Ajker Patrika

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের নিবন্ধ /মাদাগাস্কারের জেন-জি আন্দোলন যেভাবে সামরিক অভ্যুত্থানে গড়াল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০০: ০৬
মাদাগাস্কারে গত সপ্তাহে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে বেরিয়ে আসেন বিক্ষোভকারীরা। ছবি: এএফপি
মাদাগাস্কারে গত সপ্তাহে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে বেরিয়ে আসেন বিক্ষোভকারীরা। ছবি: এএফপি

এ বছরের শুরুতে মাদাগাস্কারের আনতানানারিভো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পানির কল শুকিয়ে যায়। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ২৫ বছর বয়সী মেডিকেল শিক্ষার্থী আনজান্দ্রাইনা আন্দ্রিয়ানাইভো বলেন, ‘এক ফোঁটাও পানি ছিল না, গোসল করার উপায় নেই, টয়লেট ফ্লাশ করা যাচ্ছিল না, এমনকি হাত ধোয়ার পানিও নেই। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পানি সরবরাহকারী সংস্থা, এমনকি প্রেসিডেন্সির সঙ্গেও কথা বলেছিলাম।’

কিন্তু ছয় মাস ধরে ঘোরাঘুরির পরেও কোনো সাড়া না পেয়ে আন্দ্রিয়ানাইভো অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেন। এই আন্দোলন দ্রুত হাজারো তরুণের বিক্ষোভে রূপ নেয়। শেষ পর্যন্ত এই বিক্ষোভের মুখে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনার পতন ঘটেছে।

উল্কিতে ভরা দুই মুষ্টি তুলে ধরে আন্দ্রিয়ানাইভো বলেন, ‘ওই দিনটা আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিনগুলোর একটি ছিল। এই জয় আমাদের জনগণের জন্য, আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য।’

তবে পরে কী হবে—সে বিষয়ে আন্দ্রিয়ানাইভো ও রাজধানীর কেন্দ্রে জমায়েত হাজারো তরুণের এখনো স্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই, তাঁরা সেটি নিয়ে তেমন চিন্তিতও নন। এতে দেশটির ভবিষ্যৎ এক অনিশ্চয়তার দিকে এগোচ্ছে।

এ সপ্তাহের শুরুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে রাজোয়েলিনা বলেন, তিনি একটি ‘নিরাপদ স্থানে’ আছেন এবং দেশটির নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতেই আছে। যদিও তখন গুঞ্জন ওঠে, তিনি ফরাসি একটি বিমানে পালিয়ে গেছেন। বর্তমানে দেশটির অধিকাংশ নাগরিকের বিশ্বাস, রাজোয়েলিনা দুবাইয়ে আত্মগোপনে আছেন।

এর ঘণ্টাকয়েক পরেই পার্লামেন্ট তাঁকে অভিশংসনের পক্ষে ভোট দেয়। এরপর সেনারা প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসে হামলা চালিয়ে সিনেট, সাংবিধানিক আদালত ও জাতীয় নির্বাচন কমিশন ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। কেবল জাতীয় সংসদকে রেখে অন্য সব প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করা হয়।

ক্যাপসাট নামে বিশেষ সেনাদলের প্রধান কর্নেল মাইকেল র‍্যানড্রিয়ানিরিনা জানান, শুক্রবার তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শপথ নেবেন। পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে নতুন নির্বাচন আয়োজন করা হবে।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, সামরিক বাহিনীর এই পদক্ষেপ একটি সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থান। আফ্রিকান ইউনিয়ন এরই মধ্যে ‘সাংবিধানিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত’ মাদাগাস্কারের সদস্যপদ সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। আগেও আফ্রিকান জোটটি মালি, বুরকিনা ফাসো ও গিনির মতো দেশে একই ব্যবস্থা নিয়েছিল।

১৯৬০ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে মাদাগাস্কার অভ্যুত্থানের ইতিহাসে ভরা। ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্টবিরোধী আন্দোলনের পর সেনাবাহিনীর সহায়তায় রাজোয়েলিনাকে ক্ষমতায় আনা হয়। তিনি তখন মাত্র ৩৩ বছর বয়সী এক সাবেক ডিজে। পরে সেনাবাহিনী গঠিত একটি ট্রানজিশনাল কাউন্সিল তাঁকে অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করে। ২০১৮ সালে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের বর্জিত এক ‘নির্বাচনে’ তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

মাদাগাস্কারের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ইতিহাসবিদ আরনো লেওনার্দ বলেন, একটার পর একটা সরকার আসে এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে যে তারা অরাজকতা দূর করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারাই বিশৃঙ্খলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিটি প্রেসিডেন্টই ‘উদ্ধারকর্তা’ হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় আর প্রতিটি প্রজন্ম রাস্তায় নেমে তাদের তাড়িয়ে দেয়। এবার শুধু একটাই পার্থক্য, আগে স্লোগান ছাপা হতো লিফলেটে আর এখন ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। কিন্তু মানুষের ক্ষোভ ঠিক একই রকম রয়ে গেছে।

এখন পর্যন্ত তরুণ আন্দোলনকারীরা সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থাশীল। বিক্ষোভে পুলিশের রাবার বুলেটে আহত সিকার লেব্লাঁ বলেন, ‘আমি বেশ আশাবাদী যে, ধীরে ধীরে সেনাবাহিনী সবকিছু ঠিক করে ফেলবে। তাদের হাতে দুই বছর সময়। যদি তারা ব্যর্থ হয়, আমরা তাদেরও তাড়াব।’

তবে দ্বীপ দেশটির সামনে পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ। শীর্ষ ভ্যানিলা রপ্তানিকারক ও বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষের এই দেশ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি। মাথাপিছু আয় মাত্র ৫০০ ডলারের মতো এবং প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষ বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।

নিয়মিত বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে মানুষ দিনে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎহীন থাকে। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে বৈশ্বিক সমৃদ্ধির মানদণ্ডে পৌঁছাতে হলে মাথাপিছু আয় ১৪ গুণ বাড়াতে হবে।

বিশ্বজুড়ে জেন-জি তরুণদের বিস্ফোরণ

যে জেন-জিদের বিক্ষোভে মাদাগাস্কারের সরকারের পতন ঘটেছে, সে বিক্ষোভের ঢেউ এর আগে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও (মরক্কো, বাংলাদেশ, নেপাল, কেনিয়া ও পেরু) দেখা গেছে। তবে দেশগুলোতে এখনো আশাব্যঞ্জক কোনো পরিবর্তন আসেনি।

এ তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একে অপরকে সহায়তা করছে। অনেকে ‘ওয়ান পিস’ নামের জনপ্রিয় জাপানি অ্যানিমের ‘স্কাল অ্যান্ড বোনস’ লোগো ব্যবহার করে প্রতিবাদের প্রতীক তৈরি করেছে। তবে ক্ষমতার হস্তান্তরের প্রশ্নে তাঁদের স্পষ্ট কোনো রোডম্যাপ নেই।

মাদাগাস্কারের পাহাড়ি রাজধানী আনতানানারিভোর ‘মে ১৩ স্কয়ার’ দেশটির ১৯৭২ সালের ছাত্র আন্দোলনের স্মৃতিবাহী স্থান। এখানেই জেন-জিরা কর্নেল র‍্যানড্রিয়ানিরিনার শপথ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউ বিয়ার খাচ্ছে, কেউ গ্রিল করা স্ন্যাকস খাচ্ছে আর মঞ্চে ব্যান্ড সংগীত গাইছে—পতিত রাজোয়েলিনাকে নিয়ে অশ্লীল ব্যঙ্গাত্মক গান।

শিল্পকলার ছাত্র হেনরি রাফেহিভোলা বলেন, রাজোয়েলিনার মতো লোকজন সবারই বিদেশি নাগরিকত্ব থাকে। দেশ খারাপ হলে তাঁরা ফ্রান্সে পালিয়ে যান।

রাজোয়েলিনার সমালোচকেরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন, তিনি ফ্রান্সের (সাবেক ঔপনিবেশিক) কাছের মানুষ এবং বিদেশি প্রভাবের কাছে নত।

সরকার পতনের পর মাদাগাস্কারের পানির সমস্যার তড়িত সুরাহা হয়নি। এখন সন্ধ্যা নামলে আন্দ্রিয়ানাইভো ‘মে ১৩ স্কয়ার’ থেকে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের মতোই তাঁর বাড়িতেও পানি নেই।

প্রতিদিন তিনি কমিউনিটি ট্যাপ থেকে পানি সংগ্রহ করেন, যেটি দিনে কয়েক ঘণ্টা খোলা থাকে। দুটি হলুদ জেরিক্যান কাঁধে নিয়ে তিনি সরু গলির ভেতর দিয়ে দুই কামরার টিনশেড বাড়িতে ফেরেন, যেখানে ঝুলছে একটিমাত্র বাল্ব।

আন্দ্রিয়ানাইভোর ৭৮ বছর বয়সী দাদি তাঁকে জড়িয়ে ধরেন এবং নাতির আন্দোলনে অংশ নেওয়া নিয়ে উদ্বেগ জানান। দাদি বলেন, ‘আমি সামরিক শাসন পছন্দ করি না, আগেও তাদের অধীনে থেকেছি।’ আন্দ্রিয়ানাইভো শুধু কাঁধ ঝাঁকান। তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরের বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার পানি ফিরেছিল, কিন্তু মাত্র কয়েক দিনের জন্য। এখনো পানি নেই।

নিরুপায় স্বরে আন্দ্রিয়ানাইভো বলেন, ‘আমাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সেনাবাহিনীর ওপর বিশ্বাস করতেই হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...