Ajker Patrika

সুন্দরবনে ফের তৎপর দস্যুরা, ভয়ে পেশা বদল বনজীবীদের

  • ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনকে বনদস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়।
  • গত বছরের ৫ আগস্টের পর ফের বেপরোয়া হয়ে ওঠে বনদস্যুরা।
  • সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে সতর্ক অবস্থায় রয়েছি: পুলিশ
  • বন বিভাগ বলছে, তাদের অস্ত্র ও জনবল সংকট।
আবুল কাসেম, সাতক্ষীরা 
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

নজরদারির অভাবে সুন্দরবনে আবারও বেড়েছে বনদস্যুদের তৎপরতা। বনের ২০টি পয়েন্টে বেপরোয়া ১০টি বাহিনী। জেলে ও বাওয়ালিদের জিম্মি করে এই বাহিনীর সদস্যরা লাখ লাখ টাকা আদায় করছে। মুক্তিপণ ছাড়া মিলছে না কারও মুক্তি। চলে নির্যাতনও। আতঙ্কিত বনজীবীদের অনেকেই ভয়ে পেশা বদলাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে জনবল ও অস্ত্র সংকটের কথা বলছে বন বিভাগ।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সাল থেকে কয়েক ধাপে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ সদস্য ৪৬২টি অস্ত্র, ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিল। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনকে বনদস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর দীর্ঘদিন সুন্দরবন দস্যুমুক্ত ছিল। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বনদস্যুরা। মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পাওয়া জেলেদের কাছ থেকে জানা যায়, ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে সাতক্ষীরা রেঞ্জের ভারত সীমান্তবর্তী মারডাঙ্গা ও হরিণটানা খাল থেকে ছয়জনকে অপহরণ করে জলদস্যুরা। পরে ২০ হাজার টাকা করে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান তাঁরা।

ভুক্তভোগী শ্যামনগরের টেংরাখালী গ্রামের আতাউর রহমান বলেন, ‘আমাদের ছয়জনকে অপহরণ করে মুন্না বাহিনীর দস্যুরা। এরপর আমাদের মুক্তির জন্য ৫০ হাজার টাকা করে দাবি করে। অপারগতা দেখালে বেধড়ক পেটায়। আমার আঙুল ভেঙে গেছে। সারা দিনে একবার অল্প একটু খাবার জুটত। অবশেষে ২০ হাজার টাকা দিয়ে ফিরে এসেছি। এখন আমি সুন্দরবনে যেতে পারছি না, আবার ডাক্তার দেখাতেও পারছি না।’

আরেক অপহৃত রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘অপহরণের দুই দিন পর আমার মহাজনের মাধ্যমে বাড়িতে সিম পাঠিয়ে দেয় দস্যুরা। বাড়িতে তো এক কানাকড়িও ছিল না। বিভিন্ন জায়গা থেকে সুদ করে টাকা গুছিয়ে আমার স্ত্রী ২০ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। এরপর আমি মুক্তি পাই।’ দস্যুদের মধ্যে ভারতের চারজন ও তাঁদের এলাকার দুজন ডাকাত রয়েছে বলে দাবি রাশেদুলের।

স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে জানা যায়, গত এক বছরে শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও আশাশুনি উপজেলার তিন শতাধিক জেলে অপহৃত হয়েছেন। সর্বশেষ শিকার হয়েছেন সুন্দরবনসংলগ্ন টেংরাখালী ও ভেটখালী এলাকার বাসিন্দারা। এর আগে দুবলারচরের বাহির সমুদ্রের ৮ নম্বর বয়া এলাকা থেকে ১৫ জেলেকে মুক্তিপণের দাবিতে জিম্মি করে জলদস্যুরা। এর মধ্যে ৯ জনেরই বাড়ি আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরে। ১৭ দিন পর জনপ্রতি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা মুক্তিপণ নিয়ে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ এলাকায় চোখ বাঁধা অবস্থায় ছাড়া পান তাঁরা। সূত্র জানিয়েছে, সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের আন্ধারমানিক, আড়পাঙ্গাসিয়া, শিবসা, মান্ধারখালী, হরিণটানাসহ কমপক্ষে ২০টি পয়েন্টে শরীফী, মজনু, রবিউল, সাগর, মুন্না, দুলাভাই, মঞ্জুর বাহিনীসহ কমপক্ষে ১০টি বাহিনী চষে বেড়াচ্ছে।

পর্যটক গাইড গোলাম মোস্তফা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার অভাবে বছরখানেক ধরে সুন্দরবনে দস্যুদের তৎপরতা বেড়েছে। পর্যটকেরা ডাকাত-আতঙ্কে রয়েছেন।

শ্যামনগরের টেংরাখালী এলাকার বাসিন্দা কমলা দাশ বলেন, ‘আমরা যারা কাঁকড়া ধরতে যাই, তারা রাত হলে ভয়ে থাকি। একদিকে বাঘের ভয়, নদীতে কুমিরের ভয়, অন্যদিকে ডাকাতের ভয়। কোনভাবে আমরা থাকব। তাই বাঁচতে নৌকায় থাকি। সাত দিনের পাস দিলে চলে আসি। এত সাবধানেও মাঝে মাঝে ডাকাতদের কবলে পড়তে হচ্ছে। তাই এখন বনে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছি।’

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. রনি খাতুন জানান, জেলা ও উপজেলা আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সভায় বনদস্যুদের তৎপরতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সভায় উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুকিত হাসান খান বলেন, ‘সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে পুলিশ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা ডাকাতদের বিষয়ে তথ্য দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছি। অনেক ডাকাত সম্পর্কে তথ্য পেয়েছি। কয়েকজনকে আটক করেছি। ডাকাতদের মুক্তিপণ পরিশোধ করতে হয় যেহেতু মানি ট্রান্সফার বিকাশের মাধ্যমে, তাই উপকূলীয় এলাকার বিকাশ এজেন্টদের নিয়ে সভা করেছি। সব মিলিয়ে আমরা সুন্দরবনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করার জন্য অপরাধমূলক কার্যকলাপ বন্ধের বিষয়ে কাজ করছি।’

সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা ফজলুর রহমান বলেন, ‘বন বিভাগের জনবল ও অস্ত্র সংকট রয়েছে। সীমিত সামর্থ্য নিয়ে আমরা আমাদের এরিয়ায় ৪০০ খালসহ বিশাল এলাকাকে সুরক্ষিত রাখতে কাজ করছি। কিন্তু যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁরা আমাদের কাছে কোনো তথ্য দেন না। সীমান্ত নদী রায়মঙ্গলসহ অন্যান্য খাল ও নদীতে রিভারাইন বিজিবির নির্ধারিত দায়িত্ব রয়েছে। কোস্ট গার্ডেরও রয়েছে নির্দিষ্ট ম্যান্ডেট। সুতরাং সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে বন বিভাগ, কোস্ট গার্ড ও বিজিবিকে যৌথ অভিযান পরিচালনা করতে হবে, তাহলে এর সুফল আসবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত