Ajker Patrika

শশী থারুরের নিবন্ধ /ড্রাগনে ভয়, ইগলের ডানায় ভরসা খুঁজুক ভারত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৭: ০৩
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্প্রতি চীনে গিয়েছিলেন। তিয়ানজিনে তাঁর এই সফর ছিল সাত বছরের মধ্যে প্রথম চীন সফর। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) সম্মেলনে তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন, কথা বলেন। এতে বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের এক সংহতির ছবি ফুটে ওঠে, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে এই বাহ্যিক দৃশ্যের আড়ালে রয়েছে অনেক জটিল এক বাস্তবতা, যা ভারতকে অত্যন্ত সতর্কতা ও সুস্পষ্ট কৌশলে সামাল দিতে হবে।

চীনে মোদির এই সফরকে অনেকে এক ধরনের ডিপ্লোম্যাটিক রিস্টার্ট বা কূটনৈতিক পুনর্যাত্রা হিসেবে দেখছেন। এক ঘণ্টার সৌহার্দ্যপূর্ণ বৈঠকে মোদি ও সি দুই দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট ফের চালুর সিদ্ধান্ত নেন। একই সঙ্গে তিব্বতে অবস্থিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র স্থান কৈলাস মানস সরোবর যাত্রাও আবার উন্মুক্ত করতে তাঁরা সম্মত হন। করমর্দন হলো, ছবি তোলা হলো, আর মনে হলো—দুই এশীয় শক্তির মধ্যে এক নতুন শান্তিপূর্ণ সহযোগিতার অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে।

তবে সন্দেহের যথেষ্ট জায়গা আছে। ১৯৫০-এর দশক থেকে ভারত বারবার চীনের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা করেছে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই হতাশা আর বিশ্বাসঘাতকতার অভিজ্ঞতা হয়েছে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন হঠাৎ হিমালয় সীমান্তে সমন্বিত আক্রমণ চালায়। সেই যুদ্ধ দুই দেশের বন্ধুত্বের আশা ভেঙে দেয়। ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উদ্যোগে কিছুটা শান্তি ফিরে আসে। কিন্তু গত এক দশকে আবারও উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ২০১৩ সালে ডেপসাং, ২০১৪ সালে চুমার, ২০১৭ সালে ডোকলাম এবং ২০২০ সালে গালওয়ানে প্রাণঘাতী সংঘাত—সব মিলিয়ে সীমান্ত পরিস্থিতি অস্থির হয়ে ওঠে।

ভারত-চীন সীমান্তের লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) নিয়ে বিরোধ মেটেনি। বরং চীন সীমান্তজুড়ে অবকাঠামো বাড়াচ্ছে। এর পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক—চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর, সামরিক সহায়তা আর কূটনৈতিক সমর্থন—ভারতের জন্য বড় কৌশলগত দুর্বলতা তৈরি করছে। তাই যতই সুন্দর ছবি বা ইতিবাচক পরিবেশ তুলে ধরা হোক, বাস্তবে এই জটিল সমস্যাগুলো সমাধান করা সহজ হবে না।

চীন-ভারত সম্পর্ক বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতিতেও জরাজীর্ণ। চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। এর মানে হলো—ভারত নানা চীনা পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। ইলেকট্রনিকস থেকে শুরু করে ওষুধ তৈরির কাঁচামাল ও রেয়ার আর্থস বা বিরল মৃত্তিকা ধাতু—সবকিছুর বড় অংশই আসে চীন থেকে। অথচ ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি ও সেবা খাত চীনের বাজারে জায়গা করে নিতে হিমশিম খাচ্ছে। বিপরীতে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের সরবরাহ ব্যবস্থায় শক্তভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছে। অর্থনৈতিক পাল্টা সুবিধার দাবি ভারত বারবার তুললেও তেমন ফল মেলেনি।

চীন-ভারত সম্পর্কের কাঠামোগত সমস্যাগুলো শুধু শীর্ষ বৈঠক দিয়ে ঢেকে রাখা যাবে না। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) সম্মেলনে সি চিনপিং যখন ড্রাগন–হাতির একসঙ্গে পথচলার কথা বললেন, তখন নরেন্দ্র মোদি আবারও সীমান্তে শান্তি আর ন্যায্য বাণিজ্য সম্পর্কের দাবি তোলেন। তিনি আবারও জানান, চীনের বহুজাতিক বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিরোধিতা করছে ভারত। পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে যাওয়া মহাসড়ক এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় অংশ, আর সেটি ভারতের দাবি করা ভূখণ্ড। পাশাপাশি, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও ভারতের আপসহীন অবস্থান তুলে ধরেন মোদি।

দ্বিপক্ষীয় মতবিরোধ ছাড়াও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে চীন ও ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই ভিন্ন। চীন এক ধরনের বিকল্প বৈশ্বিক ব্যবস্থার পক্ষে কথা বলছে। এসসিও সম্মেলনে সি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), অর্থনীতি ও অবকাঠামো খাতে নতুন উদ্যোগের কথা বলেন, যা পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করবে। রাশিয়ার জন্য—যে দেশটি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় একঘরে হয়ে পড়েছে—এসব উদ্যোগ ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে বড় ভরসা। কিন্তু ভারত এসসিও–কে কেবল আঞ্চলিক সম্পৃক্ততার একটি কার্যকর মঞ্চ মনে করে। একই সঙ্গে কৌশলগত স্বাধীনতার জায়গা থেকে অবস্থান জানানোরও সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক ছেড়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছা ভারতের নেই।

ভারতের নীতিনির্ধারকেরা যেভাবে অনেক সময় চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের সম্ভাবনাকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দেন, সেভাবেই তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের স্থায়িত্বকে বারবার খাটো করে দেখেন। চীনের মতো যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করে রাখেনি, যুদ্ধে পাকিস্তানকে গোয়েন্দা ও সামরিক সহায়তা দেয়নি কিংবা এশিয়ার সীমান্ত নতুন করে আঁকার চেষ্টা করেনি। বরং গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত ধীরে ধীরে কৌশলগত অংশীদারত্ব গড়ে তুলেছে। এর মধ্যে আছে প্রতিরক্ষা খাতে সমন্বয়, গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি, সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা আর সমুদ্র নিরাপত্তা।

যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া আর জাপানের কোয়াড জোটের অংশ ভারত। এই অংশগ্রহণ ইঙ্গিত দেয়—চীন যে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তার বিপরীতে ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপারে দেশগুলো একমত। কোয়াডের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও—যেমন এর পরবর্তী সম্মেলন ভারতের মাটিতে হওয়ার কথা—এই বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর শিক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। পাশাপাশি সেমিকন্ডাক্টর থেকে শুরু করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগ করছে। ভারতীয় পণ্যের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্যও যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশের বাণিজ্যে ভারতের উদ্বৃত্ত প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। তবু সম্পর্ক নিখুঁত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা সম্প্রতি ভারতকে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যে ‘মন্দ খেলোয়াড়’ বলেছেন। আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন। যদিও এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে এবং আলোচনার মাধ্যমেই এসব বাণিজ্য বিতর্ক মেটানো সম্ভব।

মূলত যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সহযোগিতা কোনো সাময়িক দর-কষাকষির বিষয় নয়, বরং কাঠামোগত বাস্তবতা। বর্তমান টানাপোড়েন সত্ত্বেও দুই দেশ সরবরাহ ব্যবস্থার নিরাপত্তা আর চীনের কর্তৃত্ববাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঠেকাতে অভিন্ন স্বার্থে কাজ করছে। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চীন সফর ছিল জরুরি, যাতে সম্পর্ক আরও খারাপ না হয়। কিন্তু প্রকৃত অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করছে ভৌগোলিক বাস্তবতা, মতাদর্শ আর শক্তির অসমতা—যা শুধু কূটনীতির মাধ্যমে সহজে মেটানো সম্ভব নয়।

এখন, ভারতের নেতাদের মনে রাখতে হবে, কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন মানে এক শক্তির দিক থেকে আরেক শক্তির দিকে দোদুল্যমান থাকা নয়। বরং নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জায়গা তৈরি করা, যাতে অন্য কোনো শক্তির এজেন্ডায় বিলীন হতে না হয়। চীনের সঙ্গে উত্তেজনা এড়ানো মানে যেন মিথ্যা অংশীদারত্বের ভেলায় চড়া না হয়। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর কষাকষি মানে যেন দ্বন্দ্বকে এমন পর্যায়ে না নেওয়া হয়, যেখানে অভিন্ন স্বার্থে সহযোগিতা ব্যাহত হয়।

ভারতের পররাষ্ট্রনীতির দিশা ঠিক হবে সম্মেলনের চাকচিক্যে নয়, বরং কৌশলগত স্বার্থের বাস্তবতায়। ড্রাগন হাত মেলালেও তার নখ দেখা যায় স্পষ্ট। ইগলের পালক এলোমেলো হলেও তার ডানা এখনো ভরসার শক্তি জোগায়। দুই দিকের সঙ্গেই চলতে হলে শুধু ভারসাম্য নয়, দূরদর্শিতারও প্রয়োজন।

প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক আটক

রাজধানীতে অপরাধ: ১৪ ভাগ করে মিরপুর নিয়ন্ত্রণ করছে চার শীর্ষ সন্ত্রাসী

হাদিকে হত্যাচেষ্টা: সন্দেহভাজন ফয়সালের ব্যাংক হিসাব জব্দ

আজকের রাশিফল: প্রাক্তন ফোন করবে ও পুরোনো পাওনা টাকার কথা স্মরণ হবে, তবে পরিণতি একই

বকশীগঞ্জের ‘বটগাছ’খ্যাত বিএনপি নেতা আব্দুর রউফ তালুকদারের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ