Ajker Patrika

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনপ্রিয়তা বেড়েছে, কিন্তু স্থায়িত্ব কত দিন

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২০ মে ২০২৫, ১৫: ০২
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরের পোস্টার নিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন এক পাকিস্তানি নাগরিক। ছবি: এএফপি
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরের পোস্টার নিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন এক পাকিস্তানি নাগরিক। ছবি: এএফপি

২০২৩ সালের ৯ মে—পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) নেতা ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে রাস্তায় নামে হাজার হাজার মানুষ। দেশটির ইতিহাসে তৈরি হয় এক নজিরবিহীন মুহূর্ত। ইমরান খানের হাজার হাজার সমর্থক রাস্তায় নেমে সেনাবাহিনীসংশ্লিষ্ট একাধিক ভবন ও স্থাপনায় হামলা চালায়। লাহোরে পুড়িয়ে দেয় এক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার বাসভবন, আক্রমণ চালায় রাওয়ালপিন্ডির জেনারেল হেডকোয়ার্টারসহ অন্যান্য সামরিক অবকাঠামোতেও। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ তখন তুঙ্গে।

মাত্র দুই বছর পর, সেই চিত্র একেবারে ভিন্ন। ১১ মে ২০২৫—আবারও পাকিস্তানজুড়ে রাজপথগুলোতে জনসাধারণের ঢল। তবে এবার আর সহিংসতা নয়, বরং সেনাবাহিনীর প্রশংসা করতে রাস্তায় নেমেছে তারা। হাজারো মানুষের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেনাবাহিনীর জয়ধ্বনি। হাতে জাতীয় পতাকা আর সমবেত সুরে নানা দেশাত্মবোধক গানে মুখরিত রাজপথ।

সেনাবাহিনীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে এই আমূল পরিবর্তনের পেছনে ভারতের ‘অপারেশন সিন্দুর’। ভারতের আকস্মিক হামলা রুখে দিয়েই মূলত পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মন পেয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। চার দিনের সংঘাতের পর তাই তাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে সশস্ত্র বাহিনী।

এমনকি কারাবন্দী ইমরান খানও সেনাবাহিনীর সমর্থনে কথা বলেছেন। আইনজীবীদের মাধ্যমে এক বিবৃতি দিয়ে তিনি তাঁর সমর্থকদের সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিতে আহ্বান জানিয়েছেন। গত ১৩ মে সামাজিক মাধ্যম এক্সে পোস্ট করা এক বার্তায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির মনোবলই সশস্ত্র বাহিনীর শক্তি। এ কারণেই আমি বারবার জোর দিয়ে বলেছি, জনগণকে আমরা ত্যাগ করতে পারি না। আমাদের বিচারব্যবস্থায় প্রাণ ফিরিয়ে আনতেই হবে।’

সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষটি সূত্রপাত মূলত এপ্রিলের শেষ দিকে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয় ২৬ জন পর্যটক। কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ না দিয়েই পাকিস্তানকে এই হামলার জন্য দায়ী করে গত ৭ মে গভীর রাতে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এবং পাঞ্জাব প্রদেশে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত। জবাবে পাকিস্তানও পাল্টা হামলা চালায়।

চার দিনের সংঘর্ষে পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে যে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়, সেটিকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়াবহ সামরিক পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ৯ মে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছিল। তাই এটিকে কালো দিবস বলে আখ্যা দেয় পাকিস্তান। এর একদিন পর ১০ মে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। পরদিন, পাকিস্তান সরকার দিনটিকে হক্কানি জিহাদের দিন বা ন্যায়ের জন্য লড়াই বলে ঘোষণা করে।

এই সাম্প্রতিক উত্তেজনার পর পাকিস্তানের জনমনে সেনাবাহিনীর প্রতি যে সমর্থনের ঢেউ উঠেছে, তা সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিরল। গ্যালাপ পাকিস্তানের এক জরিপে দেখা গেছে, ১১ থেকে ১৫ মে পর্যন্ত পরিচালিত এক জরিপে ৯৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেছেন, পাকিস্তান এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। ৮২ শতাংশ সেনাবাহিনীর পারফরম্যান্সকে ‘খুব ভালো’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন, আর ৯২ শতাংশ জানিয়েছেন, সংঘর্ষের পর সেনাবাহিনী সম্পর্কে তাদের অবস্থান ইতিবাচকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।

এই দৃশ্যপট এক অদ্ভুত বৈপরীত্য তুলে ধরে। ২০২৩ সালের মে মাসে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যে গণবিক্ষোভ দেখা গিয়েছিল, তা ছিল দেশটির ইতিহাসে নজিরবিহীন। সেই সময়, ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সহিংসতায় জড়ানো পিটিআই নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয় সেনাবাহিনী। হাজারো কর্মীকে গ্রেপ্তার করে সেনা আদালতে বিচার করা হয়। অনেককে দেওয়া হয় কারাদণ্ড।

লন্ডনভিত্তিক গবেষক মারিয়া রশিদ এই সময়কে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য ‘অপমানজনক পতনের সময়’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। রশিদের মতে, ‘একসময় সেনাবাহিনীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা আর নেই। সেই জায়গা নিয়ে নিয়েছে ভয় আর ঘৃণা।’

তবে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত এবং পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সেই ভয়কে আবারও আস্থায় রূপান্তরিত করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্লেষক মোহাম্মদ বাদার আলমের মতে, বহু বছর ধরেই নিজেদের অস্তিত্ব এবং কর্তৃত্বকে সুনির্দিষ্ট করতে ভারতকে একটি স্থায়ী হুমকি হিসেবে দেখিয়ে আসছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। বিশেষ করে কাশ্মীর ইস্যুতে চারটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এবং একাধিক সীমান্ত লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই সামরিকায়িত রাষ্ট্র কাঠামো আরও দৃঢ় হয়েছে।

ভারতে রাষ্ট্রক্ষমতায় বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কট্টরপন্থী অবস্থান এই হুমকির ধারণা আরও জোরালো করেছে বলে মনে করেন তিনি।

তবে, আন্তর্জাতিক উত্তেজনা আর জাতীয়তাবাদী আবেগে সেনাবাহিনীর প্রতি সাধারণ পাকিস্তানির যে সমর্থন এখন দেখা যাচ্ছে, তা খুব বেশি দিন স্থায়ী হবে না বলেই মনে করেন বেশির ভাগ বিশ্লেষক। নিউইয়র্কের আলবেনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক নিলুফার সিদ্দিকী বলেন, ‘এই সমর্থন কত দিন টিকে থাকবে তা নির্ভর করবে দুটি বিষয়ের ওপর—ভারতের বক্তব্য ও পিটিআইয়ের ভবিষ্যৎ কৌশল। ভারত যদি উসকানিমূলক বক্তব্য না দেয়, একই সঙ্গে পিটিআই যদি আবার বিক্ষোভের ডাক দেয়, সে ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর প্রতি এই অকুণ্ঠ সমর্থন আর না-ও থাকতে পারে।’

মারিয়া রশিদ বলেন, পিটিআই যদি আবার বিক্ষোভের ডাক দেয় এবং ভারত যদি উসকানিমূলক আচরণ না করে, তখন পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকদের একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। তা হলো সীমান্ত রক্ষা, নাকি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ—সেনাবাহিনীর ভূমিকা আসলে কী হওয়া উচিত? দুই ভূমিকার মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি যদি গড়ে তোলা সম্ভব না হয়, তাহলে সেনাবাহিনীর এই জনপ্রিয়তা মুহূর্তেই ধুলায় লুটাবে।

অন্যদিকে, বিশ্লেষক বাদার আলম মনে করেন, সেনাবাহিনীর জন্যও এ ঘটনা একটি শিক্ষা হতে পারে। তিনি বলেন, ‘সাফল্য টিকিয়ে রাখতে হলে জনগণের সমর্থন অপরিহার্য। আর ভারতের সঙ্গে চিরকাল যুদ্ধাবস্থায় থাকা সম্ভব নয়। আমাদের অর্থনীতি ঠিক করতে হবে, তা না হলে সেটাই অস্তিত্বের সংকট তৈরি করবে।’

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সাম্প্রতিক সেনা-জন সম্পর্কের উত্থান-পতনের এই ধারাবাহিকতা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশক হয়ে উঠতে পারে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই জাতীয়তাবাদী আবেগ কি দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে? নাকি এটি আরও এক দমনমূলক ব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে তুলবে?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত