Ajker Patrika

রাজশাহীর ৪ জেলায় পানিবন্দী সাড়ে ৬ হাজার পরিবার, বাড়ছে নদীভাঙন আতঙ্ক

রিমন রহমান, রাজশাহী 
পদ্মায় পানি বাড়ার ফলে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অনেক পরিবার। রাজশাহীর মিডিল চর থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
পদ্মায় পানি বাড়ার ফলে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অনেক পরিবার। রাজশাহীর মিডিল চর থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

নদ-নদীতে পানি বাড়ার কারণে রাজশাহী বিভাগের চার জেলায় কমপক্ষে সাড়ে ছয় হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ভাঙনের কবলে পড়েছে অনেক বাড়িঘর। আজ রোববার সকাল থেকে পদ্মা নদীর পানি কমছে। এর ফলে ভাঙন আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন নদীপাড়ের মানুষ।

বিভাগের আট জেলার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, এরপর রাজশাহী। কিছু বসতবাড়ি তলিয়েছে নাটোর ও নওগাঁয়। সরকারি হিসেবে রাজশাহীতে ১ হাজার ৭৩৭, চাঁপাইনবাবগঞ্জে সাড়ে ৪ হাজার, নাটোরে ৮০ ও নওগাঁয় ২৫ পরিবার পানিবন্দী হয়েছে। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, বাস্তবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা আরও বেশি।

সম্প্রতি পদ্মা নদীর পানি বাড়ার ফলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার দুর্লভপুর ও পাকা ইউনিয়ন তলিয়ে যায়। এ ছাড়া সদর উপজেলার নারায়ণপুর ও আলাতুলি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। এসব ইউনিয়নের অনেক বাড়িঘর ভাঙনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজাহার আলী জানান, পদ্মা নদীর পানি বাড়ার ফলে বন্যায় শিবগঞ্জের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বাড়ি প্লাবিত হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এই উপজেলায় ১ হাজার ৪০০ হেক্টর ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ১৩ টন চাল ও ৭৫ বস্তা শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের ইউএনও নুরুল ইসলাম জানান, দুই ইউনিয়নে পানিবন্দী হয়েছে দুই হাজার পরিবার। প্লাবিত হয়েছে ৬০০ হেক্টর ফসলি জমি। চাল, শুকনো খাবার ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট নিয়ে তাঁরা বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। বেসরকারি সংগঠনও এগিয়ে আসছে।

পদ্মা নদীর পানি বাড়ার কারণে রাজশাহীর বাঘা, পবা, গোদাগাড়ী ও চারঘাটের অনেক পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। গোদাগাড়ীর চর আষাড়িয়াদহ থেকে এবারও অনেক লোক তাঁদের ঘরবাড়ি ও গবাদিপশু নিয়ে এ পাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সবচেয়ে কষ্টে আছেন বাঘার চক নারায়ণপুর, পবার মিডিল চর ও চর মাজারদিয়ারের বাসিন্দারা। মিডিল চরের চারপাশ ডুবে গেছে। পানি ঢুকেছে বাড়িতে। চর মাজারদিয়ায় সবগুলো ঘরবাড়ি হাঁটুসমান কিংবা একগলা পানিতে ডুবে গেছে। ফলে অনেকে গবাদিপশু নিয়ে এ পাড়ে রাজশাহী শহরের বেতার মাঠে আশ্রয় নিয়েছেন। আর যাঁরা আসতে পারেননি, তাঁরা চরেই কোথাও একটু উঁচু জায়গা পেলে সেখানেই গবাদিপশু ও শিশুদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এই চরের বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম এখনো কোথাও যেতে পারেননি। আজ সকালে একগলা পানি মাড়িয়ে তাঁকে পাশের আরও একটি ডুবে যাওয়া বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে আসতে দেখা যায়। মনোয়ারা বেগম জানান, জন্ম থেকে তিনি এই চরেই বাস করছেন। ভাঙনের কারণে তাঁদের চারবার বাড়ি নতুন জায়গায় সরাতে হয়েছে। এবার না ভাঙলেও বাড়ি ডুবে গেছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন শুরু হয় কি না, তা নিয়ে এখন আছেন আতঙ্কে।

রাজশাহী জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুল হাই সরকার জানান, জেলায় পানিবন্দী পরিবারের সংখ্যা ১ হাজার ৭৩৭ জন। এর মধ্যে বাঘা, চারঘাট, পবা, গোদাগাড়ী ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের দুটি ওয়ার্ড রয়েছে। তাঁরা এসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ৮৫ টন চাল, নগদ ৪ লাখ টাকা ও ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করেছেন।

রাজশাহীর মিডিল চর থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
রাজশাহীর মিডিল চর থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পদ্মা নদীর পানির বিপৎসীমা ১৮ দশমিক ০৫ মিটার। এবার বাড়তে বাড়তে পানি ১৭ দশমিক ৪৯ মিটারে উঠেছিল। এরপর গতকাল শনিবার সকাল ৬টা থেকে পানি ধীরে ধীরে কমছে। আজ দুপুর ১২টায় পানির উচ্চতা ছিল ১৭ দশমিক ৩৫ মিটার।

এদিকে আত্রাই নদের পানি বাড়ার ফলে গতকাল ভোররাতে নওগাঁর মান্দা উপজেলার তালপাতিলা এলাকায় একটি বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এতে নুরুল্লাবাদ ইউনিয়নের তালপাতিলা ও উত্তর চকরামপুর গ্রামের কমপক্ষে ২০০ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে নওগাঁর রানীনগর ও আত্রাই এবং রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায়।

নুরুল্লাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জায়দুর রহমান বলেন, বাঁধের ভাঙা স্থান দিয়ে পানি ঢুকছে। এতে প্রায় ২০০ বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে। সম্প্রতি লাগানো আমন ধান ডুবে গেছে। তবে মাত্র ২৫টি পরিবারকে খাদ্যসহায়তা দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। অন্যরা সহায়তা পায়নি।

জানতে চাইলে মান্দার ইউএনও আখতার জাহান সাথী দাবি করেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা পঁচিশের বেশি নয়। তিনি বলেন, ‘এর বেশি হলে তো আমাকে জানানো হতো। আমি জানি না।’

নাটোরের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা এ কে এম শাহা আলম মোল্লা জানান, লালপুর উপজেলায় পদ্মা তীরের ৮০টি পরিবার পানিবন্দী হয়েছে। বন্যা হলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য নাটোরের সবগুলো উপজেলায় মোট ২০০ টন চাল ও নগদ ৮ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

বিভাগের সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বাড়ার ফলে চরের নিচু এলাকায় পানি ঢুকেছে। সিরাজগঞ্জের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুল বাছেদ জানান, যমুনা নদীর পানির বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৯০ মিটার। আজ সকালে বিপৎসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে যমুনার পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। বন্যা হলে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তাঁরা প্রস্তুত রয়েছেন।

বগুড়ার ত্রাণ কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন জানান, সারিয়াকান্দি উপজেলায় নিচু এলাকায় পানি ঢুকেছে। তবে ঘরবাড়ি এখনো প্লাবিত হয়নি। এখানে যমুনার পানি বিপৎসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাবনায় এখনো বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। তবে তুলসীগঙ্গা নদীর পানি বাড়ার ফলে জয়পুরহাট সদর ও আক্কেলপুর উপজেলায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুল করিম।

তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে এখনো বন্যা সৃষ্টি হয়নি। তবে তুলসীগঙ্গা নদীর পানি বাড়ার কারণে কয়েকটা বাড়ি প্লাবিত হয়েছে। নদীটা সদর উপজেলা হয়ে আক্কেলপুর গেছে। নদীতে পানি বাড়ছে। আরও পানি বাড়লে এ দুই উপজেলায় বন্যা দেখা দিতে পারে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রাকচাপায় অটোরিকশার চালকসহ নিহত ২

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে ট্রাকচাপায় অটোরিকশার চালকসহ দুজন নিহত হয়েছেন। শুক্রবার সকালে সরাইল-নাসিরনগর আঞ্চলিক সড়কের বড্ডাবাজার এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন অটোরিকশার চালক মোহাম্মদ ইউসুফ (৫০) ও যাত্রী মুসলিম মিয়া (৫২)। তাঁদের বাড়ি সদর উপজেলার মজলিশপুর ইউনিয়নের মৈন্দ গ্রামে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সকালে মুসলিম মিয়া পাইকারি সবজি কেনার জন্য ইউসুফের অটোরিকশা নিয়ে সরাইল বাজারের উদ্দেশে রওনা হন। পথে বিপরীত দিক থেকে আসা নাসিরনগরগামী একটি মাছবাহী ট্রাক অটোরিকশাটিকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই তাঁদের দুজনের মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।

এ বিষয়ে সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোরশেদুল আলম বলেন, এই ঘটনায় ট্রাক জব্দসহ ঘাতক চালককে আটক করা হয়েছে। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ঘন কুয়াশার চাদরে পঞ্চগড়: হেডলাইট জ্বালিয়ে চলছে যানবাহন

পঞ্চগড় প্রতিনিধি
পঞ্চগড় পূর্ব জলাসি সেতু থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
পঞ্চগড় পূর্ব জলাসি সেতু থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে বইছে হিমেল হাওয়া, আর ভোর থেকে চারদিক ঢেকে আছে ঘন কুয়াশার চাদরে। ঘন কুয়াশার কারণে সড়কপথে যানবাহনগুলোকে হেডলাইট জ্বালিয়ে অত্যন্ত ধীরে চলতে হচ্ছে, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় মন্থরতা এনেছে। শুক্রবার (৭ নভেম্বর) তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে সকাল ৬টা ও ৯টায় একই তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল ৯৯ শতাংশ, যার কারণে ঠান্ডা আরও বেশি অনুভূত হচ্ছে।

পঞ্চগড় করতোয়া সেতু থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
পঞ্চগড় করতোয়া সেতু থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

সকালে জেলা শহর, খেতখামার ও নদীর ধারে কুয়াশা এত ঘন ছিল যে ২০ থেকে ৩০ মিটার দূরত্বের বেশি কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। কুয়াশা ও ঠান্ডার কারণে বাজারে মানুষের উপস্থিতিও ছিল তুলনামূলক কম। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে চাদর, জ্যাকেট বা উলের শাল জড়িয়ে বাইরে বের হয়েছেন।

এমন পরিবেশে পঞ্চগড়ে পর্যটকদের আগমন বাড়তে শুরু করেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা এই জেলায় আসছেন।

টাঙ্গাইল থেকে আসা পর্যটক ইমরান বলেন, ‘পঞ্চগড়ে ঢোকার পর থেকেই কুয়াশা আর ঠান্ডা লাগছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে এসেছি, আর এই তীব্র শীত তো আমাদের জন্য বোনাস।’

রংপুর থেকে আসা শিমু আক্তার বলেন, ‘শুনেছিলাম এখানকার শীতের অনুভূতি আলাদা। এসে দেখলাম সত্যিই তাই।’

তেঁতুলিয়া আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ জিতেন্দ্রনাথ রায় জানান, উত্তর দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস নামতে শুরু করায় তাপমাত্রা কমছে। সকাল ৬টা ও ৯টার তাপমাত্রা একই রয়েছে। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা আরও কমবে এবং শীতের তীব্রতা বাড়বে বলেও জানান তিনি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

প্রায় ১৪ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ: কালিয়াকৈর পৌরসভায় দুদকের অভিযান

গাজীপুর প্রতিনিধি
গতকাল দুপুরে কালিয়াকৈর পৌরসভা কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে জেলা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল দুপুরে কালিয়াকৈর পৌরসভা কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে জেলা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ছবি: আজকের পত্রিকা

ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে গাজীপুরের কালিয়াকৈর পৌরসভা থেকে প্রায় ১৪ কোটি টাকার একাধিক উন্নয়নকাজের কার্যাদেশ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। অভিযোগের ভিত্তিতে গতকাল বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে কালিয়াকৈর পৌরসভা কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে জেলা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই তৎকালীন মেয়র মজিবুর রহমান এই কাজগুলো দিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।

অভিযানের সময় দুদকের কর্মকর্তারা পৌরসভার বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার-সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন এবং পরে তদন্ত করতে ঘটনাস্থলে যান।

কালিয়াকৈর পৌরসভা সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের এপ্রিলে আইইউজিপি প্রকল্পের চতুর্থ প্যাকেজের অধীনে ১৩ কোটি ৯২ লাখ টাকার বেশি ব্যয়ে দুটি রাস্তা নির্মাণকাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়। এই কাজের মধ্যে ছিল কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্ক, আনসার একাডেমির অভ্যন্তরীণ রাস্তা, আনসার একাডেমির ৩ নম্বর গেটের বিপরীত পাশের রাস্তা ও ড্রেন, পাশা গেটের রাস্তা, এপেক্স ওয়েভিং রাস্তা, কোহিনূর স মিলের রাস্তা এবং টান কালিয়াকৈর লালটেকির এলাকার ড্রেনসহ রাস্তা নির্মাণ।

দরপত্র আহ্বান ও কার্যাদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে কাগজপত্র যাচাই না করেই ব্রাউন ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লি. নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কাজটি না পেয়ে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা ঠিকাদার সম্প্রতি দুদকের ঢাকা কার্যালয়ে অভিযোগ দায়ের করলে অনুসন্ধানে নামে দুদক।

অভিযানে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে দুদক।

দুদকের গাজীপুর জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এনামুল হক বলেন, ‘অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। দরপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কোনো প্রমাণও পৌরসভার কর্মকর্তারা উপস্থাপন করতে পারেননি।’

এনামুল হক জানান, পৌর কর্মকর্তাদের দুই দিন সময় দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপন করতে না পারলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দুদকের গাজীপুর জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক নাজমুল হোসাইন বলেন, ‘কালিয়াকৈর পৌরসভার প্রকল্পে ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে টেন্ডার বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পেয়ে আমাদের টিম অভিযান চালায়। আমরা রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেছি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আরও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কালিয়াকৈর পৌরসভার প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাওসার আহমেদ বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগের বিষয়ে দুদকের একটি টিম পৌরসভার কয়েকটি প্রকল্পের টেন্ডার নিয়ে এক ঠিকাদারের অভিযোগ তদন্ত করেছে। আমরা তাদের চাহিদামতো প্রয়োজনীয় তথ্য ও কাগজপত্র দিয়ে সহযোগিতা করেছি।’

জানা গেছে, মজিবুর রহমান কালিয়াকৈর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। তিনি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি আওয়ামী লীগের তিন আমলে পৌর মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন। হাসিনার ফ্যাসিবাদী আমলে যেখানে বিএনপি নেতারা জেল-জুলুমের শিকার হয়েছিলেন, সে সময় মজিবুর ছিলেন রাজার হালতে। সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সঙ্গে ছিল তাঁর দহরম-মহরম সম্পর্ক। স্থানীয় বিএনপি নেতারা তাঁকে মোজাম্মেল হকের ‘পুত্র’ বলে ডাকেন। মোজাম্মেল হকের ছায়ায় কালিয়াকৈরের সবই ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে। টেন্ডার-বাণিজ্য, ঝুট-বাণিজ্য, ভুয়া প্রকল্পের নামে সরকারি অর্থ লোপাট, জনবল নিয়োগে অনিয়ম, বনের জমি জবরদখল করে শিল্পকারখানায় বিক্রি করে দুই হাতে কামিয়েছেন টাকা। গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। কালিয়াকৈরে গড়েছেন আটটি বহুতল ভবন ও আলিশান বাড়ি। এ ছাড়া রাজধানী ও বিদেশেও রয়েছে ফ্ল্যাট-বাড়ি। চতুর মজিবুর বেশির ভাগ সম্পদ করেছেন স্ত্রী আজমেরি বেগম, নিকটাত্মীয় ও অনুসারীদের নামে।

সূত্র জানায়, এর আগে গত ৫ জানুয়ারি স্ত্রী-সন্তান ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের নামে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও কালিয়াকৈর পৌরসভার মেয়র মজিবুর রহমানকে তলব করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে পরে সবকিছু চাপা পড়ে যায়।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য কালিয়াকৈর পৌরসভার সাবেক মেয়র মজিবুর রহমানের মোবাইলে একাধিকবার কল করলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

হবিগঞ্জের প্রান্তিক এলাকায় ‘আইসিবিসি’ প্রকল্পের আলো: শিশুরা সুরক্ষিত, নিশ্চিন্ত কর্মজীবী মা

সহিবুর রহমান, হবিগঞ্জ 
শিশু যত্নকেন্দ্রে এভাবেই শিশুদের পাঠদান ও সুরক্ষা দেওয়া হয়। ছবি: আজকের পত্রিকা
শিশু যত্নকেন্দ্রে এভাবেই শিশুদের পাঠদান ও সুরক্ষা দেওয়া হয়। ছবি: আজকের পত্রিকা

সকাল থেকে দুপুর—দিনের এই কর্মব্যস্ত সময়ে শিশুদের দেখভাল ও সুরক্ষা নিয়ে সব মা-বাবাকে চিন্তায় থাকতে হয়। তখন নারী-পুরুষ সবাই পেশাগত ও গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, তখন ঘরের শিশুটি খেলতে খেলতে সবার অগোচরে একসময় ডোবানালায় পড়ে যায়। হবিগঞ্জ জেলায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনাগুলোর কারণ অধিকাংশ এমনই। তবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশু যত্নকেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং সাঁতার সুবিধা প্রদান (আইসিবিসি) প্রকল্প’-এর কারণে হবিগঞ্জের প্রান্তিক এলাকার গল্প এখন ভিন্ন। এই প্রকল্পের শিশু যত্নকেন্দ্রগুলো গ্রামীণ নারীদের কর্মব্যস্ত জীবনে স্বস্তি এনে দিয়েছে।

হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল, মাধবপুর ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার প্রান্তিক এলাকায় প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি এনজিও সংস্থা ‘নতুন প্রজন্ম উদ্যোক্তা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে শিশু যত্নকেন্দ্র ও জীবন রক্ষাকারী সাঁতার প্রশিক্ষণ।

শিশু যত্নকেন্দ্রে খেলাধুলায় মেতে উঠেছে শিশুরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
শিশু যত্নকেন্দ্রে খেলাধুলায় মেতে উঠেছে শিশুরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

জানা যায়, হবিগঞ্জের বাহুবল, মাধবপুর ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় এই প্রকল্পের অধীনে ৫০০ যত্নকেন্দ্রে সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ১ থেকে ৫ বছর বয়সী সাড়ে ১২ হাজার শিশুকে সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি দেওয়া হচ্ছে প্রারম্ভিক শিক্ষা। একই সঙ্গে ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী ২৪ হাজার ৯৫০ শিশুকে শেখানো হয়েছে সাঁতার।

শিশুদের সাঁতার শেখানো হচ্ছে। ছবি: আজকের পত্রিকা
শিশুদের সাঁতার শেখানো হচ্ছে। ছবি: আজকের পত্রিকা

শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ, শিক্ষা এবং যত্ন প্রদান নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে মৃত্যুঝুঁকি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে আইসিবিসি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। এর উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস, যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউশন (আরএনএলআই)। আর কারিগরি সহায়তা প্রদান করছে সিনারগোস বাংলাদেশ, সিআইপিআরবি ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক আইইডি।

জেলার বাহুবল উপজেলার রশিদপুর চা-বাগানে যত্নকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সকালে চা-বাগানের কর্মজীবী মায়েরা তাঁদের ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুকে যত্নকেন্দ্রে দিয়ে যান। আবার বেলা ২টায় এসে শিশুদের কেন্দ্র থেকে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। এই সময়ের মধ্যে একজন যত্নদানকারী থাকেন। যাঁকে কেয়ারগিভার নামে অভিহিত করা হয়। প্রতিটি কেন্দ্রে একজন সহকারী কেয়ারগিভারও থাকেন। এই দুজনের মাধ্যমে যত্নকেন্দ্রে শিশুরা শারীরিক, সামাজিক, আবেগিক, ভাষাগত ও জ্ঞানবুদ্ধি বিকাশের শিক্ষা পায়। এতে কর্মব্যস্ত দিনে ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে শিশুরা থাকছে সুরক্ষিত আর মা নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারছেন।

রশিদপুর চা-বাগানের নারী চা-শ্রমিক সন্ধ্যা বাউরি বলেন, ‘আমি কাজে যাই। আর বাচ্চাটা দুইটা পর্যন্ত ক্লাস করে। আমাদের বাচ্চাকাচ্চা ভালো থাকে বলে আমরা শিশুকেন্দ্রে দিয়ে যাই। আমি কাজ শেষ করে এসে আমার ময়নাটাকে নিয়ে যাই।’

আরেক চা-শ্রমিক অঞ্জলী ভৌমিক বলেন, ‘আমাদের একটা শিশুকেন্দ্র আছে, সেখানে আমরা বাচ্চা রেখে যাই। অনেক নিরাপদ থাকে সেখানে। আর আমরা নিরাপদভাবে কাজকর্ম করে আসতে পারি। আমরা চাই, এভাবে যেন কেন্দ্রটি ভালোভাবে চলে।’

কেন্দ্রটির যত্নদানকারী কণিকা তাঁতী বলেন, ‘আমার এখানে ২৫ জন শিশু আছে। ২৫ জনের মধ্যে সবাই প্রতিদিন উপস্থিত থাকে। কেউ অসুস্থ থাকলে অনুপস্থিত থাকতে পারে। প্রতিদিন সকাল ৯টায় মায়েরা বাচ্চাদের এখানে রেখে যান। আপন ভুবন, স্বপ্নের ভুবন, গল্পের ভুবন, রঙিন ভুবন ও বাহিরের ভুবন—এই পাঁচ নামে আমরা শিশুদের গান, কবিতা, চিত্রাঙ্কন, ছড়া, খেলাধুলা ও খেলনা তৈরি করা শিখিয়ে থাকি। যে কারণে শিশুরা আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণ করছে।’

হবিগঞ্জে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ‘নতুন প্রজন্ম উদ্যোক্তা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের’ প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর রবিউল ইসলাম বলেন, ‘এই প্রকল্পের মাধ্যমে বেড়ে ওঠা শিশুদের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। যত্নকেন্দ্র থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুরা ক্লাসের অন্যদের চেয়ে ভালো করছে। তারা সৃজনশীল চর্চায় আগ্রহ দেখাচ্ছে।’

প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পর্কে রবিউল ইসলাম জানান, আইসিবিসি প্রকল্পে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ রয়েছে। প্রতিনিয়ত অভিভাবক সভা হয়। যার মাধ্যমে অভিভাবকদের মধ্যে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জন্মনিবন্ধন-বিষয়ক সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যেসব এলাকায় এই প্রকল্প চলছে, সেখানে শিশুমৃত্যুর হার অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। পানিতে ডুবে মৃত্যুও কমতে শুরু করেছে।

হবিগঞ্জ জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা দিল আফরোজ কাঞ্চি বলেন, হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল, মাধবপুর ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় আইসিবিসি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অন্যান্য এলাকার চেয়ে এই তিন উপজেলায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার অনেকাংশে কমে গেছে। শিশুদের আহত হওয়ার সংখ্যাও কমে গেছে। তিনি বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে মায়েরা আমাদের শিশুকেন্দ্রে বাচ্চাদের রেখে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারে। বিভিন্ন সময়ে যে শিশুদের রোগ হয়, সে সম্পর্কে আমরা অভিভাবকদের অবহিত করি। এ ছাড়াও জন্মনিবন্ধন, টিকা দেওয়ার যে সুবিধা, তা জানতে পেরে অভিভাবকেরা সচেতন হচ্ছেন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত