Ajker Patrika

মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা

জাহিদ হাসান
মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা

হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেবল একটি নতুন ধর্মীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি ছিল প্রাক্‌-ইসলামিক আরবের গোত্রীয় সংঘাত ও নৈরাজ্যের বিপরীতে এক সুসংগঠিত, একত্ববাদী এবং সাংবিধানিক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন। তাঁর নেতৃত্বের কৌশল ছিল গভীর দূরদর্শিতা, নৈতিক কর্তৃত্ব এবং কার্যকর কূটনীতির এক অনন্য সমন্বয়, যা আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সামরিক কৌশল ও বিপ্লবী চেতনার জন্য আজও অনুকরণীয়।

নবীজি (সা.) শুধু ধর্ম সংস্কারক বা ধর্মপ্রচারকই ছিলেন না; তিনি ছিলেন তৎকালীন আরবের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়ক, ন্যায়পরায়ণ বিচারক, সফল সামরিক নেতা এবং দূরদর্শী কূটনীতিক। তিনি আরবের বিচ্ছিন্ন ও খণ্ড খণ্ড সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে এমন এক আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, যা কেবল সপ্তম শতকেই নয়, আধুনিক যুগেও তা নজিরবিহীন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ, সামরিক নেতৃত্বে ছিলেন এক অকুতোভয় সেনাপতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক দূরদর্শী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।

মহানবী (সা.)-এর রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়েছিল নবুওয়াত প্রাপ্তির বহু আগেই, তাঁর নৈতিক কর্তৃত্বের ভিত্তিতে। তাঁর নেতৃত্বের প্রথম নিদর্শন হিসেবে ফুটে ওঠে হিলফুল ফুজুল নামের একটি সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। কিছু সামাজিক সংস্কারের লক্ষ্যে তিনি আরবের সচেতন যুবকদের নিয়ে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত আরব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও অন্যায় অবিচার দূরীকরণই ছিল হিলফুল ফুজুলের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

রাসুল (সা.)-এর এই নৈতিক মূল্যবোধই তাঁকে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা এনে দিয়েছিল। যেমন, কাবা ঘরের সংস্কারের সময় হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে কুরাইশ গোত্রগুলোর মধ্যে যখন চরম বিরোধ দেখা দেয় এবং রক্তপাতের আশঙ্কা তৈরি হয়, তখন তারা সর্বসম্মতভাবে তাঁকে বিচারক হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর কুরাইশরা শতভাগ আস্থা রেখেছিল। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে তিনি প্রাক্‌-নবুওয়াতি যুগ থেকেই একজন নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী এবং ন্যায় বিচারক হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর এই সর্বজনীন ন্যায়পরায়ণতার স্বীকৃতি পরবর্তী সময়ে মদিনায় ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক বৈধতার ভিত্তি স্থাপন করে।

৪০ বছর বয়সে রাসুল (সা.) নবুওয়াত প্রাপ্তির পর, মক্কায় গোপনে তাওহিদের দাওয়াত দিয়ে বিচ্ছিন্ন আরব সমাজকে আল্লাহর একত্ববাদের ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন। পরে তিনি যখন প্রকাশ্যে তাওহিদের দাওয়াত দিতে শুরু করেন, তখন মক্কার পরিবেশ তাঁর ও তাঁর সাথিদের জন্য এক প্রতিকূল পরিবেশে রূপান্তরিত হয়। তাঁদের ওপর নেমে আসে অমানবিক অত্যাচার, যা পরে মুসলমানদের মদিনায় হিজরতের দিকে ধাবিত করে। হিজরত কেবল ধর্মীয় আশ্রয় গ্রহণ ছিল না, বরং এটি ছিল মক্কার গোত্রীয় ক্ষমতার বাইরে গিয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রথম কৌশলগত পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়েই মুহাম্মদ (সা.) স্বাধীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে ওঠেন।

মদিনায় হিজরতের পর তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ ছিল মদিনার সনদ প্রণয়ন, যা ইতিহাসের প্রথম লিখিত রাজনৈতিক চুক্তি ও প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে পরিচিত। এই মদিনার সনদই ছিল মদিনায় স্বাধীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি। ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে প্রণীত এই সনদ মদিনার মুসলমান, ইহুদি এবং পৌত্তলিকদের একত্র করে একটি সাধারণ জাতি গঠনে সহায়তা করেছিল। এই সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো একটি কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপন। এই সংবিধানের ভিত্তিতে ঘোষণা করা হয় যে মুহাম্মদ (সা.) হবেন নবগঠিত এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান। এই ধারা মদিনার নবগঠিত রাষ্ট্রকাঠামো এবং ক্ষমতাকাঠামোর কেন্দ্রবিন্দুতে তাঁর অবস্থানকে আইনি বৈধতা দান করে।

মদিনা সনদে সব সম্প্রদায়কে স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল, যেখানে কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এমনকি ইহুদিদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করার আইনি নিশ্চয়তা লাভ করে। এর মাধ্যমে ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে রাষ্ট্রীয় নাগরিকত্বের ধারণা প্রবর্তন করা হয়। মদিনা সনদের মাধ্যমে মদিনা রাষ্ট্রে এক যৌথ প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। সনদের ধারা অনুযায়ী, কোনো গোত্র বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে চুক্তিবদ্ধ গোত্রগুলোর সম্মিলিত শক্তি দিয়ে শত্রু প্রতিহত করবে ও মদিনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং চুক্তিবদ্ধ সব গোত্র যুদ্ধের ব্যয়ভার গ্রহণ করবে।

রাসুল (সা.)-এর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা সব থেকে বেশি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বৈদেশিক নীতি, আন্তগোত্রীয় সম্পর্ক নির্ধারণের মধ্য দিয়ে। যেখানে তিনি সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখিয়েছেন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সম্মান করেছেন। তাঁর অন্যতম বৃহৎ কূটনৈতিক সাফল্য হলো হুদাইবিয়ার সন্ধি, যা পবিত্র কোরআনে ফাতহুম মুবিন নামে পরিচিত। এই সন্ধির মাধ্যমে মক্কার কুরাইশরা মদিনার রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। এই রাজনৈতিক স্বীকৃতি মুহাম্মদ (সা.)-এর রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এই সন্ধি রাসুল (সা.)-এর কূটনৈতিক প্রজ্ঞার এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।

হুদাইবিয়ার সন্ধির পর যখন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়, মুহাম্মদ (সা.) তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে পত্র দিয়ে ইসলামের বাণীকে বিশ্ব-দরবারে তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছিলেন। যার কারণে ইসলাম আরবের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে তাঁর সামরিক কৌশলগত নেতৃত্বের ফলাফল হিসেবে মক্কা বিজয় হলো এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মক্কা বিজয়ের পর তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এই ক্ষমাশীল ব্যক্তিত্ব তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সুউচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...