Ajker Patrika

ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডির ১৭ বছর: বাস্তবায়ন হয়নি ৬ দফা, কান্না থামেনি স্বজনদের

ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি
আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৩, ১৮: ৫৫
ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডির ১৭ বছর: বাস্তবায়ন হয়নি ৬ দফা, কান্না থামেনি স্বজনদের

দিনাজপুরের ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডির ১৭ বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামীকাল শনিবার (২৬ আগস্ট)। সেদিন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে করা সরকারের ছয় দফা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন আজও হয়নি। সে কারণে সেদিন গুলিতে নিহত, আহত ও পঙ্গুত্ব বরণকারীদের স্বজনদের কান্নাও থামেনি। সরেজমিন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র পাওয়া গেছে।

২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলন না করার দাবিতে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকে এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী অফিস ঘেরাও কর্মসূচি ডাকা হয়। সেদিন ওই কর্মসূচিতে আসা জনতার ওপর পুলিশ ও তৎকালীন বিডিআর সদস্যরা (বর্তমান বিজিবি) নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল।

সেদিন গুলিতে তিনজন মারা যান। তাঁরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরিকুল ইসলাম (২০), স্কুলছাত্র আমিন (১৫) ও সালেকিন (১৭)। সেই সঙ্গে আহত হন দুই শতাধিক নারী-পুরুষ। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ হন সুজাপুর গ্রামের বাবলু রায়। তিনি এখন পঙ্গুত্বের অসহনীয় যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত সাহাবাজপুরের প্রদীপ সরকার দীর্ঘদিন যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকার পর কিছুদিন আগে মারা যান।

ফুলবাড়ী পৌর এলাকার বারকোনা গ্রামের বাসিন্দা নিহত আমিনের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর মা রেহেনা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, সেই সময় তাঁর ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত। বেলা ৩টার দিকে ফুলবাড়ী শহরে গিয়ে সে লাশ হয়ে বাড়ি ফেরে।

অশ্রুসজল রেহেনা বেগম বলেন, ‘এভাবে যেন আর কোনো বাবা-মায়ের কোল খালি না হয়। বাপ-দাদার ভিটেমাটিসহ ফুলবাড়ী রক্ষায় এলাকাবাসীর সুখের জন্য আমার ছেলে প্রাণ দিয়েছে। এমন কয়লাখনি আর চাই না। তবে দুঃখ একটাই, এখন আর কেউ খবর নেয় না। আমার দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে আমিন ছিল বড়। বর্তমানে এক ছেলে বিএ পরীক্ষা দিয়েছে। তার একটা কর্মসংস্থানের জন্য কেউ পাশে এসে দাঁড়ায় না।’

গুলিতে পঙ্গুত্ব বরণকারী বাবলু রায়। ছবি: আজকের পত্রিকাপৌর শহরের চাঁদাপাড়া গ্রামের নিহত তরিকুলের বাবা সাবেক পৌর কাউন্সিলর মো. মোকলেছুর রহমান বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন তাঁর ছেলে আবু সালেহ মো. তরিকুল ইসলাম।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে মোকলেছুর রহমান বলেন, ‘আমার সন্তান মারা গেছে, এর কষ্ট একমাত্র আমিই বুঝি। তার কী অপরাধ ছিল? সেদিন আমার ছেলেকে অন্যায়ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। নিজেদের ভিটেমাটি রক্ষার জন্য আন্দোলন হতেই পারে। তাই বলে এভাবে গুলি করবে?’

নিহত সালেকিন বাড়ি ফুলবাড়ীর পার্শ্ববর্তী নবাবগঞ্জ উপজেলার জয়পুর ইউনিয়নের ঝোড়ারপাড় গ্রামে। তার মা শেফালী বেগমের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন, কাঁদতে কাঁদতে ছেলের স্মৃতিচারণ করেন তিনি।

নিহত সালেকিনের চাচা জোবেদ আলী বলেন, ‘সালেকিন সেই সময় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত। সালেকিনের জেদের কারণে সেদিন তাকে নিয়ে বেলা ৩টার দিকে ফুলবাড়ী যাই। এ সময় ফুলবাড়ী রেলগেট এলাকায় দলে দলে লোক মিছিলে অংশ নিচ্ছিল। একপর্যায়ে আমাদের এক ভাতিজি জামাইয়ের সঙ্গে সালেকিন চলে যায় মিছিলে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আমার কাছ থেকে। এরপর সন্ধ্যায় খবর পাই, গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন মারা গেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর খবর পাই, মৃত তিনজনের মধ্যে আমাদের সালেকিনও আছে।’

তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ফুলবাড়ী শাখার আহ্বায়ক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি বাস্তবায়ন না করতে এশিয়া এনার্জি নামক একটি বহুজাতিক কোম্পানির ফুলবাড়ীর অফিস ঘেরাও কর্মসূচি ছিল। সেখানে সেদিন এই এলাকার হাজারো আপামর জনগণ যোগ দেয়।

সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, সমাবেশে তৎকালীন বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) ও পুলিশ আন্দোলনকারীদের মিছিলে অতর্কিতে গুলি ছোড়ে। তাতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় তরিকুল ইসলাম (২০), আমিন (১৫) ও সালেকিন (১৭)। গুলিতে প্রদীপ চন্দ্র, শ্রীমান বাস্কে, বাবলু রায় পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এই ঘটনায় আহত হয় দুই শতাধিক মানুষ।

সাইফুল ইসলাম জুয়েল আরও বলেন, ওই সময় ২৬ থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তাল ছিল ফুলবাড়ী খনি এলাকা। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ফুলবাড়ীর ওপর দিয়ে বাস-ট্রেনসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচলসহ দোকানপাট বন্ধ করে দেয়। গণ-আন্দোলনের মুখে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের পক্ষ থেকে ৩০ আগস্ট সন্ধ্যায় পার্বতীপুর উপজেলা পরিষদ অডিটরিয়ামে সমঝোতা বৈঠক হয়। বৈঠকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের ছয় দফা চুক্তি স্বাক্ষর হয়।

আমিন, সালেকিন, তরিকুল (আসাত) স্মরণে গড়ে তোলা স্তম্ভ। ছবি: আজকের পত্রিকাএই নেতা বলেন, বাস্তবিক অর্থে গণ-আন্দোলনের ১৭ বছর পেরিয়ে গেলেও আংশিক বাস্তবায়নের পর থেমে গেছে ছয় দফা চুক্তি। এই চুক্তির মধ্যে রয়েছে, এশিয়া এনার্জিকে ফুলবাড়ী ও দেশ থেকে বহিষ্কার, ফুলবাড়ীসহ দেশের কোথাও উন্মুক্ত পদ্ধতির কয়লাখনি না করা, পুলিশ-বিডিআরের গুলিতে নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা, গুলিতে হতাহতের প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠন, শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণসহ এশিয়া এনার্জির দালালদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি প্রদান, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার এবং নতুন করে মামলা না করা।

জুয়েল আরও বলেন, ছয় দফা চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবিতে এখনো ফুলবাড়ী খনি অঞ্চলের মানুষ আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছে। ২৬ আগস্ট দিনটিকে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ‘ফুলবাড়ী দিবস’ এবং স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা সম্মিলিত পেশাজীবী সংগঠন ‘ফুলবাড়ী শোক দিবস’ ঘোষণা করে পৃথকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে।

এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকালে কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ, গণজমায়েত, আমিন-সালেকিন-তরিকুলের (আসাত) স্মরণে নির্মিত স্তম্ভে পুষ্পমাল্য অর্পণ, প্রতিবাদ সভা এবং মসজিদ-মন্দিরে প্রার্থনা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মেঘমল্লারের জবাবের পর ডাকসু ও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যা লিখলেন শশী থারুর

সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ডে স্থায়ী বসবাসের আবেদন করবেন যেভাবে

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ চাইলেন ফখরুল

শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হলো না জাবি শিক্ষক মৌমিতার

অনিয়মের অভিযোগ এনে জাকসু নির্বাচন কমিশন সদস্যের পদত্যাগ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত