Ajker Patrika

বিবিসির প্রতিবেদন /হাসিনা-উত্তর বাংলাদেশের এক বছর: আছে অর্জন, সামনে বন্ধুর পথ

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১০ আগস্ট ২০২৫, ১৬: ১৫
শেখ হাসিনার পতনের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাধারণ জনতার উচ্ছ্বাস। ছবি: আজকের পত্রিকা
শেখ হাসিনার পতনের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাধারণ জনতার উচ্ছ্বাস। ছবি: আজকের পত্রিকা

শেখ হাসিনার পতনের বর্ষপূর্তি উদ্‌যাপন ও বাংলাদেশের এক নতুন ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতির আশায় হাজারো মানুষ গত সপ্তাহে ঢাকায় জড়ো হয়েছিলেন। বর্ষাস্নাত দিনটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে নেতা, অধিকারকর্মীদের উপস্থিতিতে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক ‘নয়া বাংলাদেশের’ ঘোষণাপত্র উন্মোচন করেছেন।

দেশের বিভিন্ন স্থানে কনসার্ট হয়েছে, জাতীয় পতাকা ওড়ানোসহ শোভাযাত্রা হয়েছে। কোথাও কোথাও আবার শোকরানা নামাজ, বিশেষ প্রার্থনারও আয়োজন করা হয়েছিল। অনেকে শেখ হাসিনার পতনকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে আখ্যা দেন। কিন্তু দ্বিতীয় স্বাধীনতা উদ্‌যাপনে প্রাণোচ্ছল এসব কর্মকাণ্ড বিগত ১২ মাসের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, দেশে গণপিটুনি, জনতার সহিংসতা বা মব, প্রতিশোধমূলক হামলা এবং তথাকথিত ধর্মীয় উগ্রবাদের পুনরুত্থানের ঘটনা ঘটছে। এসবই দেশের গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রাকে বিপথে নেওয়ার হুমকি তৈরি করেছে।

আর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নাটকীয়ভাবে ক্ষমতা হারানো হাসিনা এখন প্রতিবেশী ভারতে অবস্থান করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি প্রাণঘাতী দমনপীড়নে নিজের ভূমিকা অস্বীকার করছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ অস্বীকার করে দেশে ফিরে বিচারের মুখোমুখি হতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন।

নারী অধিকারকর্মী ও নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা শিরিন হক বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমরা সরকার পরিবর্তন দেখেছি, বিপ্লব নয়। মূলত নারীবিদ্বেষ এখনো অটুট, পুরুষতান্ত্রিক প্রভাব অক্ষত রয়েছে।’ তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান ছিলেন। এই কমিশন গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদের লক্ষ্য নিয়ে হওয়া গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা অনুযায়ী সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার জন্য গঠন করা হয়েছিল।

চলতি বছরের এপ্রিলে ১০ সদস্যের এই কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে নারীর উত্তরাধিকার ও তালাকের অধিকার নিশ্চিত করে লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং যৌনকর্মীদের অধিকার সুরক্ষার সুপারিশ করা হয়। যেখানে যৌনকর্মীদের পুলিশ ও অন্যদের দ্বারা নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনা খুব সাধারণ।

এর পরের মাসে, হাজারো ইসলামি কট্টরপন্থী এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁরা দাবি করেন, এসব সুপারিশ ইসলামবিরোধী এবং অধিকারের প্রশ্নে ‘পুরুষ ও নারী কখনো সমান হতে পারে না’। প্রতিবাদকারীরা নারী কমিশন ভেঙে দেওয়া এবং এসব প্রস্তাব দেওয়ার জন্য কমিশনের সদস্যদের শাস্তির দাবি জানান।

এরপর অবশ্য কমিশনের প্রস্তাবগুলো নিয়ে আর কোনো প্রকাশ্য বিতর্ক হয়নি। তবে শিরিন হক হেফাজতে ইসলামের ওপর দায় চাপিয়ে বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের হাতে আমরা যখন প্রচুর নিগ্রহের শিকার হয়েছিলাম, তখন অন্তর্বর্তী সরকার আমাদের যথেষ্ট সমর্থন দেয়নি—এটা আমাকে হতাশ করেছে।’ এই অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলেও ড. ইউনূসের কার্যালয় কোনো সাড়া দেয়নি।

অধিকারকর্মীরা বলছেন, নারী কমিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কেবল একটি উদাহরণ। এ থেকে দেখা যায়, হাসিনার আমলে প্রান্তিক করে রাখা ডানপন্থীরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। তারা দেশের কিছু এলাকায় মেয়েদের ফুটবল ম্যাচ খেলার বিরোধিতা করেছে। নারী তারকাদের বাণিজ্যিক প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নিয়েও আপত্তি তুলেছে। এমনকি, কিছু ক্ষেত্রে নারীদের পোশাকের কারণে প্রকাশ্যে হয়রানি করার মতো ঘটনাও ঘটেছে।

কেবল নারীরাই নয়, সংখ্যালঘু সুফি মুসলিমদের অনেক মাজারও গত এক বছরে কট্টরপন্থীদের হাতে ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। এরপরও, শিরিন হকের মতো অনেকে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকলেও, বাংলাদেশ এখনো অতীতের মুখোমুখি।

হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে এখনো তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে বাংলাদেশে। এই দল যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা বেআইনি হত্যাকাণ্ড, গুম এবং ভিন্নমত দমন করেছে—এমন অভিযোগ রয়েছে, প্রমাণও আছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণকারী সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশে এমন এক বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা কেবল জবাবদিহিই নয়, প্রতিশোধ এবং প্রতিকারও দেখতে চেয়েছে।’ তবে তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে যে অবিচার ছিল, তা বজায় রাখা বা সেটার অনুকরণ করা এখন চলতে পারে না।’

তবে আওয়ামী লীগের দাবি, দেশে ঠিক সেটিই ঘটছে, যেমনটা তাদের আমলে ছিল। দলটির দাবি, গত এক বছরে তাদের শ খানেক সমর্থককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তবে এর পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দিতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকার তথ্যপ্রমাণ দিয়ে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

অবশ্য আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে কয়েক মাস ধরে কারাগারে রাখা হয়েছে। সমালোচকদের অভিযোগ, এসব হত্যা মামলার কোনো সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। কেবল অতীতে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করার কারণে তাঁদের আটক রাখা হয়েছে।

তবে সমালোচকদের এমন অভিযোগের প্রতিবাদ জানিয়েছেন ছাত্রনেতা ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর স্থিতি ফিরতে সময় লাগে। আমরা এখন এক অন্তর্বর্তী পর্যায়ে আছি।’ তিনি এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং কিছুদিন আগে পর্যন্তও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

অবশ্য নাহিদ ইসলাম স্বীকার করেন, দেশ নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। যদিও ইসলামপন্থার প্রভাব বৃদ্ধির আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতে, এটি ‘একটি বিস্তৃত সাংস্কৃতিক সংগ্রামের অংশ’, যা বহু বছর ধরে চলছে।

বাংলাদেশে গত এক বছরে উন্নতিরও কিছু লক্ষণ রয়েছে। অনেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল করার কৃতিত্ব দিচ্ছেন। আশঙ্কার বিপরীতে ব্যাংকিং খাত টিকে গেছে। বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেছে, খাদ্যের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল এবং প্রবাসী আয় ও আন্তর্জাতিক ঋণের সহায়তায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মজুত রেখেছে। রপ্তানিও স্থিতিশীল। এ ছাড়া আছে এমন কিছু অদৃশ্য পরিবর্তন, যেগুলো পরিমাপ করা কঠিন।

নাহিদ ইসলামের দাবি, হাসিনার পতনের পর দেশে ‘একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, এখন সবাই স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারছে’। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক অভ্যুত্থান, হত্যাকাণ্ড ও তীব্র রাজনৈতিক বিরোধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা একটি দেশের জন্য এটি উদ্‌যাপনের বিষয়। তবে অনেকে আবার সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ছাত্রনেতাদের প্রভাব সমালোচিত হয়েছে বছরজুড়ে। নজিরবিহীন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁদের সরকারে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে মন্ত্রিসভায় দুই ছাত্রনেতা রয়েছেন। সমালোচকদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করার মতো কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছাত্রনেতাদের চাপে নেওয়া হয়েছে।

ডেভিড বার্গম্যান বলেন, ‘সরকার মাঝে মাঝে কিছু জনমুখী দাবিতে সাড়া দিয়েছে, বিশেষ করে ছাত্রদের দাবিতে। কারণ, আশঙ্কা ছিল যে অন্যথায় আরও বড় প্রতিবাদ হতে পারে। তবে এটি নিয়মের চেয়ে ব্যতিক্রমই বেশি ছিল।’

এদিকে নির্বাসিত আওয়ামী লীগ নেতারা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের সমর্থকদের চুপ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। অধিকাংশ নেতা হয় কারাগারে, নয়তো নির্বাসনে। হাসিনার মন্ত্রিসভার সাবেক তথ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে গণপিটুনির ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যুও অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা একটি স্বৈরশাসন উৎখাত করেছি। কিন্তু যদি স্বৈরতান্ত্রিক চর্চার ইতি না টানি, তাহলে নতুন বাংলাদেশ গড়তে পারব না।’

বাংলাদেশ এখন এক সংকটময় মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আগামী ছয় মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেকের মতে, যদি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থবহ পরিবর্তন না আসে, তাহলে যে মানুষগুলো গণ-অভ্যুত্থানে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ফেল করায় বকা খেয়ে বাড়ি ছাড়ে বাংলাদেশি কিশোরী, ভারতে ৩ মাসে ২০০ লোকের ধর্ষণ

রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী আটক

আগামী সপ্তাহের মধ্যে ৫ ইসলামী ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু: গভর্নর

মৌচাকে হাসপাতালের পার্কিংয়ে প্রাইভেট কার থেকে উদ্ধার দুই মরদেহের পরিচয় মিলেছে

চলন্ত বাইকে বাঁধা নারীর লাশ, পুলিশের ধাওয়া

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত