মানুষ ডাকত অন্ধকারের যুগ বলে, সেই সময়কে তিনি বদলে দিলেন সোনালি আলোর যুগে।

জাহিলিয়াতের আঁধার থেকে উঠে এল নূরের আলো। অমানিশা ভেদ করে জায়গা করে নিল নবুওয়াতের সূর্য। সেই সূর্যালোক আজও মানবজাতির জন্য অক্ষয় দিশারি, যা যুগে যুগে আলোকিত করে চলেছে দুনিয়াকে।

জাহিলি যুগ: জাহিলি যুগ হলো সেই সময়কাল, যা নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াতের আগে আরব উপদ্বীপে বিরাজমান ছিল। এ যুগ প্রায় দুই শ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে চলমান ছিল। এ সময়কে জাহিলি যুগ বলা হয়, যা মূলত তার অজ্ঞতার কারণে।

জাহিলি যুগের চিত্র: জাহিলি যুগের বাস্তব চিত্রটা নিখুঁতভাবে এঁকেছেন হজরত জাফর তায়্যার (রা.) বাদশাহ নাজ্জাশির দরবারে। তিনি সেদিন দীপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হে বাদশা! আমরা ছিলাম এক অজ্ঞ, মূর্খ ও বিভ্রান্ত জাতি। আমাদের ধর্ম ছিল কেবল হাতে গড়া মূর্তির পূজা করা। আমাদের রীতি ছিল মৃত জন্তুর গোশত খাওয়া। আমাদের সমাজ ছিল ব্যভিচারে ভরপুর। অন্যায় ও নৃশংসতায় আমরা আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলাম। আমরা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করতাম।

প্রতিবেশীর হকের কোনো পরোয়া করতাম না। আমাদের শক্তিমানেরা দুর্বলকে গিলে খেত। অত্যাচার করতে পারাকে আমরা গর্বের বিষয় মানতাম। এভাবেই আমরা ডুবে ছিলাম অমানবিকতা ও অন্ধকারের আঁধারে। আমাদের এ দুর্দশা বিরামহীনভাবে যুগের পর যুগ চলতে থাকে। এমন অবস্থায় মহান আল্লাহ আমাদের প্রতি দয়া করলেন। তিনি আমাদের মাঝে পাঠালেন একজন নবী, যাঁকে আমরা জন্ম থেকেই জানি।

তাঁর বংশ পরিচ্ছন্ন। চরিত্র মহান। সততা ও সত্যবাদিতায় তিনি অতুলনীয়। আমাদের চোখের সামনেই তাঁর শুদ্ধ নৈতিকতা ও নির্মল জীবন প্রতীয়মান। তিনি এলেন হিদায়াতের আলো নিয়ে। হাতে ধরে দেখালেন সত্যের প্রদীপ। তাঁর আগমনেই মুছে গেল জাহিলিয়াতের ঘোর অমানিশা। ছিন্ন হলো অন্যায়ের শৃঙ্খল। উন্মোচিত হলো আলোর দিগন্ত।

জাহিলি যুগের মন্দ বৈশিষ্ট্যসমূহ। মূর্তিপূজা: জাহিলি যুগের সবচেয়ে বড় মন্দ দোষ ছিল মূর্তিপূজা। কাবা শরিফকে ঘিরে তিন শতাধিক মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল ওই লোকেরা। প্রতিটি গোত্রের আলাদা দেবতা ছিল এবং তারা সেই দেবতার পূজা করত। এমনকি কাবার ভেতরও মূর্তি রাখা হয়েছিল। হজও হয়ে গিয়েছিল মূর্তিপূজাকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান। আল্লাহর একত্ববাদ ও হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর রেখে যাওয়া তাওহিদের শিক্ষা ভুলে গিয়ে তারা অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল।

কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস: ওই সব লোকের দৈনন্দিন জীবনে কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস ছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ভাগ্য গণনা, জ্যোতিষবিদ্যা, পাখির ডাক, পশুর চলাফেরা, হাড়-হাড্ডির ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ—এসব ছিল তাদের সাধারণ প্রথা। যুক্তিবোধ, জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার বদলে তারা এসব কুসংস্কারকে পথপ্রদর্শক মনে করত। ফলে সমাজে যৌক্তিক চিন্তা ও বাস্তব বিচারপ্রক্রিয়ার কোনো স্থান ছিল না।

নারীর অবমাননা: জাহিলি সমাজে নারীর অবস্থান ছিল অত্যন্ত করুণ। তাদের সম্পত্তির মতো গণ্য করা হতো। উত্তরাধিকার থেকে তারা বঞ্চিত ছিল। বিধবা নারীদের জোরপূর্বক কবজা করা হতো। কন্যাশিশুর জন্মকে লজ্জাজনক মনে করা হতো। তাই অনেকেই জীবন্ত কন্যাশিশুকে মাটিতে পুঁতে ফেলত। এভাবে ওই যুগে নারীরা ছিল নির্যাতন, অবমাননা ও অমানবিকতার শিকার।

সামাজিক অসংগতি: ব্যভিচার, মদ্যপান, জুয়া, সুদ, খুনোখুনি ও লুণ্ঠন ছিল তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারও জীবন বা সম্পদের নিরাপত্তা ছিল না। যার শক্তি বেশি, তার প্রভাব ও ক্ষমতাই আইন হিসেবে বিবেচিত হতো। দুর্বলরা সব সময় শোষিত হতো। নৈতিকতার কোনো মানদণ্ডই সমাজে কার্যকর ছিল না।

আইন ও ন্যায়বিচারের অভাব: কোনো রাষ্ট্রীয় বা একক আইন ছিল না। গোত্রপ্রধানের সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। ন্যায়বিচারের পরিবর্তে শক্তিশালীর শাসন চলত। দুর্বল শ্রেণি সব সময় বঞ্চিত হতো এবং তাদের অধিকার কেউ রক্ষা করত না। ফলে সমাজে শোষণ ও অন্যায় চরম আকার ধারণ করেছিল।

অর্থনৈতিক বৈষম্য: ধনী ও গরিবের মধ্যে ছিল তীব্র বৈষম্য। সুদ ছিল অর্থনীতির প্রধান মাধ্যম। যা গরিবকে নিঃশেষ করে দিত। ধনীরা ক্রমশ ধনী হয়ে উঠত। আর গরিবেরা আরও নিপীড়িত হতো। বাণিজ্য, চাষাবাদ ও শ্রমের সুফল সমাজের একশ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল।

প্রতিহিংসাপরায়ণতা: সামান্য ঘটনা থেকেও বড় বড় যুদ্ধ লেগে যেত। গোত্রীয় রেষারেষি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলত। প্রতিহিংসার কারণে হাজার হাজার প্রাণহানি হতো। এসব দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ইতিহাসে ‘আয়্যামুল আরব’ নামে পরিচিত।

‘জোর যার, মুলুক তার’: জাহিলি যুগের সমাজে বিরাজ করত এক অন্ধাচারের নিয়ম—‘জোর যার, মুলুক তার।’ ক্ষমতা যার হাতের মুঠোয়, নীতি ও আইনও তার ইচ্ছার দিকে বাঁক নিত। মানুষের রক্তের মূল্য ছিল পানির চেয়ে সস্তা। প্রতিদিন ছিল হানাহানি, মারামারি, রক্তপাত—নিত্যনৈমিত্তিক শোকাবহ দৃশ্য। কেউ জানত না, কেন তাকে হত্যা করা হচ্ছে। আর কার অনুপযুক্ত রোষের শিকার তাকে হতে হলো।

সেই সময়ের সমাজ চলত ক্ষুধা ও প্রতিশোধের তাগিদে। যুদ্ধে বিজয়ীর ইচ্ছে ছিল ন্যায়ের বিকল্প।

আলোকবর্তিকার আগমন: এই অন্ধকারে এসে দীপ্তি হয়ে প্রকাশিত হলো নবী মুহাম্মদ (সা.)। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত তিনি, পৃথিবীর আলোকবর্তিকা রূপে। যিনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনলেন। কেবল কোরআনের আলোকেই নয়, তাঁর জীবন ও চরিত্রের মাধ্যমে তিনি সমাজে ন্যায়, মানবিকতা ও সদাচারের বীজ বপন করলেন।

রাসুল (সা.)-এর শিক্ষা প্রতিটি অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হয়ে উঠেছিল। তিনি মূর্তিপূজার চূর্ণ করে গড়ে তোলেন আল্লাহর একত্ববাদের দালান। নারীর দিলেন তার প্রাপ্ত মর্যাদা। কন্যাশিশুর অধিকার নিশ্চিত করলেন। সামাজিক অসংগতি, সুদ ও লুণ্ঠন বিলুপ্ত করে প্রতিষ্ঠা ন্যায় ও ইনসাফ। প্রতিহিংসা, রক্তক্ষয় ও জুলুমের সংস্কৃতিকে নিন্দা জানিয়ে, মানবতার প্রতি দয়া, ক্ষমা ও ন্যায়ের পথ প্রদর্শন করলেন।

রাসুল (সা.)-এর প্রতিরোধ ছিল কেবল তাত্ত্বিক ছিল না, বরং তিনি জীবনের প্রতিটি ধাপে তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। তিনি নিজেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিশ্ববাসীকে দেখালেন যে সত্য, ধৈর্য ও ন্যায়ের পথে চললে অন্ধকার দূর হয় এবং সমাজকে আলোর দিকে নেওয়া যায়।

জাহিলি যুগের সব অমানবিক প্রথা, কুসংস্কার ও শোষণ তিনি একে একে দূর করে দিয়ে মানুষের হৃদয়ে ইমানের আলো জ্বালিয়েছিলেন।

ফলে জাহিলি যুগের অন্ধকার যতই ঘনঘন হোক, রাসুল (সা.)-এর আলোর দীপ্তি তা ছাপিয়ে গিয়েছে। তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা আজও মানুষের জীবনকে আলোকিত করে চলছে। তাঁর জ্ঞানের আলোতে দূর হয়েছে সহস্র কালব্যাপী জমে থাকা আঁধার। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

লেখক: মুফতি আহমাদুল্লাহ মাসউদ, শিক্ষক: জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া, কামরাঙ্গীরচর, ঢাকা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চন্দ্রগ্রহণের সময় মুমিনের করণীয় আমল

বেতন চাইলে গৃহকর্মীদের পিস্তল দেখান সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি শামসুদ্দোহা, ৯৯৯-এ কল পেয়ে গ্রেপ্তার

চন্দ্রগ্রহণ চলছে, ব্লাড মুন দেখা যাবে রাত সাড়ে ১১টায়

শেখ হাসিনার শত্রু ছিলাম, তাঁকে বের করেছি, তাঁর ভাগনির চাকরি খেয়েছি: ববি হাজ্জাজ

তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং: বিমানের সঙ্গে থাকবে বিদেশি কোম্পানি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত