Ajker Patrika

মাছের অঙ্গের কেজি কোটি টাকা

  • পিটুইটারি গ্লান্ড মাছের প্রজননক্ষমতা বাড়ায়।
  • ৩৫টি দেশে মাছের এ প্রাকৃতিক হরমোনের চাহিদা রয়েছে।
মো. জাহিদ হাসান, যশোর 
পিটুইটারি গ্লান্ড মেডিসিনযুক্ত ছোট বোতলে সংরক্ষণ করে রাখা হয়।
পিটুইটারি গ্লান্ড মেডিসিনযুক্ত ছোট বোতলে সংরক্ষণ করে রাখা হয়।

যশোর শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড মাছবাজারে এক দশকের বেশি সময় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কাটাকুটি করে আসছেন বিল্লাল হোসেন সানি। দীর্ঘদিন মাছ কাটার কাজ করলেও মাথার ভেতরে থাকা ছোট্ট মুক্তাসদৃশ দানা কী সেটা কখনো ভাবেননি। বছর চারেক আগে স্থানীয় একটি সংস্থার মাধ্যমে সাদা এই দানার গুরুত্ব বুঝতে পেরে এখন প্রতিনিয়ত করছেন সংরক্ষণ।

সানির মতো যশোর শহরের মাছের বাজারগুলোতে মাছের মাথার ভেতরের এই সাদা দানাটি মাছের উচ্ছিষ্ট বস্তু হিসেবেই ফেলে দিতেন। এখন মাছ কেটেকুটে দেওয়ার পরই মাছের মাথা থেকে এই দানা সংগ্রহ করে রাখছেন বঁটিওয়ালা। মূলত মাছের মাথার ভেতরে থাকা ছোট্ট এই দানার নাম ‘পিটুইটারি গ্লান্ড’, যা মাছের প্রজননক্ষমতা বাড়িয়ে বছরে তিন থেকে চারবার ডিম ছাড়তে সহায়তা করে।

বিল্লাল হোসেন সানি জানান, সব মাছের মাথায় একটি করে পিটুইটারি গ্লান্ড থাকে। তবে সব ধরনের মাছ থেকে তিনি সেটা সংগ্রহ করেন না। কার্পজাতীয় মাছ থেকে সংগ্রহ করেন।

সানি বলেন, ‘মাথা থেকে পিটুইটারি গ্লান্ডটি মেডিসিনযুক্ত ছোট বোতলে সংরক্ষণ করি। প্রতি সপ্তাহে কোম্পানির এজেন্টরা এসে টাকা দিয়ে সেগুলো নিয়ে যান। প্রতি পিছ চার থেকে পাঁচ টাকা দেয়।’ তিনি জানান, মাছ কাটার পরে এটা থেকে তাঁদের বাড়তি আয় হয়। দিনে ৩০ থেকে ৫০ পিছ পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাড়তি আয়ের জোগান হওয়ায় বাজারে প্রায় সব বঁটিওয়ালাই পিটুইটারি গ্লান্ড সংরক্ষণ করছেন বলে জানান তিনি।

সম্প্রতি শহরের বড় বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, মাছের আঁশ ছাড়িয়ে মাছ পিছ করে কেটে দেওয়ার জন্য বঁটি নিয়ে বাজারে বসেছেন কয়েক ব্যক্তি। ক্রেতারা খুচরা মাছ কিনে তাঁদের কাছে দিলে তাঁরা আঁশ ছাড়িয়ে পিছ করে কেটে দিচ্ছেন। প্রত্যেকের বঁটির পাশে রাসায়নিক ভর্তি ছোট ছোট দু-একটি কাচের বোতল রাখা আছে। মাছ কাটার সময় কার্পজাতীয় মাছ যেমন রুই, কাতলা, সিলভার, মৃগেলসহ বিভিন্ন মাছের মাথার ভেতর থেকে ছোট একটি দানা (পিজি) সংগ্রহ করে বোতলে সংরক্ষণ করছেন তাঁরা।

মৎস্য বিভাগ ও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হ্যাচারির পুকুরে প্রজননের সময় মা ও পুরুষ মাছের দেহে নির্দিষ্ট মাত্রায় পিজি সিরিঞ্জের মাধ্যমে পুশ করা হয়। এতে মাছের দেহে উত্তেজনা আসে। এ সময় মাছের প্রজনন হয়। প্রাকৃতিক এ হরমোন ব্যবহারে মাছের জীবনচক্রে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না। মাছের প্রজননের প্রধান নিয়ামক এই হরমোন রপ্তানি করে দেশে বিদেশি মুদ্রা আনছেন উদ্যোক্তারা। মৎস্য অঞ্চল যশোর-সাতক্ষীরায় এই হরমোন নিয়ে কাজ করে আলোড়ন তৈরি করেছেন যশোরের মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী। প্রথম দিকে কাঁচা পিটুইটারি গ্লান্ড সংগ্রহ করলেও আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে শুরু করেন সংরক্ষণের। তাই শহরে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্সে একটি ভবন ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন ল্যাবরেটরি। নাম দিয়েছেন ইউনাইটেড এগ্রো ফিশারিজ। এখানে বাছাই শেষে অ্যালকোহল থেকে আলাদা করে গ্লান্ড শুকানো হয় ড্রাইং মেশিনে। ময়েশ্চার টেস্টসহ নানা পরীক্ষা শেষে বোতলজাত করে পাঠানো হয় দেশি-বিদেশি হ্যাচারিতে।

জেলার বিভিন্ন বাজার থেকে একইভাবে প্রাকৃতিক এই হরমোন সংগ্রহ করেন তাঁরা।

রপ্তানির পাশাপাশি ময়মনসিংহ, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলার হ্যাচারিতে এ হরমোনের পিজি পাঠায় ইউনাইটেড এগ্রো। বাংলাদেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, ইরাকসহ ৩৫টি দেশে মাছের এ প্রাকৃতিক হরমোনের চাহিদা রয়েছে বলে জানান লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, ‘বছরে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা মূল্যের পিজি দেশে-বিদেশে সরবরাহ করি। প্রতি গ্রাম পিজি বর্তমানে ৮০ মার্কিন ডলারে রপ্তানি হয়।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মনিরুল মামুন বলেন, কৃত্রিম প্রজননের জন্য দেশ-বিদেশের হ্যাচারিতে হরমোন বিক্রি হচ্ছে কোটি টাকার ওপরে। এ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আনা সম্ভব। দেশের চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদন বাড়াতে বঁটিওয়ালাসহ উদ্যাক্তাদের প্রশিক্ষণসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ