Ajker Patrika

দেবী দুর্গার সূক্তের মন্ত্রদ্রষ্টা যে নারী: অম্ভৃণি

হাসিবা আলী বর্ণা
দেবী দুর্গার সূক্তের মন্ত্রদ্রষ্টা যে নারী: অম্ভৃণি

মহালয়ার ভোর। চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে মর্ত্যে জানানো হয় আহ্বান। জাগেন উমা। শুরু হয় বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার।

দেবী দুর্গার পূজায় দেবী-মাহাত্ম্য বা চণ্ডীপাঠে পাঠ করা হয় ঋগ্‌বেদের বাকসূক্ত, যা ‘দেবীসূক্ত’ নামে খ্যাত।

শাস্ত্রে বলে, ঋষিরা মন্ত্র বানিয়ে লিখতেন না, তাঁরা সেটি দেখতে পেতেন। এই সূক্ত বা মন্ত্রের দ্রষ্টা ছিলেন একজন নারী ঋষি।

ঋগ্‌বেদের বাকসূক্তই বেদের ‘দেবীসূক্ত’। যদিও বেদে দেবী দুর্গার সরাসরি কোনো কথা নেই। তবু পণ্ডিতরা ঋগ্‌বেদের বাকসূক্তকে দুর্গার সূক্ত বলে মনে করেন। এটি নারীশক্তি তথা দেবীশক্তির প্রাচীনতম নিদর্শন। শাক্তপূজার প্রাচীনতম মন্ত্রও এটি। আরও গুরুত্বের বিষয়, এই মন্ত্রের রচনাকারীও একজন নারী।

বেদে পুরুষ দেবতাদের গুণগান করে স্তোত্র বা শ্লোক, সূক্ত তথা মন্ত্রের ছড়াছড়ি। তবে পাশাপাশি দেবীশক্তির মহিমা এবং মাতৃশক্তি উপাসনার প্রাচীন নজির হিসেবে বেশ কিছু সূক্ত মেলে। এর মধ্যে এই বাকসূক্ত অন্যতম।

আনুমানিক সাড়ে ৩ হাজার বছর আগের প্রাচীন ভারত। সেখানে জন্মেছিলেন ঋষি-কবি বাক্। বাক্‌ মানে বাণী। ঋষি অম্ভৃণের কন্যা তিনি, তাই আরেক নাম অম্ভৃণি। একত্রে বাগাম্ভৃণিও বলা হয়। এই বাক্‌ অম্ভৃণি দেবীসূক্ত রচনা করেছেন বলে একে অম্ভৃণিসূক্ত বা বাক্‌সূক্তও বলা হয়।

ঋগ্‌বেদের দশম মণ্ডলের ১২৫তম সূক্ত তাঁর রচিত। এতে মোট আটটি শ্লোক বা মন্ত্র আছে। প্রথম এবং তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্লোক ত্রিষ্টুপ ছন্দে রচিত এবং দ্বিতীয় শ্লোক জগতী ছন্দে রচিত। মন্ত্রগুলোকে একসঙ্গে বৈদিক দেবীসূক্তম বলে। সাধারণভাবে চণ্ডীপাঠের আগে ঋগ্‌বেদের রাত্রিসূক্ত এবং শেষে দেবীসূক্ত পাঠ করা হয়।

বাক্‌ অম্ভৃণি ঋগ্‌বেদের দশম মণ্ডলের ১২৫তম সূক্তে জানাচ্ছেন, ‘অহম্ রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।’ অর্থাৎ, আমি একাদশ রুদ্র, অষ্ট বসু, দ্বাদশ আদিত্য এবং বিশ্বদেবতারূপে বিচরণ করি। এই সূক্তে রুদ্র, আদিত্য, ইন্দ্র, অগ্নিসহ বিশ্ব দেবতাদের সঙ্গে ব্রহ্মবিদুষী বাক্‌ নিজ অভিন্নতা ঘোষণা করেছেন।

বেদ সূত্রে বলা যায়, ব্রহ্মবাদিনী বাক্‌ অনুভব করেছিলেন সবই ব্রহ্মের অংশ এবং তিনি নিজের মধ্যে সব দেবতা, চরাচর বা বিশ্বকে ধারণ করে আছেন। বাক্‌সূক্ত তাই প্রকৃতপক্ষে দেবীকেই ইঙ্গিত করে। কারণ বাক্‌ যা বলেছেন, তা স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দে এবং নিজেকে আদ্যাশক্তি চার দেবীর স্বরূপে বিবরণ দিয়ে স্তোত্র আকারে। বাক্‌ নিজেকে এই শক্তির সঙ্গে একাত্ম করেছেন। অদ্বৈতবাদ অনুসারে যে ব্রহ্মকে জ্ঞাত হয় বা জানে, তাকেই ব্রহ্মস্বরূপ বলা হয়। বাক্‌ এই স্তোত্র রচনার মাধ্যমে আদ্যাশক্তি দেবীর স্বরূপ নিজের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাই তিনি ব্রহ্মস্বরূপা। তাই এটি দেবীসূক্ত।

দেবীসূক্ত নিয়ে বেদের বিখ্যাত ও প্রাচীন ভাষ্যকার বা টীকাকার সায়ণাচার্য্য বলেছেন, অম্ভৃণ কন্যা বাক্‌ পরমাত্মার সঙ্গে নিজের অভিন্নতা উপলব্ধি করে জগৎরূপে নিজেকে ব্রহ্ম উপলব্ধি করেছেন। আবার ব্রহ্মরূপিণী ভগবতী (দেবী বা নারী ভগবান) এখানে ব্রহ্মবিদুষী বাক্‌কে মাধ্যমরূপে গ্রহণ করে তাঁর ভেতর দিয়েই নিজের জগৎব্যাপী আত্মস্বরূপের পরিচয় দিয়েছেন।

দেবীসূক্তে নির্দিষ্ট করে কোনো নাম বা উপাধি বিশিষ্ট দেবীর কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ এখানে আদ্যাশক্তিকে নির্দিষ্ট কোনোরূপেই সীমাবদ্ধ করা হয়নি। এটি দেবীর বিশ্বময় স্বরূপের প্রকাশ। এ সূক্তটি বেদোত্তর সাহিত্যেই বস্তুত দেবীসূক্ত নামে অভিহিত হয়েছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে দেবীশক্তি নিহিত রয়েছে; এই উপলব্ধি থেকেই পরবর্তীকালে দেবীশক্তি শাক্তপূজার প্রধান উপাস্য দেবতায় পরিণত হয়েছেন।

অন্যদিকে, হিন্দু সাহিত্যের পৌরাণিক ধারার প্রাচীনতম গ্রন্থের অন্যতম মার্কন্ডেয় ৫ পুরাণের একটি শ্লোকে বলা হচ্ছে, স্ত্রীঃ সমস্ত সকলা জগৎসু। অর্থাৎ, প্রত্যেক স্ত্রী বা নারীর মধ্যেই জগৎ তথা দেবীসত্তা বিরাজমান। বাক্‌ অম্ভৃণিও সেই আদ্যাশক্তি দেবীর স্বরূপে নিজেকে ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্ম করেছেন।

জগতের সব নারীরই সে অধিকার আছে, যেন ঘোষণা করেছেন সে কথাই।

বাক্‌সূক্ত/দেবীসূক্ত

১. আমি রুদ্র ও বসু, আদিত্য এবং বিশ্বদেবতা রূপে বিচরণ করি।

  • আমিই ধারণ করি বরুণ ও মিত্র , ইন্দ্র ও অগ্নি এবং অশ্বিনীদ্বয়কে।

২. আমি লালন করি ও টিকিয়ে রাখি সমৃদ্ধ সোম এবং ত্বষ্টা, পূষা ও ভগকে ধরে রাখি।

  • যে উদ্যমী যজমান সোমের উপাসক ও নিজেকে উৎসর্গ করে, তাকে সম্পদশালী করি।

৩. আমি রানি, ধন সংগ্রহকারী, জ্ঞানে পূর্ণ, যারা উপাসনাযোগ্য তাদের মধ্যে প্রথম।

  • এইভাবে ঈশ্বর আমাকে অধিষ্ঠিত করেছেন বহু স্থানে, বহু গৃহে প্রবেশ ও থাকার জন্য।
  • ৪. একা আমার মাধ্যমেই সকলে খাদ্যপুষ্ট হয়, প্রত্যেকে দর্শন, শ্রবণ ও প্রাণধারণ করে থাকে। তারা জানে না, কিন্তু তবু তারা আমার সঙ্গে থাকে। শোনো প্রত্যেকে, আমি যা ঘোষণা করি তা সত্য।

৫. আমিই সে, যে নিশ্চয়তার সঙ্গে ঘোষণা করছে ও ধ্বনিত করছে সেই শব্দ (সত্য), যা দেবতা ও মানুষ একইভাবে স্বাগত জানায়।

  • আমি যাকে ভালোবাসি, তাকে পরাক্রমশালী করি, তাকে মহাজ্ঞান, ঋষিত্ব ও ব্রাহ্মণত্ব দান করি।

৬. আমি রুদ্রের ধনুক বাঁকিয়ে দিয়েছি, যাতে তাঁর তির ভক্তি-বিদ্বেষীকে আঘাত ও সংহার করে।

  • আমি জাগিয়ে তুলি এবং আদেশ করি যুদ্ধের যামানুষের (রক্ষার) জন্য এবং আমি পৃথিবী ও স্বর্গে প্রবেশ করেছি

৭. বিশ্ব শিখরে আমি পিতাকে (সৃষ্টিকর্তাকে) নিয়ে আসি: আমার নিবাস জলে, সমুদ্রে।

  • সেখান থেকে আমি বিস্তার ঘটাই সমস্ত বিদ্যমান সৃষ্টিকে এবং এমনকি স্বর্গকেও আমি নিজ ললাট দিয়ে স্পর্শ করি।

৮. আমি বাতাস ও ঝড়ের মতো শ্বাস নিই (প্রবাহিত হই), যখন একত্রে ধরে রাখি সমস্ত অস্তিত্বকে (বিশ্ব)।

  • এই বিস্তীর্ণ পৃথিবী ও স্বর্গের ওপারে, আমি মহাপরাক্রমশালী, আপন মহিমায়।

(ঋগ্‌বেদ, দশম মণ্ডল, ১২৫তম সূক্ত)

‘গহিনের স্রোতধারা: এশিয়ার নারীসাধকদের জীবন ও রচনা’ বই থেকে সম্পাদিত।

লেখক: লেখক ও সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিয়ের আগের রাতে গলায় ফাঁস দিলেন বর, দশমিনায় উৎসবের বাড়িতে শোকের ছায়া

রাজধানীর মিরপুরে যাত্রী নামিয়ে গুলি ছুড়ে বাসে আগুন দিল দুর্বৃত্তরা

দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের শর্তেই কেবল ট্রাম্পের গাজা প্রস্তাব মানতে প্রস্তুত রাশিয়া: পুতিন

মাথা ঠান্ডা করে আরামে ঘুমান, নিজেদের সমস্যায় মন দিন—পশ্চিমা নেতাদের পুতিন

ফ্লোটিলার সর্বশেষ জাহাজটির বর্তমান অবস্থান, স্টারলিংকের ইন্টারনেট এখনো সচল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত