Ajker Patrika

ইরান-ইসরায়েল: একসময়ের ‘বন্ধু’ যেভাবে হয়ে উঠল ঘোরতর শত্রু

আব্দুর রহমান 
আপডেট : ২১ জুন ২০২৫, ১১: ১৯
একসময় বন্ধু হলেও সময়ের ব্যবধানে শত্রু হয়ে উঠেছে খামেনির ইরান ও নেতানিয়াহুর ইসরায়েল। ছবি: সংগৃহীত
একসময় বন্ধু হলেও সময়ের ব্যবধানে শত্রু হয়ে উঠেছে খামেনির ইরান ও নেতানিয়াহুর ইসরায়েল। ছবি: সংগৃহীত

বিগত কয়েক দশক ধরে ইরান-ইসরায়েল শত্রুতা ছিল অন্তরালে, কখনোই তেমন প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর এ দুই দেশ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিন তিনবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ সংঘর্ষ টানা আট দিন ধরে চলছে। ইসরায়েলের দাবি, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি। যদিও কোনো প্রমাণ নেই। আর ইরান বলছে, তারা শান্তপূর্ণ ব্যবহারের জন্যই পরমাণু শক্তি চায়। তাদের অস্ত্র অর্জনের কোনো ইচ্ছা নেই।

ইসরায়েল গত ১৩ জুন ভোরে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা এবং সামরিক কমান্ডারদের ওপর হামলা চালায়। জবাবে ইরানও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। গত বছরও ইসরায়েল ইরানের প্রতিরক্ষা স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল। এর জবাবে ইরানও পাল্টা হামলা করেছিল ইসরায়েলে। তবে সেই সংঘাত ছিল সীমিত পরিসরে।

যাই হোক, আজকের দিনে ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক আন্তর্জাতিক রাজনীতির সবচেয়ে বৈরী ও উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কগুলোর একটি। দেশ দুটি আজ যেমন চিরশত্রু, মাত্র কয়েক দশক আগেও তেমনটা ছিল না। তবে এই শত্রুতার পেছনে লুকিয়ে আছে এক জটিল ইতিহাস। একসময় দুই দেশের মধ্যে ছিল গোপন সহযোগিতা, কৌশলগত জোট ও পারস্পরিক স্বার্থের মিল। একসময় তারা বন্ধু ছিল, পরে গোপনে একে অপরের মিত্র হয়ে ওঠে, আর শেষে পরিণত হয় চিরশত্রুতে।

গাজার ওপর ইসরায়েলের নির্মম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বে সবচেয়ে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানানো দেশগুলোর একটি ইরান। এটি ইরানের দৃঢ় ইসরায়েলবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যের এ দুই দেশকে প্রায়ই ‘চিরশত্রু’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। উভয় দেশ পরস্পরকে অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করে।

দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল-ইরান বৈরিতার কেন্দ্রে রয়েছে ফিলিস্তিন ইস্যু। গাজায় হামলার পাশাপাশি ইসরায়েল লেবানন ও সিরিয়ায়ও মাঝে মাঝেই হামলা চালাচ্ছে। এ দুই দেশেই ইরানের প্রভাব ব্যাপক ছিল। কিন্তু সিরিয়ায় বাশারের পতনের পর এবং লেবাননে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে হিজবুল্লাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এই প্রভাবে ভাটা পড়ে।

গত বছরের ৩১ জুলাই তেহরানে এক বিস্ফোরণে হামাসের তৎকালীন প্রধান ইসমাইল হানিয়া নিহত হন। হামাস ও ইরান এটিকে ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করে। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বৈরুতে নিহত হন হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের নেতা হাসান নাসরুল্লাহ।

তবে ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক সব সময় এমন বৈরিতামূলক ছিল না। একসময় দুই দেশের সম্পর্ক নানা পর্যায়ে উঠানামা করেছে। ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৭৯ সালের বিপ্লব পর্যন্ত শাসন করা পাহলভি রাজবংশের শাসনামলে ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক মোটেই বৈরী ছিল না। বরং, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর তুরস্কের পরই ইরান ছিল দ্বিতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘ যে বিশেষ কমিটি গঠন করে, ইরান ছিল তার ১১ সদস্যের একটি। এই কমিটিতে ইরান, ভারত ও যুগোস্লাভিয়া—এই তিনটি দেশ জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিভাজন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ভোট দেয়। তাদের আশঙ্কা ছিল, এতে এই অঞ্চলে বহু প্রজন্ম ধরে সহিংসতা চলতে পারে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ এরিক কভিন্ডেসল্যান্ড আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ইরান, ভারত ও যুগোস্লাভিয়া একটি বিকল্প পরিকল্পনা দেয়। তাদের প্রস্তাব ছিল একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন—যেখানে একটি পার্লামেন্ট থাকবে, কিন্তু আরব ও ইহুদি অঞ্চলে বিভক্ত থাকবে ফিলিস্তিন। এটাই ছিল ইরানের আপসের প্রস্তাব। তারা চেয়েছিল প্রো-জায়নিস্ট পশ্চিমা বিশ্ব ও প্রতিবেশী আরব-মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে।’

কিন্তু ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল জাতিসংঘ নির্ধারিত সীমার চেয়েও বেশি ভূখণ্ড দখল করে নিলে, ১৯৫০ সালে ইরান—তৎকালীন সম্রাট মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনে—ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। ওই সময় জায়নিস্ট মিলিশিয়ারা ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে তাঁদের ঘরবাড়ি থেকে জোর করে উৎখাত করে। এই ঘটনাকে ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ বা ‘বিপর্যয়’ হিসেবে স্মরণ করে।

কভিন্ডেসল্যান্ড জানান, সে সময় প্রায় ২ হাজার ইরানি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসবাস করতেন এবং যুদ্ধের সময় তাঁদের সম্পত্তি ইসরায়েলি বাহিনী দখল করে। এই সম্পদ রক্ষার জন্যও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তেহরান। তবে এর পেছনে ছিল ইসরায়েলের তথাকথিত ‘পেরিফেরি নীতি।’ সে সময় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিওন মধ্যপ্রাচ্যে একঘরে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজছিলেন। তাই তিনি আরব দেশগুলোর বাইরের রাষ্ট্র—যেমন ইরান, তুরস্ক, ইথিওপিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এর মধ্যে ইরান ও তুরস্কের সঙ্গেই সফল যোগাযোগ হয়।

এরপর, ১৯৫১ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী হন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক। তিনি দেশের তেলশিল্প জাতীয়করণ করেন। এই তেলশিল্প তখন পুরোপুরি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মোসাদ্দেক ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কারণ, তিনি একে পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে দেখতেন।

তবে ইতিহাসবিদ কভিন্ডেসল্যান্ড বলছেন, মোসাদ্দেকের কাছে মূল বিষয় ছিল ব্রিটিশ তাড়ানো, রাজতন্ত্র দুর্বল করা ও আরব দেশগুলোর সমর্থন আদায় করা। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া ছিল ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ বা ‘গৌণ ক্ষতি।’

ইরানে তখন কিছুটা হলেও জায়নবাদবিরোধী চিন্তা ছড়িয়েছিল। প্রভাবশালী শিয়া আলেম নবাব সাফাভি ছিলেন সেই সময়ের অন্যতম কণ্ঠস্বর। তিনি ইসরায়েল ও জায়নিজমের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তবে মোসাদ্দেকের কাছে মূল লক্ষ্য ছিল আরব বিশ্বে সমর্থন পাওয়া।

১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহায়তায় এক অভ্যুত্থানে মোসাদ্দেক সরকার পতনের পর রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। পাহলভি পরিবার পুনরায় ক্ষমতায় ফেরে এবং হয়ে ওঠে পশ্চিমা বিশ্বের ঘনিষ্ঠ মিত্র। এরপর ইসরায়েল তেহরানে একটি দূতাবাস খোলে। ১৯৭০-এর দশকে দুই দেশ দুই দেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয়। তেহরান-তেল আবিবের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বিস্তৃত হয়। ইরান হয়ে ওঠে ইসরায়েলের প্রধান তেল সরবরাহকারী। সে সময় ইসরায়েল হয়ে ইউরোপে তেল পাঠানোর জন্য ইরান একটি পাইপলাইনও নির্মাণ করে।

এই সম্পর্ক ছিল মূলত গোপন, যেন আরব রাষ্ট্রগুলো ক্ষুব্ধ না হয়। কভিন্ডেসল্যান্ড বলেন, ‘ইসরায়েল ইরানকে যতটা প্রয়োজন মনে করত, ইরান ততটা না। ইসরায়েল সব সময়ই বেশি আগ্রহী ছিল। তবে শাহও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে ইসরায়েলকে কাজে লাগাতে চাইতেন।’

ইরানের গোপন পুলিশ সংস্থা সাভাক গঠনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সহায়তা ছিল বলেও ইতিহাসবিদেরা জানান। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর একটি নথিতে বলা হয়েছে, শাহের আমলে ইসরায়েল নিয়মিত ইরানে অস্ত্র বিক্রি করত। নথিতে বলা হয়, ‘এই অস্ত্র বিক্রি ইসরায়েলের নবগঠিত প্রতিরক্ষা শিল্পকে উল্লেখযোগ্যভাবে চাঙা করে তোলে, আর পারস্পরিক বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে ইরান থেকে দরকারি তেল পাওয়া যেত, যার বিনিময়ে ইসরায়েল অস্ত্র ও কারিগরি সহায়তা দিত।’

সিআইএর তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েল ইরাকের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি ইরানের সমর্থনে সহায়তা করতে আগ্রহী ছিল। এর বদলে, ইরানও সম্ভবত ইরাকি সেনাবাহিনী সম্পর্কে কিছু গোয়েন্দা তথ্য মোসাদের সঙ্গে শেয়ার করেছিল। ওই নথিতে আরও বলা হয়েছে, ইরানে বসবাসরত ৯০ হাজার ইহুদির নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করাও ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল। তবে শাহ ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি। ১৯৭৯ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন। ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।

বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ইসলামি আদর্শে দেশ পরিচালনার ডাক দেন। তাঁর দৃষ্টিতে ইসরায়েল ছিল ‘ছোট শয়তান’ আর যুক্তরাষ্ট্র ‘বড় শয়তান’। তিনি বলতেন, এই শক্তিগুলো বিশ্বজুড়ে নিপীড়নের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে।

তেহরান ইসরায়েলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। ইসরায়েলি দূতাবাসকে পরিণত করা হয় ফিলিস্তিনি দূতাবাসে। ইরানি নাগরিকদের জন্য ইসরায়েলে ভ্রমণ নিষিদ্ধ হয়। বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। খোমেনি পবিত্র রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এই দিনটি জেরুজালেমের (যাকে আরবিতে বলা হয় আল-কুদস) মুক্তির দাবিতে প্রতিবছর ইরানে বড় বড় র‍্যালি অনুষ্ঠিত হয়।

কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফটের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসি বলেন, খোমেনি ফিলিস্তিন ইস্যুকে আরব জাতীয়তাবাদের নয়, ইসলামের একটি বিষয় হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে ইরান শুধু এই ইস্যুতে সক্রিয় থাকতেই নয়, নেতৃত্বও দিতে পারে—এমন ভিত্তি গড়ে তোলেন তিনি।

পারসি বলেন, ‘আরব-পারস্য বিভাজন এবং সুন্নি-শিয়া বিভক্তি অতিক্রম করে ইরান ফিলিস্তিন ইস্যুতে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক অবস্থান নেয়। এতে তারা ইসলামি বিশ্বের নেতৃত্বদানের অবস্থান তৈরি করে এবং যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত আরব সরকারগুলোকে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় ঠেলে দেয়।’

১৯৮০—১৯৯০ এর দশকে ইরান ইসরায়েলবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আবির্ভূত হয়। লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং পরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে হামাসকে ইরান প্রশিক্ষণ, অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রধান শত্রু হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতেই ইরান এ ধরনের ভূমিকা নেয়।

সিআইএ—এর তথ্য অনুসারে, ইরান ও ইসরায়েল প্রকাশ্যে একে অপরের শত্রুতে পরিণত হলেও পর্দার আড়ালে দুপক্ষের সম্পর্ক বজায় ছিল। ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া এবং আট বছর ধরে চলা ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইসরায়েল মনে করেছিল, খোমেনির ইসলামি ইরানের চেয়ে সাদ্দাম হোসেনের ইরাকই তাদের জন্য বেশি বিপজ্জনক। সে কারণেই ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে, গোপনে ইরানে অস্ত্র সরবরাহে জড়িয়ে পড়ে।

এই ঘটনা পরবর্তীতে ‘ইরান-কনট্রা কেলেঙ্কারি’ নামে ফাঁস হয়ে যায়। এতে দেখা যায়, ইসরায়েলি মধ্যস্থতায় ইরানে অস্ত্র পাঠানো হচ্ছিল। এর বিনিময়ে লেবাননে বন্দী থাকা মার্কিনিদের মুক্ত করতে সহায়তা এবং নিকারাগুয়ায় মার্কিনপন্থী বিদ্রোহীদের অর্থ জোগানো হচ্ছিল। তখন ইরান-ইসরায়েলের প্রকাশ্য বৈরিতার কথা মাথায় রেখে এই সম্পর্ক অনেককেই বিস্মিত করে। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে এতটাই গোপন সহযোগিতা চলছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছিল—ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্র বা যন্ত্রাংশ ইরানে পৌঁছে দিচ্ছে কিনা।

১৯৮৫ সালের ৭ অক্টোবর তারিখে সিআইএর এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘Israel and Iran: The ties that bind—অর্থাৎ ইসরায়েল ও ইরান: যে বন্ধনে তারা বাঁধা।’ এতে লেখা ছিল, ‘আমাদের ধারণা, ইসরায়েল যে ইরানে অস্ত্র বিক্রি করছে, সেটা ১৯৫০-এর দশকের শেষ থেকেই চলছে এবং এখনো চলছে।’

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘১৯৫০-এর দশকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার পেছনে যে কৌশলগত হিসাব ছিল, সেই একই কারণে ইসরায়েল এখনো এই অস্ত্র বিক্রির প্রতি সহনশীল মনোভাব দেখাচ্ছে। ইসরায়েলিরা আমাদের বলেছে, তারা চায় এই সহায়তা ইরান-ইরাক যুদ্ধকে দীর্ঘতর করুক, যাতে ইরাকের বিশাল সামরিক শক্তি পূর্ব সীমান্তেই আটকে থাকে। তবে তারা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের গোয়েন্দা সহায়তা দেবে না, কারণ এতে ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে এবং ইরান এই তথ্য সিরিয়ার মতো ইসরায়েলবিরোধী দেশের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে।’

সিআইএর ওই গোপন নথিতে আরও বলা হয়, ইসরায়েল বিশ্বাস করত—যুক্তরাষ্ট্র যতই প্রকাশ্যে ইরানকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলুক, শেষ পর্যন্ত উপসাগরীয় স্বার্থ রক্ষার জন্যই যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে হবে। ইসরায়েল মনে করত, ইরান উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের স্বার্থ রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত শক্তি এবং ইসরায়েল আশা করত, ভবিষ্যতে এই গোপন সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার মধ্যস্থতাকারী হতে পারবে।

আজকের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক শোনালেও, তখন ইসরায়েল সত্যিই বিশ্বাস করত, তারা যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। সিআইএ নথিতে বলা হয়, ‘তেল নিয়ে ইসরায়েলের চিন্তা এতটাই গভীর ছিল যে, তারা বিশ্বাস করত, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, তাহলে তারাও ইরান থেকে তেল কিনতে পারবে।’

তবে ইসরায়েল নিশ্চিত ছিল, তাদের এই সহায়তা পুরোপুরি গোপনই থাকবে। সিআইএ নথিতে লেখা হয়, ‘খোমেনি শাসনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শাস্তিমূলক মনোভাব সম্পর্কে ইসরায়েল সচেতন এবং তারা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষককে (যুক্তরাষ্ট্রকে) রাগানোর ঝুঁকি নিতে চায় না। সে কারণে ইসরায়েল এমন মাত্রায় অস্ত্র বিক্রি করবে না, যা আর অস্বীকার করার সুযোগ রাখবে না। মার্কিন উদ্বেগের কারণে ইসরায়েল অতীতে কখনো ইরানকে বড় ধরনের অস্ত্র—যেমন ট্যাংক বা বিমান বিক্রি করেনি।’

১৯৯০-এর দশকে ইরান-ইসরায়েলের এই গোপন সম্পর্কের অবসান ঘটে। কারণ, সে সময়ই ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে, যা ইসরায়েলের জন্য অস্তিত্বগত হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ইরান পরমাণু কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করলে, ইসরায়েল সন্দেহ করে এটি আসলে একটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি প্রকল্প। এরপর ইরান হিজবুল্লাহ, হামাস ও হুতিদের মতো ইসরায়েলবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি তাদের সমর্থন আরও জোরদার করে। ইরান লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র দলগুলো নিয়ে ‘এক্সিস অব রেজিস্যান্স’ বা ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ গঠন করেছে। এই জোট ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে এবং ইসরায়েলকে প্রধান শত্রু মনে করে।

অন্যদিকে ইসরায়েলও বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে, যারা ইরান সরকারবিরোধী এবং সশস্ত্র কার্যক্রম চালায়। তেহরানের ভাষায়, এসব গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে ইউরোপভিত্তিক মুজাহিদীন-ই-খালক (এমইকে), দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের সুন্নি জঙ্গি সংগঠনগুলো এবং ইরাকি কুর্দিস্তানে অবস্থানকারী কুর্দি সশস্ত্র দলগুলো—যাদের ইরান ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে অভিহিত করে।

২০২০-এর দশকে ইরান-ইসরায়েল বিরোধ ‘শ্যাডো ওয়ার’ বা ছায়াযুদ্ধে রূপ নেয়। ড্রোন হামলা, সাইবার যুদ্ধ এবং সমুদ্রপথে নাশকতা—সবই এই সংঘাতের অংশ হয়ে ওঠে। ইরাক, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনে ইরানের প্রভাব যত বেড়েছে, ততই ইসরায়েলও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে এবং ইরানি উপস্থিতি ঠেকাতে বিভিন্ন সামরিক অভিযান চালিয়েছে।

চলতি বছরে এসে এই বৈরিতা আরও ঘনীভূত হয় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির রহস্যজনক দুর্ঘটনায় পড়ে মৃত্যু, তেহরানে ইসমাইল হানিয়া হত্যার পর। এরপর, দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে হামলা করে ইসরায়েল বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) এক শীর্ষ কমান্ডারকে হত্যা করে। এসব ঘটনার আলোকে গাজা যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে, ২০২৪ সালে ইরান ও ইসরায়েল একে অপরের ওপর সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আরব দেশগুলো যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চার চারটি যুদ্ধ লড়েছে একুশ শতকের আগ পর্যন্ত সে সময় ইরান ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সংঘাতেই জড়ায়নি। কিন্তু ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান ক্রমেই ইসরায়েলের বিষয়ে মনোভাব বদলাতে থাকে এবং একপর্যায়ে দুই দেশ চির শত্রুতে পরিণত হয়। আর যে আরব ইসরায়েলের ঘোরতর শত্রু ছিল সেই আরব দেশগুলো এখন ইসরায়েলের একপ্রকার মিত্রে পরিণত হয়েছে।

সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন, ওমান, কুয়েতসহ অনেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে বা করার পথে আছে। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতনের পর নতুন সরকার গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ, কয়েক দশকের ব্যবধানে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ একপ্রকার উল্টে গেছে। ইসরায়েলের এক সময়ের শত্রুরা এখন ‘বন্ধু’ হওয়ার পথে আর এক সময়ের বন্ধু এখন চিরশত্রু।

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা ও ইকোনমিক টাইমস

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত