Ajker Patrika

পশ্চিমের বিপরীতে শক্তিশালী হচ্ছে চীন-রাশিয়া সম্পর্ক

আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২২, ১৫: ২৬
পশ্চিমের বিপরীতে শক্তিশালী হচ্ছে চীন-রাশিয়া সম্পর্ক

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমবর্ধমান হারে ঘনিষ্ঠ হয়েছে চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক। ঘনিষ্ঠ হয়েছে বাণিজ্যিক সম্পর্কও। দুই দেশের মধ্যকার এই অংশীদারত্ব দেশ দুটির জন্য নতুন সুযোগ ও সংকট—উভয়ই এনেছে। সুযোগের কথা বলতে গেলে বলা যায়, ইউক্রেন আক্রমণের ফলে পশ্চিমা বিশ্ব যখন রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন মাত্রায় অবরোধ আরোপ করেছে, তখন তা কাটিয়ে উঠতে চীনের সহায়তা রাশিয়ার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। যদিও দুই দেশের সম্পর্ক থেকে রাশিয়া চলমান এই অবরোধের মধ্যে কীভাবে এবং কী পরিমাণে চীনের কাছ থেকে উপকৃত হবে, তা কোনো পক্ষ থেকেই এখনো আলোচিত হয়নি।

চীনা শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুসারে, গত বছর চীন ও রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য প্রায় ৩৬ শতাংশ (৩৫ দশমিক ৯ শতাংশ) বেড়ে রেকর্ড ১৪ হাজার ৬৯০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। রাশিয়া চীনের তেল-গ্যাস-কয়লা এবং কৃষিপণ্যের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করছে। মজার ব্যাপার হলো, চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্বিতীয় এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হওয়া সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যে রাশিয়াই উদ্বৃত্তের দিকে রয়েছে। 

দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য বৃদ্ধির অন্যতম আরেকটি কারণ—২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখলের পর পশ্চিমা বিশ্বের রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা। সেই নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত চীন-রাশিয়ার মধ্যকার বাণিজ্য বেড়েছে অন্তত ৫০ শতাংশেরও বেশি। এই সময়ে চীনের অন্যতম বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য হয়ে উঠেছে রাশিয়া। 

দুই দেশেরই লক্ষ্য ছিল ২০২৪ সালের মধ্যে দেশ দুটির মধ্যকার মোট বাণিজ্য ২০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করা। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বেইজিং সফরে গেলে বাণিজ্যের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। নতুন লক্ষ্য অনুযায়ী, দুই পক্ষই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২৫ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করতে চায়। 

রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পর চীন তার মিত্র দেশের যন্ত্রণা প্রশমনে হয়তো দেশটি থেকে আমদানি আরও বাড়াতে পারে। তবে একই সঙ্গে চীনকে এই বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে যে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করায় দেশটিও অবরোধের মুখে পড়তে পারে। 

চীন-রাশিয়ার মধ্যকার মূল বাণিজ্যিক সহায়তার ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে—

পশ্চিমের বিপরীতে শক্তিশালী হওয়া চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক নতুন বৈশ্বিক মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছেতেল-গ্যাস
বিগত বছরগুলোতে চীনে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস রপ্তানি ক্রমশ বেড়েছে। সৌদি আরবের পর রাশিয়াই চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী দেশ। চীন সরকারের তথ্যমতে, গত বছর প্রতিদিন গড়ে ১৫ লাখ ৯০ হাজার ব্যারেল তেল আমদানি করেছে। শতকরা হিসাবে চীনের আমদানি করা তেলের সাড়ে ১৫ শতাংশই আসে রাশিয়া থেকে। এই তেলের প্রায় ৪০ শতাংশই আসে পূর্ব সাইবেরিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর (ইএসপিও) পাইপলাইনের মাধ্যমে। রাশিয়ার পূর্ব সাইবেরিয়া থেকে চীন পর্যন্ত পাইপলাইনটির দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ৭০ কিলোমিটার। এই পাইপলাইন নির্মাণে চীন ৫ হাজার কোটি ডলার অর্থায়ন করেছিল। 

কেবল তেলই নয় রাশিয়া চীনের গ্যাসের চাহিদা পূরণেরও অন্যতম অংশীদার। চীনে গ্যাস সরবরাহকারী দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়ার অবস্থান তৃতীয়। ২০২১ সালে চীন রাশিয়া থেকে সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ঘনমিটার (বিসিএম) গ্যাস রপ্তানি করেছে। সার্বিকভাবে রাশিয়া চীনের গ্যাসের চাহিদার প্রায় ৫ শতাংশ পূরণ করে।

‘পাওয়ার অব সাইবেরিয়া’ পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে গ্যাস সরবরাহ করে রাশিয়া। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে—রাশিয়া গ্যাস রপ্তানি করতে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষত ইউরোপ অভিমুখে যেসব পাইপলাইন নির্মাণ করেছে, তা থেকে এটি একেবারেই আলাদা। ফলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার গ্যাস বাণিজ্য বন্ধ হলেও চীনের সঙ্গে গ্যাস বাণিজ্যে খুব একটা প্রভাবিত হবে বলে মনে হয় না। ২০১৯ সালের শেষ দিকে এই পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস বাণিজ্য শুরু হয়েছিল। এবং এই পাইপলাইন ব্যবহার করে ২০২৫ সালের মধ্যে চীনে গ্যাসের সরবরাহ ৩৮ বিলিয়ন ঘনমিটারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে উভয় দেশের। ২০২১ সালে রাশিয়া থেকে চীনে যাওয়া গ্যাসের পরিমাণ ছিল সাড়ে ১০ বিলিয়ন ঘনমিটার। সব মিলিয়ে আগামী ৩০ বছর চীনে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে। চীনে রুশ গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে মঙ্গোলিয়া হয়ে চীন পর্যন্ত ‘পাওয়ার অব সাইবেরিয়া-২’ নামে আরেকটি পাইপলাইন নির্মাণের চিন্তা করছে চীন। এই পাইপলাইনের সরবরাহ ক্ষমতা ধরা হচ্ছে বছরে ৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার। 

কেবল তেল-গ্যাসেই সিনো-রুশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক থেকে নেই। এগিয়েছে আরও অনেক দূর। ২০২১ সালে রাশিয়া চীনের দ্বিতীয় কয়লা সরবরাহকারী দেশ ছিল। এসব ছাড়িয়ে, গত মাসে পুতিন চীনের সঙ্গে তেল-গ্যাস বিক্রিতে আনুমানিক ১১ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার মূল্যের নতুন চুক্তি উন্মোচন করেছেন। 

খাদ্য বাণিজ্য
চীনের সঙ্গে রাশিয়ার খাদ্য বাণিজ্যের আকার ছোট হলেও ক্রমশ তা প্রসারিত হচ্ছে। ২০১৯ সালে চীন রাশিয়ার যেকোনো অঞ্চল থেকে সয়াবিন বীজ আমদানির অনুমতি পায়। দেশ দুটি সয়াবিন সরবরাহ আরও বাড়াতে ও এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও গভীর করতে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। সেই চুক্তির ফলাফল হিসেবে বছরখানেক পরই দেখা যায় চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো রাশিয়ার ভূখণ্ডে সয়াবিন ও মটরশুঁটি চাষ করছে। গত বছর রাশিয়া চীনে সয়াবিন রপ্তানি করেছিল ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৫৮ টন। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৪ সালের মধ্যেই এই পরিমাণ বেড়ে ৩৭ লাখ টনে পৌঁছাবে। 

২০২১ সালে চীন ব্যবসায়ীদের রাশিয়া থেকে গরুর মাংস আমদানির অনুমোদন দেয়। সর্বশেষ গত শুক্রবার, দেশটি রাশিয়ার যেকোনো অঞ্চল থেকে গম আমদানিরও অনুমতি দিয়েছে। রাশিয়া থেকে চীনে রপ্তানি করা খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে মাছ, সূর্যমুখী তেল, সরিষার তেল, পোলট্রি, গমের আটা ও চকলেট। 

বাণিজ্যের খাত কেবল জ্বালানি বা খাদ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এসব সাধারণ খাত ছাড়াও চীন রাশিয়ার ‘দূরপ্রাচ্য অঞ্চল’ থেকে আসা কাঠের অন্যতম বড় ক্রেতা। চীন গত বছর অন্তত ৪১০ কোটি ডলার মূল্যের কাঠ এবং সংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি করেছে। 

এ তো গেল রাশিয়া থেকে চীনের আমদানির কথা। রাশিয়ার অন্যতম আমদানির উৎসও চীন। রাশিয়া চীনের কাছে যান্ত্রিক পণ্য, যন্ত্রপাতি, পরিবহন সরঞ্জাম, মোবাইল ফোন, গাড়ি এবং ভোক্তা পণ্য বিক্রি করে। ২০২১ সালে রাশিয়ায় চীনা পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। বিগত সময়ের তা প্রায় ৩৪ শতাংশ বেশি। 

বিনিয়োগ
রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিনিয়োগের জন্য দেশটিকে চীনমুখী হতে বাধ্য করেছে। দেশটি চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অধীনে অবকাঠামো, জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন প্রকল্পে চীনের আর্থিক সহায়তা নিচ্ছে। কলেজ অব উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি এইড ডেটা নামক একটি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১০৭টি খাতের বিপরীতে চীন রাশিয়াকে ১২৫ বিলিয়ন (১২ হাজার ৫০০ কোটি) ডলার ঋণ দিয়েছে। ওই গবেষণায় আরও বলা হয়, রাশিয়া বেইজিংয়ের রাষ্ট্রীয় খাতে অর্থায়নের সবচেয়ে বড় প্রাপক।

এদিকে ২০১০ সালে চীন ও রাশিয়া দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক লেনদেনের জন্য নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার শুরু করে এবং ২০১৪ সালে তারা নিজেদের মুদ্রায় সহজে লেনদেনের জন্য নিজস্ব ব্যবস্থা চালু করে। ২০২১ সালে চীনের বৈদেশিক বাণিজ্যিক লেনদেনর ২৮ শতাংশ করা হয়েছে ইউয়ানে। আট বছর আগে, ২০১৩ সালে এই হার ছিল মাত্র ২ শতাংশ। এর একটাই কারণ, রাশিয়া-চীন উভয় দেশই চায় বৈদেশিক বাণিজ্যে ডলারের ওপর নির্ভরতা কমাতে। 

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ২০২১ সালের জুন মাসে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ১৩ দশমিক ১ শতাংশই ছিল চীনা মুদ্রা। অথচ এর আগে, ২০১৭ সালে এই পরিমাণ ছিল মাত্র দশমিক ১ শতাংশ। 

ফলে, এ কথা বলা যেতেই পারে রাশিয়া-চীনের মধ্যকার বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক ক্রমশ গভীর হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের বিপরীতে এই দুই দেশের জোটবদ্ধ হওয়া এবং সম্প্রতি রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণ, সেই আক্রমণকে চীনের নীরব সমর্থন ইঙ্গিত দেয় যে—আগামী বিশ্বে নতুন বৈশ্বিক মেরুকরণ আসন্ন। 

চীন-রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক সম্পর্কের মূল্যায়ন নিয়ে রয়টার্স-এর বিশ্লেষণটি অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ পড়ুন এখানে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত