Ajker Patrika

ইউক্রেনে যেসব কারণে থমকে গেছে রুশ বাহিনী

ইউক্রেনে যেসব কারণে থমকে গেছে রুশ বাহিনী

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভিযান শুরুর পর প্রায় বিনা বাধায় অগ্রসর হচ্ছিল রুশ বাহিনী। বিশেষ করে ক্রিমিয়া, দোনেৎস্ক, লুহানস্ক এবং বেলারুশ সীমান্ত দিয়ে ইউক্রেনের বেশ গভীরে ঢুকে যায় পুতিনের বাহিনী। বেশ কয়েকটি শহরের পতন হয়। কিন্তু দ্রুতই ঘুরে দাঁড়ায় ইউক্রেনীয়রা। দুই সপ্তাহ ধরেই তারা রুশ বাহিনীকে ঠেকিয়ে রেখেছে। পুতিন বাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রায় থেমে গেছে। 

অপেক্ষাকৃত দুর্বল সেনাবাহিনী নিয়ে একটা পরাশক্তিকে ইউক্রেন কীভাবে ঠেকিয়ে রাখতে পারছে এ নিয়ে নানা ব্যাখ্যা হাজির করছেন বিশ্লেষকেরা। ইউক্রেনবাসীর এমন মনোবল পশ্চিমে অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়াচ্ছে। 

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংখ্যাগতভাবে অনেক উচ্চতর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের পারফরম্যান্সের পেছনে রয়েছে—ভালো প্রস্তুতি, জাতীয় সংহতি এবং রাশিয়ার কিছু কৌশলগত ভুল। 

অবশ্য, এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ এখনো অস্পষ্ট। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বারবার বলছেন, তিনি লক্ষ্য অর্জন থেকে এক চুলও পিছপা হবেন না। অবশ্য ইউক্রেন দখল করার কোনো পরিকল্পনা নেই বলেও জানিয়েছেন পুতিন। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফরাসি সামরিক বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘তারা (রুশরা) আর খুব দ্রুত এগোতে পারছে না। কিছু সময় নিয়ে তাদের আবার সংগঠিত হতে হবে। কিন্তু এর মানে এটিকে তাদের ব্যর্থতার নিদর্শন বলা যাবে না।’ 

রুশ বাহিনীর এই হতোদ্যম অবস্থার পেছনে পাঁচটি কারণ উল্লেখ করছেন বিশ্লেষকেরা। 

প্রস্তুতি
২০১৪ সালে রাশিয়া ঝটিকা অভিযানে ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার পর পশ্চিমারা ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে নানাভাবে সহায়তা করেছে। সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিতে প্রচুর অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা পেয়েছে ইউক্রেন। 

এই অভিযানে ইউক্রেনীয় উপদ্বীপ ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অঙ্গীভূত করে নেন পুতিন। আর রুশ সহায়তায় ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণে নেয় রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। 

 ২০১৬ সালে ন্যাটো এবং কিয়েভ ইউক্রেনের বিশেষ বাহিনীর জন্য একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু করে। এই বিশেষ বাহিনীর আকার এখন ২ হাজার। এ বাহিনীতে বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবকদেরও যুক্ত করা গেছে। 

জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ডগলাস লন্ডন বলছেন, ‘ইউক্রেনীয়রা গত আট বছর পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ এবং রাশিয়ার দখল প্রতিরোধ করার জন্য নিজেদের সজ্জিত করতে যথেষ্ট অর্থ ও সময় পেয়েছে।’ 

ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে সিআইএর এক সাবেক কর্মকর্তা লিখেছেন, ইউক্রেনীয়রা যখন বুঝে গেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো তাঁদের উদ্ধার করতে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে আসবে না, তখন তাঁরা কৌশল হিসেবে মস্কোর রক্ত ঝরানোর দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন যাতে দখলদারি অসম্ভব করে তোলা যায়।’ 

স্থানীয় জ্ঞান
রাশিয়া মূলত তার সোভিয়েত যুগের পরিচিতির ওপর নির্ভর করে এমন একটি অঞ্চলে অভিযান শুরু করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বা ইউএসএসআরের অধীনে মস্কো নিয়ন্ত্রিত ইউক্রেনীয় বাহিনীর বর্তমান অবস্থাকে পাঠ করতে কিছুটা ভুল হয়তো রাশিয়া করেছে। বিশেষ করে তাদের নিজের এলাকার রাস্তাঘাট অলিগলি সম্পর্কে যে চেনাজানার সুবিধা তারা পাচ্ছে সেটির সম্ভবত অবমূল্যায়ন করেছেন পুতিন। 

এখানে ভূখণ্ডের জ্ঞানের মধ্যে দুটি জিনিস রয়েছে—বছরের এই একটি সময় রাস্তাঘাটে প্রচুর কাদা হয়; আবার আক্রমণকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয়দের হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার সক্ষমতা। 

আকস্মিক যুদ্ধের এমন পরিস্থিতিতে দুর্বল বাহিনী তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিজেদের সুবিধাগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চাইবে—এটাই যুদ্ধের কৌশল। ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্স কলেজের অধ্যাপক স্পেন্সার মেরেডিথ বলেন, ‘ভূখণ্ড, স্থানীয় জ্ঞান এবং সামাজিক সংযোগের সুবিধা—এগুলো ইউক্রেনীয়দের বড় শক্তি।’ 

রাশিয়া যখন কিয়েভের মতো শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে চায় তখন শহরের ভেতরে থেকে প্রতিরোধ আসতে শুরু করলে চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে। ফরাসি সেনাবাহিনীর একটি সূত্র বলছে, ‘এমন পরিস্থিতি সবকিছু পরিবর্তন করে দেবে। রুশ বাহিনী রাস্তার প্রতিটি কোণা এবং ভবন থেকে প্রতিরোধের মুখে পড়বে।’ 

সংহতি
প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির নেতৃত্বে ইউক্রেনীয়রা প্রতিকূলতার মধ্যে গভীর স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছে। রাশিয়ার বাহিনী রাজধানী কিয়েভের কাছাকাছি অঞ্চলে প্রবেশের পর জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও কিয়েভ ছেড়ে যাননি প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। তিনি জনগণের অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাসের বড় শক্তিতে পরিণত হয়েছেন। 

সাধারণ নাগরিকেরা পরিবারকে নিরাপদে দেশের পশ্চিমে বা এর সীমানার বাইরে নিরাপদ স্থানে রেখে এসে ফ্রন্টলাইনের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিচ্ছেন। 

অনলাইনে প্রচারিত ছবি ও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ মানুষ মোলোটভ ককটেল (পেট্রলবোমা) তৈরি করছে। কৃষকেরা জব্দকৃত রুশ সামরিক সরঞ্জাম টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। 

অবসরপ্রাপ্ত ফরাসি কর্নেল মিশেল গোয়া বলেন, ‘আঞ্চলিক সেনাদের দ্রুত প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং হালকা অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধির সক্ষমতা আরও বাড়ানো ছাড়া ইউক্রেনের কাছে অন্য কোনো বিকল্প নেই।’ 

কৌশলগত ভুল
সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভিযান শুরু করার পর প্রথম দিনগুলোতে রাশিয়া কিছু কৌশলগত ভুল করেছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে খুব কম স্থলসেনা পাঠানো হয়েছিল। স্থল ও বিমানবাহিনীকে একসঙ্গে কাজ করাতে ব্যর্থ হয়েছিল রাশিয়া। 

মস্কোর ভাবভঙ্গিতে মনে হয়েছিল, তাঁরা আশা করেছিলেন কয়েক দিনের মধ্যেই সামরিক সাফল্য অর্জিত হবে। 

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর নেভাল অ্যানালাইসেসের রাশিয়া স্টাডিজ প্রোগ্রামের পরিচালক মাইকেল কফম্যান বলেন, ‘শুরুতে তারা (রাশিয়া) ভেবেছিল যে, রাজধানী কিয়েভে খুব দ্রুত সামরিক ইউনিট প্রবেশ করাতে পারবে...কিন্তু খুব দ্রুতই তাদের আশাভঙ্গ হয়। তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে।’ 

কফম্যান বলেন, ‘তাদের পূর্বানুমানগুলো হাস্যকর ছিল...আপনি কীভাবে তিন দিনের মধ্যে কিয়েভ দখলে করে নিতে পারবেন? রাশিয়ান সামরিক বাহিনী এখন পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করে একটা সামঞ্জস্য এনেছে। তারা এখন সম্মিলিত সামরিক অভিযান পরিচালনার চেষ্টা করছে।’ 

মনস্তাত্ত্বিক ভয়
রাশিয়া ইউক্রেনের সীমান্তের কাছাকাছি কয়েক হাজার সেনা মোতায়েন করে বিশ্বজুড়ে বিপৎঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু খুব সম্ভবত কম মানুষেরই ধারণা ছিল যে, এই সেনাদের প্রতিবেশী দেশে যুদ্ধে পাঠানো হবে। যেই দেশের বাসিন্দারা বন্ধু স্লাভ এবং অনেকেই তাঁদের মাতৃভাষা রুশ ভাষায় কথা বলেন। 

রুশ বাহিনীতে বড় ধরনের হতাহত সেনাদের মনোবল বাড়াতে কোনো ভূমিকা রাখবে না। এর মধ্যে অন্তত একজন মেজর জেনারেল প্রাণ হারিয়েছেন। পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে সামরিক বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় অভিজাত অফিসার সম্মুখসমরে যেতে পারেন সেটি কিছুটা আঁচ করা যেতে পারে। 

ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো টম পেপিনস্কি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, রুশ যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে ইউক্রেনের আচরণ আরও কঠোর হতে পারে। আক্রমণকারীদের দেশে ফেরতে যেতে এভাবে মানসিক চাপ সৃষ্টির একটা কৌশল তাঁরা নিতে পারেন।’ পেপিনস্কি বলেন, ‘ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ সবচেয়ে কার্যকর হবে যদি রুশদের কোণঠাসা করা যায়, তাদের ঘুম হারাম করে ফেলা যায় এবং অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াপ্রবণ করে তোলা যায়।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত