Ajker Patrika

ডেঙ্গুর প্রকোপ: উদ্বেগ বাড়লেও মোকাবিলা গতানুগতিক

  • কার্যকর প্রতিরোধ এবং ব্যবস্থাপনাই মোকাবিলা করার মূল উপায়।
  • মৃত্যু না কমলে বুঝতে হবে ব্যবস্থাপনার ঘাটতি: বিশেষজ্ঞ।
  • রোগীর প্রকৃত সংখ্যা হতে পারে সরকারি হিসাবের ১০ গুণ।
  • জরুরি সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করার পরামর্শ।
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮: ১৪
দেশজুড়ে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। চলতি বছর আক্রান্তের হার ও মৃত্যুর সংখ্যাও আগের তুলনায় বেড়েছে। রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ডিএনসিসি হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে রোগীদের ভিড়। ছবি: আজকের পত্রিকা
দেশজুড়ে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। চলতি বছর আক্রান্তের হার ও মৃত্যুর সংখ্যাও আগের তুলনায় বেড়েছে। রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ডিএনসিসি হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে রোগীদের ভিড়। ছবি: আজকের পত্রিকা

এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম দিকে এর বিস্তার মূলত নগরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকলেও গত পাঁচ বছরে কম-বেশি দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বব্যাপী গণপরিসরে কার্যকর প্রতিষেধক না থাকায় রোগী ও মৃত্যুহার কমানোর একমাত্র উপায় কার্যকর প্রতিরোধ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা। কিন্তু রোগটি জনস্বাস্থ্যে গুরুতর উদ্বেগের কারণ হলেও এর প্রতিরোধে সরকার এখনো গতানুগতিক ব্যবস্থার বাইরে যেতে পারেনি।

ডেঙ্গু ভাইরাস রোগ বহুদিন ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে বিদ্যমান। বিশ্বের প্রথম ডেঙ্গু মহামারি রেকর্ড করা হয় ১৭৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায়। ১৯৫০-এর দশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনে এর সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ১৯৬৩ সালে ভারতের কলকাতায় এবং ১৯৬৪ সালে ঢাকায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। সে সময় রোগটিকে স্থানীয়ভাবে ‘ঢাকা ফিভার’ নামে অভিহিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে সরকারিভাবে ডেঙ্গু-সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ শুরু হয়। এতে রোগটি দেশে রোগতাত্ত্বিকভাবে বিশেষ গুরুত্ব পেতে থাকে। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়েও ডেঙ্গু মোকাবিলায় দক্ষ ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি।

সরকারের তথ্য বলছে, দেশে বিভিন্ন সময় ডেঙ্গু সংক্রমণের মাত্রা ও মৃত্যুর সংখ্যা ওঠানামা হয়েছে। প্রথম দিকে মূলত ঢাকা মহানগরে সীমিত থাকলেও ২০১৯ সালে অন্যান্য শহর ও গ্রামেও এটি ছড়িয়ে পড়ে। ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে দেশে সাড়ে ১৯ হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এবং ২২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ধীরে ধীরে একটা পর্যায়ে ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সোয়া ১ লাখ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ২৩১ জনের মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালে দেশে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংক্রমণ দেখা দেয়। সে বছর সোয়া ৩ লাখ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ১ হাজার ৭০৫ জন মারা যায়। ২০২৪ সালে ১ লাখের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ৫৭৫ জনের মৃত্যু হয়। চলতি বছরের শুরু থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৮২ জন মারা গেছে। এ সময়ে সারা দেশে ৪৩ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। গত আড়াই দশকে দেশে ডেঙ্গুতে অন্তত ৩ হাজার ৩২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে ডেঙ্গুর যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হচ্ছে, তা নির্দিষ্ট কয়েকটি হাসপাতালের তথ্যের ওপর নির্ভরশীল। ফলে যেসব রোগী বাসাতেই চিকিৎসা নেয় বা ডেঙ্গু হওয়ার কথা আদৌ জানেও না, তাদের সংখ্যা এতে অন্তর্ভুক্ত নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে ডেঙ্গু রোগীর প্রকৃত সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে ১০ গুণ বেশি হতে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ায় জাতীয়ভাবেই তা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন, দীর্ঘ সময় ধরে কোনো দেশে একটি রোগে মৃত্যুর হার না কমার অর্থ হচ্ছে রোগী ও রোগ ব্যবস্থাপনার ঘাটতি রয়েছে। মশা নিয়ন্ত্রণ ডেঙ্গু মোকাবিলা কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশার জীবনচক্র বোঝা ছাড়া কেবল ফগিং করে মশা তাড়ানো কার্যকর হচ্ছে না। মশা যেখানে ডিম পাড়ে, সে স্থানেই কীটনাশক প্রয়োগ এবং পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি।

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. গোলাম ছারোয়ার এ বিষয়ে বলেন, মশা মারার আগে তার জীবনচক্র, প্রজনন ও অবস্থান বোঝা দরকার। স্যানিটেশন ও পানি ব্যবস্থাপনা ঠিক না থাকায় মশার ডিম পাড়ার স্থান বাড়ছে। শুধু ফগিং করে মশা তাড়ালে তা কার্যকর হবে না। আবার দীর্ঘদিন একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে মশা তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ওষুধ প্রয়োগের পর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ না করলে তার কার্যকারিতা বোঝা যায় না।

কীটতত্ত্ববিদ মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে রোগী ও তার অবস্থান শনাক্ত করে (কন্ট্রাক ট্রেসিং) সেই এলাকার মশা নির্মূলের ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এটি মশা নির্মূলের সঙ্গে সমন্বিত না হওয়ায় রোগী যেখানে আক্রান্ত, সেখানে মশা বেঁচে থেকে বংশবিস্তার করে। এটি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে আরও জটিল করে তোলে।

পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (ইলেকট) অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, শুরু থেকেই সমন্বিত উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার বিভাগের হলেও তাদের কার্যক্রম মূলত ফগিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। রোগীর ওপর কার্যকর নজরদারি হয় না। রোগী বাড়লে মৃত্যুও বাড়বে। তাই রোগীর সংখ্যা কমাতে সমন্বিত চেষ্টা নিতে হবে। জনগণের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

সরকারকে ডেঙ্গু জনস্বাস্থ্যের জরুরি সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘সরকার এখনো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গতানুগতিক পদক্ষেপ নিচ্ছে না। জরুরি সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করা হলে দায় এড়ানোর প্রবণতা থাকবে না এবং সমন্বিতভাবে কাজ করা সম্ভব হবে। আমাদের সামনে কোভিড মডেল রয়েছে। এতে অর্থ বরাদ্দেও সমস্যা হবে না।’

ডা. মুশতাক বলেন, পরীক্ষার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে কাজে লাগানো জরুরি। পর্যবেক্ষণযোগ্য রোগীদের মাধ্যমিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেখে তাদের মধ্য থেকে সংকটাপন্নদের দ্রুত তৃতীয় পর্যায়ে পাঠাতে হবে। রোগী, এডিস লার্ভা এবং কীটনাশকের সার্ভিল্যান্স সমন্বিতভাবে হচ্ছে না। অঞ্চলভিত্তিক রোগতাত্ত্বিক নজরদারিও নেই। বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার এখন বিশ্বের মধ্যে বেশি। যেসব দেশ মৃত্যুহার কমাতে পেরেছে, তারা রোগতত্ত্বকেই গুরুত্ব দিয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

স্পিকারের বাসভবনই হবে প্রধানমন্ত্রীর অস্থায়ী আবাস

ঘরে সদ্য বিবাহিত বিক্রয় প্রতিনিধির লাশ, চিরকুটে লেখা ‘জীবন খুবই কঠিন’

জাতীয় সংসদ নির্বাচন: আলোচনায় আসনের ভাগ

নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করেও মুখে দুর্গন্ধের কারণ, পরিত্রাণের উপায়

২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর হাইস্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা নয়: শিক্ষা মন্ত্রণালয়

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত