Ajker Patrika

এন ইসলামিয়া একাডেমি কলেজ: আয়া থেকে হলেন প্রভাষক

  • ২২ পদে নিয়োগে কয়েক কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে।
  • ৫ আগস্টের পর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বেশির ভাগ নিয়োগ দেখানো হয়েছে ২০০৪ ও ২০১৬ সালে।
ইলিয়াস আহমেদ, ময়মনসিংহ  
নজরুল ইসলাম ও হোসনে আরা। ছবি: সংগৃহীত
নজরুল ইসলাম ও হোসনে আরা। ছবি: সংগৃহীত

ময়মনসিংহের তারাকান্দা এন ইসলামিয়া একাডেমি কলেজের আয়া (পরিচারিকা) হোসনে আরাকে একই কলেজে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে এলাকাজুড়ে সমালোচনা হলে ৬ মাস ধরে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন হোসনে আরা। এ ছাড়া গত ৫ আগস্টের পর হোসনে আরাসহ আরও ২২টি পদে নিয়োগ দিয়ে অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, ২০০০ সালে জরাজীর্ণ টিনের ঘরে ময়মনসিংহের তারাকান্দায় প্রতিষ্ঠিত হয় কলেজটি। ২০১৬ সালে মান্থলি পেমেন্ট অর্ডারভুক্ত (এমপিও) হয়। ৫ আগস্টের পর প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে হঠাৎ আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক ও স্থানীয় ব্যক্তি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক থাকার সুযোগ নিয়ে অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম ৫ আগস্টের পর ২২ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। যাঁদের নিয়োগ দেখানো হয়েছে ২০০৪ এবং ২০১৬ সালে। নিয়োগ দিতে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা করে নিয়েছেন অধ্যক্ষ। বর্তমানে যাঁরা শিক্ষার্থীবিহীন বিভিন্ন সাবজেক্টে নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁরা অধ্যক্ষকে টাকা ফেরতের জন্য চাপ দিচ্ছেন।

অভিযোগ উঠেছে, প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠা অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলাম শিক্ষাসনদ জালিয়াতির মাধ্যমে কলেজের আয়া হোসনে আরাকে সংস্কৃতি বিষয়ের প্রভাষক, শিক্ষার্থী নেই তবুও ইতিহাসে পড়াশোনা করা এনামূল কবীরকে পালির প্রভাষক, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা আকরামুল ইসলামকে খাদ্য ও পুষ্টির প্রভাষক, সমাজকর্ম নিয়ে পড়াশোনা করা মাকসুদা বেগমকে গার্হস্থ্য অর্থনীতির প্রভাষক, মো. রাজন মিয়াকে চারু ও কারুকলার প্রভাষক, আলী মতুর্জাকে গৃহ ও পারিবারিক জীবন ব্যবস্থাপনার প্রভাষক, উচ্চমাধ্যমিক পাস করা নুরুজ্জামানকে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে প্রভাষক, তানজিনা আক্তারকে ভূগোলের প্রভাষক, আশরাফুন নাহারকে সমাজবিজ্ঞানের প্রভাষক, ময়মনসিংহের মহাবিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি সম্পন্ন করা এনামুল হককে নাট্যকলার প্রভাষক, একই কলেজ থেকে ডিগ্রি সম্পন্ন করা রাসেল মিয়াকে সংগীতের প্রভাষক, ২০১৩-১৪ সেশনে দর্শনে মাস্টার্স করা আকলিমা আক্তারকে মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করা রফিকুল ইসলামকে মনোবিজ্ঞানের প্রভাষক, ইসলামের স্টাডিজে পড়াশোনা করা রহিম উদ্দিনকে আরবির প্রভাষক করা হয়েছে। প্রাণিবিদ্যা বিষয় না থাকলেও ল্যাব সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নিলুফা আক্তারকে। এ ছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে অফিস সহকারী নিয়োগ এবং একই প্রভাষককে দুই বিষয়ে নিয়োগ দেখিয়ে ২২ জনের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা বাণিজ্য করেছেন অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলাম।

সম্প্রতি অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জানতে কলেজটিতে গেলে অধ্যক্ষের এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ জানান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী নাফিজা আক্তার কারিনা বলেন, ‘শুনেছি হোসনে আরা প্রভাষক হয়েছেন। কয়েক দিন আগেও যিনি আমাদের বেঞ্চ, টেবিল, রুম পরিষ্কারসহ অন্যান্য কাজ করতেন, তাঁর নিয়োগ কীভাবে হলো। তাঁকে আমরা কীভাবে ম্যাডাম ডাকব আপনারাই বলুন। সংস্কৃতির প্রভাষক হওয়ার পর থেকে তিনি আর কলেজে আসছেন না।’

এমপিওর অনলাইন কপি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা আকরামুল ইসলাম শুধু খাদ্য ও পুষ্টির প্রভাষক নন, তিনি শিল্পকলা এবং কারুশিল্পরও প্রভাষক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে কম্পিউটার প্রদর্শক হিসেবে নিয়োগ পাই। পরে সেটি পরিবর্তন করে অধ্যক্ষ স্যার আমাকে শিল্পকলা এবং কারুশিল্পে এমপিওভুক্ত করেন। বিষয়টি পছন্দ না হওয়ায় খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ে সর্বশেষ প্রভাষক হিসেবে সুযোগ পাই।’

ইসলামিক স্টাডিজে পড়াশোনা করে আরবির প্রভাষক হওয়া রহিম উদ্দিন বলেন, ‘আরবি বিষয়েও আমার অভিজ্ঞতা রয়েছে। একটি কোর্স করেছিলাম তাই প্রভাষক হয়েছি।’ কত টাকার বিনিময়ে জাল সনদে প্রভাষক হয়েছেন, এমন প্রশ্নে চোখে টলমল পানি নিয়ে বলেন, ‘টাকা তো কিছু খরচ হয়েছে।’

আয়া থেকে জাল সনদে সংস্কৃতির প্রভাষক হওয়া হোসনে আরা সমালোচনার মধ্যে পড়ে কলেজে যাচ্ছেন না। তাঁর গ্রামের বাড়ি শাহবাজপুরে গেলেও তিনি দেখা করেননি। নাম না বলে তাঁর ষাটোর্ধ্ব মা বলেন, ‘জমি বিক্রি করে মেয়েটা শিক্ষক হইচে। এখন তার নাকি অনেক সমস্যা চলছে। স্যাররা নাকি ঢাকায় দৌড়াইতেছে। কী জানি হয়, বুঝতে পারতেছি না।’

কলেজে গিয়ে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা ক্লাস করাতে দেখা যায় প্রভাষক শহীদুল ইসলামকে। হোসনে আরার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘কলেজটির প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে আমি রয়েছি। শিক্ষক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে হীনম্মন্যতায় ভুগছি। কারণ এই কলেজে আয়াও প্রভাষক, আমিও প্রভাষক।’ ইংরেজির প্রভাষক তোফায়েল আহমেদ সবুজ বলেন, ‘অন্য নিয়োগ কীভাবে হয়েছে না হয়েছে কখনো জানতে চাইনি। কিন্তু আয়াকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে কলেজটিকে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

নিয়োগপ্রক্রিয়া যথাযথভাবে হয়েছে জানিয়ে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যে যে বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সবারই বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন রয়েছে। শিক্ষার্থী না থাকলেও হয়ে যাবে। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করুন।’ পালি, খাদ্য ও পুষ্টি, চারু ও কারুকলা, নাট্যকলা এবং সংগীতে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁরা জাল সনদ ব্যবহার করেছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তাঁদের কাগজপত্র সব ঠিকঠাক রয়েছে।’

১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা নিয়ে প্রত্যেককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কলেজে সবাই আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছে। তবে নিয়োগ বাবদ কোনো টাকা নেওয়া হয়নি। একটি পক্ষ আমাকে বিপদে ফেলতে এসব প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে।’

এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ময়মনসিংহের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘অভিযোগের ভিত্তিতে আজিজুল হক, মাকসুদা বেগম, মো. রাজন, আশরাফুন নাহার, আকলিমা আক্তার এই পাঁচজনের এমপিও স্থগিত করা হয়েছে। ৫ আগস্টের পর যোগদান করেই এ পদক্ষেপ নিয়েছি। বিষয়গুলো গভীরভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, যাঁরা অসৎ উপায়ে চাকরি নিয়েছেন, তাঁদের একজনও টিকতে পারবেন না।’ তিনি আরও বলেন, অবৈধ নিয়োগে অধ্যক্ষের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাঁর শাস্তি নিশ্চিতেও সুপারিশ পাঠানো হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মালয়েশিয়ায় স্থায়ী বসবাসের সুযোগ, আবেদন ফি মাত্র ১৪ হাজার টাকা

বিএসএফের হাতে আটক বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয় মিলেছে

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাইরান কাজীর বিষয়ে ইলন মাস্কের মন্তব্যে বিস্ময়

অমীমাংসিত বিষয় সমাধানে পাকিস্তানের দাবি নাকচ করল সরকার

১৫ বছর যাদের জন্য লড়াই করলাম, তারা এখন আমাকে ধাক্কা দেয়: রুমিন ফারহানা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত