Ajker Patrika

কোন পথে ‘পুরোপুরি বিধ্বস্ত’ অর্থনীতির শ্রীলঙ্কা

আব্দুর রহমান
কোন পথে ‘পুরোপুরি বিধ্বস্ত’ অর্থনীতির শ্রীলঙ্কা

১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর সবচেয়ে নাজুক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। নিকট ইতিহাসে ইউরোপের দেশ গ্রিস এমন সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। দেশটি প্রায় দেউলিয়া হতে হতে বেঁচে গেছে। এখনো গ্রিস আগের জৌলুশ ফিরে পায়নি। তবে কী শ্রীলঙ্কাও সেই পথেই হাঁটছে? 

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট এতটাই তীব্র যে, দেশটির নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য, জ্বালানি তেল এমনকি ওষুধ কেনার প্রয়োজনীয় অর্থ নেই। দেশটির প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে গতকাল বুধবার জানিয়েছেন, তাদের অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপ দেশটির এমন ভয়াবহ বিপর্যয় কেন? 

বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশটির নেতা পর্যায়ে ব্যাপক ভুল ব্যবস্থাপনা এবং দেশটির জনগণের কিঞ্চিৎ দুর্ভাগ্য মিলিয়েই এই বিপর্যয়। বিশ্লেষক জেসি ইয়ুংয়ের মতে, ২০১৮ সাল থেকে বিপর্যয় শুরু হলেও তা ভয়াবহ রূপ নেয় কোভিড মহামারির কারণে। এই মহামারিই দেশটির জনগণের দুর্ভাগ্য। কিন্তু বিপর্যয়ের শুরু এবং তা ভয়াবহ হওয়ার জন্য ব্যাপক ভুল ব্যবস্থাপনাই দায়ী। 

২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের দমনের পর থেকেই শ্রীলঙ্কায় ভুল ব্যবস্থাপনার শুরু। দেশটির আমদানিনির্ভর অর্থনীতিকে রপ্তানিমুখী না করে সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দেয়। ফলে আমদানি করতে গিয়ে টান পড়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। ২০১৯ সালেও ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ ছিল শ্রীলঙ্কার। সর্বশেষ গত মে মাসে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার। বিশ্লেষক আয়েশা পেরেরার মতে, সরকারের রপ্তানি বৃদ্ধি না করার নীতিই দেশটির জন্য কাল হয়েছে। 

সমালোচকেরা আরও বলছেন, দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে এবং তাঁর ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষেই মূলত এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২০১৯ সালে দেশটিতে কর হ্রাসের সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তে দেশটির রাজস্ব আয় ভয়াবহ ধাক্কা খায়। দেশটির সাবেক অর্থমন্ত্রী আলী সাবরি বলেছেন, মাহিন্দার এই সিদ্ধান্তের কারণে দেশটি প্রতিবছর অন্তত ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয় হারিয়েছে। 

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট সচিবালয়ের সামনে জনগণের বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্সএর সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয় সার আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত। আইএমএফ চলতি বছরের মার্চে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ‘সার আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্তে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস চা ও রাবারশিল্প ধ্বংসের মুখে পড়ে।’ সঙ্গে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে দেশটির কৃষি খাতও। সর্বশেষ এর সঙ্গে যুক্ত হয় করোনাভাইরাস। এই বৈশ্বিক মহামারির কারণে দেশটির বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস পর্যটনশিল্প বন্ধ হয়ে যায়। টানা প্রায় দুই বছর এই খাত থেকে একটি পয়সাও আয় করতে পারেনি দেশটি। সব মিলিয়ে নেতৃত্বের ভুল ব্যবস্থাপনা ও মহামারির কারণে ডুবতে বসেছে দেশটি। 

শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বিপরীতে রিজার্ভ আছে মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলারের আশপাশে। বিশাল এই পার্থক্য থেকে খুব সহজেই বোঝা যায়, দেশটির সংকট কতটা ভয়াবহ। কিন্তু উত্তরণের উপায় কী? কী করছে দেশটি সংকট উত্তরণে? 

দেশটির জনগণ রাজাপক্ষে পরিবারের শাসনের প্রতি অনাস্থা দেখিয়ে প্রবল বিক্ষোভ–প্রতিবাদ করেছে। রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি উঠেছে। তারই সূত্র ধরে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হ্রাসের একটি প্রস্তাব এরই মধ্যে মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে। পার্লামেন্টে পাস হলে তা আইনে পরিণত হবে। কিন্তু কেবল রাজনৈতিক সংস্কার দেশটির সংকট নিরসন করতে পারবে না। এ জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক সংস্কার। দেশটি এরই মধ্যে ব্যয় সংকোচন নীতি বাস্তবায়নের দিকে এগিয়েছে। কিন্তু যেতে হবে আরও বহুদূর। 

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ইউএসএইড ১২ মিলিয়ন ডলার, অস্ট্রেলিয়া ৫০ মিলিয়ন ডলার সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। ভারত এরই মধ্যে ৬৫ হাজার টন ইউরিয়া সার, ৪ লাখ টন জ্বালানি পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। ওদিকে বিশ্বব্যাংক দেশটিকে ৬০০ মিলিয়ন ডলার এবং ভারত প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার (১ দশমিক ৯ বিলিয়ন) ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জি-৭ ভুক্ত দেশগুলো সহায়তার কথা জানালেও সে বিষয়ে এখনো তেমন অগ্রগতি হয়নি। চীনের কাছে শ্রীলঙ্কার দায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলার। এখন উভয় পক্ষই ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছে। 

বড় বড় দালান থাকার পরও ধসে পড়েছিল শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। ছবি: রয়টার্স আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে চীন, ভারত, জাপানের সঙ্গে দাতা সম্মেলনের কথাও বলেছেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের ভারত, জাপান ও চীনের সহায়তা প্রয়োজন। তারা আমাদের ঐতিহাসিক মিত্র।’ ভারতের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের শ্রীলঙ্কা সফরের কথা ছিল ২৩ জুন। সেখানে দিল্লির প্রতিশ্রুত ঋণ এবং অন্যান্য সহায়তার বিষয়ে আলোচনা হয়। আগামী সপ্তাহে ইউএস ট্রেজারির একটি বিশেষ প্রতিনিধিদল যাবে শ্রীলঙ্কায়। সেখানেও যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে শ্রীলঙ্কাকে ঋণসহায়তা দেওয়া যায় কি না, তার সম্ভাব্যতা নিয়ে আলাপ করা হবে। 

তবে এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় ত্রাতা হতে পারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই মুহূর্তে সংকট কাটাতে শ্রীলঙ্কার প্রয়োজন অন্তত ৫ বিলিয়ন ডলার এবং এই অর্থের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা হতে পারে আইএমএফ। কলম্বোভিত্তিক থিংকট্যাংক অ্যাডভোকাটা ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান মুর্তাজা জাফ্রেজি বলছেন, ‘শ্রীলঙ্কার জন্য আইএমএফই একমাত্র উপায়। এর বাইরে কোনো বিকল্প নেই।’ যদিও সমাধানের এই পথটি নিয়ে সন্দেহ আছে অনেক বিশ্লেষকেরই। 

অন্য কোনো বিকল্প থাক বা না থাক শ্রীলঙ্কার জনগণের জন্য এই সংকট দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সবচেয়ে বেশি জরুরি। একমাত্র সম্মিলিত সহায়তাই হয়তো সেই পথে নিয়ে যেতে পারে শ্রীলঙ্কাকে। 

তথ্যসূত্র: বিবিসি, সিএনএন, ইন্ডিয়া টাইমস, ভয়েস অব আমেরিকা ও আল জাজিরা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তেহরান ওপর থেকে সুন্দর, একদিন যেতে চাই: ইরানে বোমা ফেলা ইসরায়েলি পাইলট

যুদ্ধের পর এ যেন এক নতুন ইরান, জনগণের মতো বদলে গেছে সরকারও

ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কথা ভাবছেন ট্রাম্প

সাইপ্রাসে বিপুল জমি কিনছে ইসরায়েলিরা, দেশ বেদখলের শঙ্কা রাজনীতিবিদদের

বংশ রক্ষায় মৃত ছেলের শুক্রাণু চান মা, সংরক্ষণের নির্দেশ মুম্বাই হাইকোর্টের

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত