Ajker Patrika

তীব্র গরমে অর্থনীতিতে বছরে ক্ষতি ২১ হাজার কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
তীব্র গরমে অর্থনীতিতে বছরে ক্ষতি ২১ হাজার কোটি টাকা
ফাইল ছবি

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে ক্রমেই বায়ুর তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। এতে তীব্র গরমে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন বাড়ছে, তেমনি অর্থনীতির জন্যও তা মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে তাপজনিত অসুস্থতায় প্রায় ২৫ কোটি কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। এতে দেশের অর্থনীতিতে ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে এক অনুষ্ঠানে ‘অ্যান আনসাসটেইনেবল লাইফ: দ্য ইমপ্যাক্ট অব হিট অন হেলথ অ্যান্ড দ্য ইকোনমি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অপারেশনস অফিসার ইফফাত মাহমুদ এবং সিনিয়র হেলথ স্পেশালিস্ট ওয়ামেক এ. রাজা। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান, বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের ডিভিশনাল ডিরেক্টর জাঁ পেসমে, সাউথ এশিয়া হেলথ নিউট্রিশন অ্যান্ড পপুলেশন প্র্যাকটিসের প্র্যাকটিস ম্যানেজার ফেং ঝাও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।

অনুষ্ঠানে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ‘বাড়তে থাকা তাপমাত্রা এখন আর কোনো তাত্ত্বিক বিষয় নয়, বরং বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের বাস্তব অভিজ্ঞতা। তাপমাত্রা বৃদ্ধি একটি বৈশ্বিক ঘটনা হলেও এর প্রভাব বাংলাদেশে অনেক বেশি তীব্র, যা আমাদের জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।’

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কেবল গবেষণা প্রতিবেদনে সীমাবদ্ধ না থেকে সুপারিশগুলোকে সময়সীমাবদ্ধ কর্মপরিকল্পনায় রূপ দিতে হবে। প্রতিটি সংস্থাকে নিজ নিজ ভূমিকা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হবে এবং জাতীয় পর্যায়ের অংশীদারদের দায়িত্ব নিতে হবে, যাতে সুপারিশগুলো কার্যকর পদক্ষেপে পরিণত হয়।

জলবায়ু সহনশীলতার সঙ্গে সুশাসন ও নাগরিক আচরণের পরিবর্তনের সম্পর্কের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘গঠনমূলক সংস্কারের পাশাপাশি আমাদের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও দরকার। ছোট ছোট পদক্ষেপ; যেমন অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ব্যবহার কমানো—বড় প্রভাব ফেলতে পারে। সবুজ নগর মানেই সুস্থ জীবন।’

বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৮০ সাল থেকে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর ‘অনুভূত তাপমাত্রা’ বেড়েছে ৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি। এর ফলে ডায়রিয়া, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি ও বিষণ্ণতার মতো শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে; বিশেষ করে নারীরা গরমজনিত অসুস্থতায় বেশি ভোগেন। গ্রীষ্মকালে ডায়রিয়া ও দীর্ঘস্থায়ী কাশি শীতকালের তুলনায় দ্বিগুণ হয়।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যখন তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়, তখন কর্মীদের উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। ফলে শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয় এবং অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, গরমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাজধানী ঢাকা। এখানে তাপের প্রভাব জাতীয় গড়ের তুলনায় ৬৫ শতাংশ বেশি। এ কারণে উচ্চ তাপমাত্রাজনিত ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। নারীরা গরমজনিত অসুস্থতায় বেশি ভোগেন, ফলে হিট স্ট্রোকসহ ক্লান্তি বোধ করেন। গরমকালে ডায়রিয়া ও কাশি শীতের তুলনায় দ্বিগুণ হয়।

প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জ্যাঁ পেসমে বলেন, ‘তীব্র গরম শুধু মৌসুমি সমস্যা নয়। এটি আমাদের স্বাস্থ্য, উৎপাদনশীলতা ও অর্থনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। সঠিক নীতি ও বিনিয়োগের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব।’ এ ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দেন তিনি।

প্রতিবেদনে তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় সমন্বিত জাতীয় প্রস্তুতি, স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ উদ্যোগ, শহরে সবুজ এলাকা তৈরি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

ইফফাত মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গরমে স্বাস্থ্যগত অবনতি ও উৎপাদনশীলতা কমার মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র আছে। বাংলাদেশ মানবসম্পদ ও উৎপাদনশীলতা হারানোর প্রকৃত ঝুঁকির মুখে।’

বিশ্বব্যাংক জানায়, বাড়তি তাপমাত্রার কারণে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হতাশা ক্রমেই বাড়ে, অন্যদিকে ৫০ থেকে ৬৫ বছর বয়সীদের মধ্যে উদ্বেগ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। শীতকালের তুলনায় গ্রীষ্মকালে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থার কারণে উৎপাদনশীলতা কমে যায়।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর মানুষ কাজ হারাচ্ছেন। এর প্রভাব গ্রীষ্মকালে বেশি। গড় হিসাবে গ্রীষ্মে শারীরিক অসুস্থতায় কাজ না করার দিন ১ দশমিক ৪ এবং শীতে ১ দশমিক ২ দিন। মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে গ্রীষ্মে কাজ হারানোর দিন দাঁড়ায় ২ দশমিক ৩, যা শীতকালে ১ দশমিক ৯ দিন।

পুরুষদের তুলনায় নারীরা কম দিন কাজ হারালেও ৩৬ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। এ বয়সীরা গ্রীষ্মে শারীরিক কারণে গড়ে ১ দশমিক ৭ দিন ও মানসিক কারণে আড়াই দিন কাজ হারিয়েছেন। তরুণদের (১৬-৩৫ বছর) ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যার প্রভাব তুলনামূলক বেশি।

আয়ের দিক থেকে দেখা যায়, কম আয়ের মানুষদের কাজ হারানোর দিন বেশি। গ্রীষ্মে তাঁরা গড়ে ১ দশমিক ৭ দিন কাজ করতে পারেননি, যেখানে ধনীরা হারিয়েছেন ১ দশমিক ১ দিন। কাজের ধরনে পার্থক্যও চোখে পড়ে। শারীরিক কারণে অদক্ষ শ্রমিকদের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি (গ্রীষ্মে ১ দশমিক ৮ দিন)। আর মানসিক সমস্যায় দক্ষ শ্রমিকেরা গড়ে ২ দশমিক ৯ দিন কাজ হারিয়েছেন। অফিসকর্মীদের ক্ষতি তুলনায় কম।

বিশ্বব্যাংক কিছু সুপারিশ তুলে ধরে বলছে, তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় সমন্বিত জাতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা জরুরি। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে গরমজনিত রোগ মোকাবিলা করা, শহরে সবুজ এলাকা তৈরি, সঠিক আবহাওয়া ও স্বাস্থ্যতথ্য সংগ্রহ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আর অর্থায়নের মাধ্যমে প্রতিরোধ ও অভিযোজনমূলক পদক্ষেপ জোরদার করা প্রয়োজন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‎ডিভোর্সের পরও জোর করে রাতযাপন, বর্তমান স্বামীকে নিয়ে প্রাক্তন স্বামীকে হত্যা ‎

৯ পুলিশ পরিদর্শক বাধ্যতামূলক অবসরে

গণবিক্ষোভ আতঙ্কে মোদি সরকার, ১৯৭৪-পরবর্তী সব আন্দোলন নিয়ে গবেষণার নির্দেশ

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের ‘সন্ত্রাসী খেল’ ফাঁস করে দিলেন জঙ্গিগোষ্ঠী জইশের সদস্য

নিজের বিচারের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি কলেজশিক্ষকের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত