Ajker Patrika

একই পরিবারের ৪ সদস্যের লাশ উদ্ধার

‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে’, চিরকুটে লেখা

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১৫: ৩২
একই পরিবারের চারজনের মৃত্যুতে স্বজনদের কান্না। ছবি: আজকের পত্রিকা
একই পরিবারের চারজনের মৃত্যুতে স্বজনদের কান্না। ছবি: আজকের পত্রিকা

রাজশাহীতে একই পরিবারের চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আজ শুক্রবার দুপুরে জেলার পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বামনশিকড় গ্রাম থেকে লাশগুলো উদ্ধার করা হয়। মৃত চারজন হলেন—মিনারুল ইসলাম (৩০), তাঁর স্ত্রী মনিরা খাতুন (২৮), ছেলে মাহিম (১৪) ও মেয়ে মিথিলা (৩)।

বামনশিকড় পবা উপজেলায় হলেও এলাকাটি পড়েছে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) মতিহার থানায়। মতিহার থানার পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। এর আগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আলামত সংগ্রহ করে। গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে স্ত্রী-সন্তানদের শ্বাসরোধে হত্যার পর মিনারুল আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

একটি ঘরের বিছানায় ছিল মনিরা ও শিশুকন্যা মিথিলার লাশ। পাশের ঘরের বিছানায় ছিল মাহিমের লাশ। এ ঘরেই ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় মিনারুলের লাশ ঝুলছিল। ঘর থেকে দুটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছে। এটি মিনারুল লিখে গিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। হাতের লেখাটি মিনারুলেরই বলে স্বজনেরা পুলিশকে জানিয়েছেন।

একটি চিরকুটে লেখা আছে, ‘আমি মিনারুল নিচের যেসব লেখা লিখব, সব আমার নিজের কথা। লিখে যাচ্ছি এ কারণে, আমরা চারজন আজ রাতে মারা যাব। এই মরার জন্য কারও কোনো দোষ নেই। কারণ, লিখে না গেলে বাংলার পুলিশ কাকে না কাকে ফাঁসিয়ে টাকা খাবে। আমি মিনারুল প্রথমে আমার বউকে মেরেছি। তারপর আমার মাহিনকে মেরেছি। তারপর আমার মিথিলাকে মেরেছি। তারপর আমি নিজে গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছি।’

আরেকটি চিরকুটে লেখা, ‘আমি নিজ হাতে সবাইকে মারলাম। এ কারণে যে, আমি একা যদি মরে যাই, তাহলে আমার বউ, ছেলে, মেয়ে কার আশায় বেঁচে থাকবে? কষ্ট আর দুঃখ ছাড়া কিছুই পাবে না। আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে। এত কষ্ট আর মেনে নিতে পারছি না। তাই আমাদের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলাম, সেই ভাল হলো।’

মিনারুলের চাচি জানেহার বেগম জানান, রাতে মিনারুলের স্ত্রী মনিরা তার মেয়েকে নিয়ে এক ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। আর অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে ঘুমিয়েছিল পাশের ঘরে। রাত ১০টার দিকে মিনারুল বাড়ি ফেরেন। ততক্ষণে একই বাড়িতে মিনারুলের বড় ভাই রুহুল তাঁর স্ত্রী দিলরুবা এবং মেয়ে হিমুকে নিয়ে আলাদা ঘরে ঘুমিয়ে যান। আর বাড়ির উঠোনে ঘুমিয়ে পড়েন মিনারুলের বাবা রুস্তম আলী এবং মা আনজুরা বেগম। রাতে বাড়িতে এমন ঘটনা ঘটেছে তা কেউই টের পাননি। সকাল ৮টার দিকে আনজুরা মিনারুলের নাম ধরে ডেকেই যাচ্ছিলেন। সাড়া না পেয়ে রুস্তম আলী ঘরের টিনের ওপর উঠে ভেতরে তাকিয়ে দেখেন, ঘরে মিনারুলের মরদেহ ঝুলছে। পরে দুই ঘরের দরজা কেটে ভেতরে ঢুকলে চারজনেরই লাশ পাওয়া যায়। এরপর খবর পেয়ে পুলিশ আসে।

জানেহার বেগম বলেন, ‘মিনারুলের কয়েকটা কিস্তি ছিল। কিস্তির কারণে বাড়িতে থাকত না। মাঝে মাঝেই কিস্তির জন্য লোক আসত। আমরা বুঝিয়ে পাঠাতাম যে, মিনারুল বাড়িতে নাই। মিনারুল কখনো কৃষিকাজ, কখনো ট্রাকের হেলপার, আবার কখনো পুকুরের মাছ ধরার জাল টানা শ্রমিক হিসেবে কাজ করত। তার রাগ ছিল বেশি। কেউ একটু কটু কথা বললেই রাগ করে চলে আসত। তারপর আর কাজে যেত না। অভাব লেগে থাকত।’

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ আলী মুর্শেদ জানান, দুই দিন আগে মিনারুল তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তাঁর ঘরে চাল নেই। তিনি ২ হাজার টাকা বের করে দিয়েছিলেন চাল কেনার জন্য। চেয়ারম্যান জানান, মিনারুল আগে থেকেই ঋণগ্রস্ত। বছর তিনেক আগে তাঁরা এটা নিয়ে বসেছিলেন। তাঁর বাবাকে অনুরোধ করিয়ে পাঁচ কাঠা জমি বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ পরিশোধ করান। কিন্তু পরে আবার কিস্তি নিয়েছিলেন মিনারুল। এলাকার লোকজন জানেন, মিনারুল জুয়া খেলতেন। এ কারণে দেনায় ফেঁসে যেতেন।

সকালে বাড়ির উঠানে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন স্বজনেরা। কাঁদতে কাঁদতে মিনারুলের মা বলছিলেন, ‘ও জান! এই কইরি গেলি ক্যানরে বাপ! আমি মাটি বেইচি আবার দিতুক রে জান। বাপের এক কাঠা পাইছি, ওডি বেইচি আবার দিতুক রে বাপ। আমার তো কিছুই থাইকল না।’

সকালে খবর পেয়ে যান রাজশাহী নগর পুলিশের কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্ত্রী ও মেয়েকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে আমাদের কাছে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে। ছেলেকেও শ্বাসরোধ করে হত্যার মতো মনে হচ্ছে। মিনারুল আত্মহত্যা করেছেন বলে মনে হচ্ছে। আরও তদন্তের পর আমরা প্রকৃত কারণটা জানতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হবে। কীভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছে সেটা ময়নাতদন্তের পরই নিশ্চিত করে বলা যাবে। আর জুয়ার বিষয়গুলো এখনো আমরা নিশ্চিত না। মিনারুলের এ রকম অভ্যাস ছিল কি না, সেটা আমরা জানি না। আত্মীয়স্বজন পুলিশকে বলেছেন, চিরকুটের লেখাটা মিনারুলেরই। সেখানে আর্থিক সমস্যার কথা উঠে এসেছে। আমরা বিষয়গুলো তদন্ত করব।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে’, চিরকুটে লেখা

বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত আমদানির ঘোষণা দিতেই ভারতে হু হু করে বাড়ছে চালের দাম

ফেসবুকে ছাত্রলীগ নেতার ‘হুমকি’, রাবিতে ১৫ আগস্টের কনসার্টে যাচ্ছে না আর্টসেল

জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে উচ্চপদস্থ বোর্ড গঠন: আইএসপিআর

পাবনায় প্রবাসীর স্ত্রীকে নিয়ে এএসআই উধাও, থানায় শ্বশুরের জিডি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত