Ajker Patrika

হাজার মাইল যাত্রায় যেভাবে পথ চিনে পরিযায়ী পাখিরা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
একবার মৌসুমি যাত্রায় অংশ নেওয়া পাখিরা নদী বা পর্বতের মতো পরিচিত ভূচিত্র মনে রাখতে পারে। ছবি: পেক্সেলস
একবার মৌসুমি যাত্রায় অংশ নেওয়া পাখিরা নদী বা পর্বতের মতো পরিচিত ভূচিত্র মনে রাখতে পারে। ছবি: পেক্সেলস

প্রতিবছর শীত এলেই বাংলাদেশের আকাশে দেখা মেলে হাজার হাজার অতিথি বা পরিযায়ী পাখির। সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া কিংবা হিমালয়ের পাদদেশ থেকে এসব পাখি উড়ে আসে দেশের হাওর-বাঁওড়, জলাশয় আর নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে। আবার গরম পড়লেই তারা পাড়ি জমায় হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের নিজের ঠিকানায়। এসব পাখির মধ্যে আর্কটিক টার্ন (Arctic tern বা Sterna paradisaea) নামের এক প্রজাতির পাখি পুরো জীবনে এত দূরত্ব অতিক্রম করে যে চাঁদ পর্যন্ত যাওয়া-আসার সমান হয়! মানুষের মতো জিপিএস বা কম্পাস না থাকলেও পরিযায়ী পাখিরা প্রতিবছর হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের পথ নির্ভুলভাবে পাড়ি দেয়। তাদের এই বিস্ময়কর দিক নির্ধারণ ক্ষমতা বরাবরই মানুষকে চমকে দেয়।

তাই পাখিদের দিক নির্ধারণের বিস্ময়কর ক্ষমতা কীভাবে কাজ করে—সে বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। ইতিমধ্যে নানা গবেষণায় এই দক্ষতার পেছনে কিছু কারণও খুঁজে পেয়েছেন।

অদ্ভুত ইন্দ্রিয়শক্তির ব্যবহার

জার্মানির ইনস্টিটিউট অব অ্যাভিয়ান রিসার্চের পরিচালক মিরিয়াম লিডভোগেল লাইভ সায়েন্সকে বলেন, ‘আমরা জানি, পাখিরা সঠিক দিক নির্ধারণে নানা রকম সংকেত ব্যবহার করে।’

সবচেয়ে সাধারণ সংকেত হলো—দৃষ্টিশক্তি এবং ঘ্রাণশক্তি। একবার মৌসুমি যাত্রায় অংশ নেওয়া পাখিরা নদী বা পর্বতের মতো পরিচিত ভূচিত্র মনে রাখতে পারে। তবে সমুদ্রের ওপর দিয়ে যেসব পাখি উড়ে যায়, তাদের জন্য এ ধরনের চিহ্ন থাকে না। গবেষণায় দেখা গেছে, স্কোপোলির শিয়ারওয়াটার (Calonectris diomedea) নামের সামুদ্রিক পাখির নাসারন্ধ্র বন্ধ করে দিলে তারা স্থলভাগের ওপর ঠিকঠাক উড়তে পারলেও পানির ওপর দিয়ে উড়ার সময় বিভ্রান্তিতে পড়ে। অর্থাৎ, ঘ্রাণশক্তিও তাদের দিক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ।

সূর্য-নক্ষত্রের দিকনির্দেশ

দিনের বেলা উড়তে থাকা পাখিরা সূর্য ব্যবহার করে দিক নির্ধারণ করে। এই ‘সূর্য কম্পাস’ কাজ করে সূর্যের অবস্থান এবং পাখির অভ্যন্তরীণ দেহঘড়ির (circadian rhythm) সময়জ্ঞান মিলিয়ে। কৃত্রিম আলো দিয়ে যদি পাখির সময়জ্ঞান বিঘ্নিত করা হয়, তবে তারা দিক হারিয়ে ফেলে।

তবে বেশির ভাগ পাখি রাতের বেলা উড়ে, ফলে সূর্য তাদের কাজে আসে না। তখন তারা নির্ভর করে আকাশের নক্ষত্রের অবস্থান ও ঘূর্ণনের ওপর। বিশেষভাবে, তারা ধ্রুবতারাকে ঘিরে থাকা নক্ষত্র মণ্ডল চিনে রাখে। এভাবেই তারা ব্যবহার করে ‘তারকা কম্পাস’।

চুম্বকীয় অনুভূতি: ম্যাগনেটোরিসেপশন

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হওয়ার কারণে সূর্য ও নক্ষত্র দেখা না গেলেও পাখিরা দিক নির্ণয় করতে পারে। এ অবস্থায় কাজ করে পাখির এক আশ্চর্য ইন্দ্রিয়—ম্যাগনেটোরিসেপশন। এই শক্তি পাখিকে পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্র বুঝতে সাহায্য করে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ পিটার হোর মনে করেন, এই ইন্দ্রিয় ক্ষমতা কোনো এক রাসায়নিক বিক্রিয়ায় নির্ভর করে, যা চুম্বকক্ষেত্রের শক্তি ও দিক বুঝে কাজ করে। তাঁর মতে, এতে ক্রিপ্টোক্রোম (cryptochrome) নামক একটি অণু ভূমিকা রাখতে পারে, যা পাখির চোখে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, নীল আলোতে এই অণুটি চৌম্বকক্ষেত্রের প্রতি সংবেদনশীল হয়। তবে এত সূক্ষ্মভাবে কাজ করে কীভাবে, তা এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে স্পষ্ট নয়।

এ ছাড়া পাখির ঠোঁটেও চুম্বকীয় অনুভূতি থাকতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঠোঁটের ওপরের অংশে ম্যাগনেটাইট (লোহাজাতীয় খনিজ) গ্রহণকারী রিসেপ্টর রয়েছে, যা স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে সংযুক্ত। এটি চৌম্বক শক্তি নিরূপণে সাহায্য করতে পারে।

মেঘলা দিনেও দিক বোঝে পাখি

চুম্বকশক্তির পাশাপাশি পাখি মেঘলা আকাশেও দিক নির্ধারণে সহায়তা পায় সূর্যের আলো থেকে বিকিরিত পোলারাইজড লাইট (সুসংগঠিত বিকিরিত তরঙ্গ) মাধ্যমে। পাখির চোখে থাকা বিশেষ কোষ এই আলো বুঝতে পারে, এমনকি সূর্য দেখা না গেলেও।

রাতে চোখে কম দেখলে আমরা হাত নাড়িয়ে পথ বুঝে নিই, তেমনি পাখিরাও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে।

লিডভোগেল বলেন, ‘পাখিরা তাদের সব সংকেতকে সমন্বয় করে দিক নির্ধারণ করে। যাত্রার বিভিন্ন পর্বে ভিন্ন সংকেত বেশি কার্যকর হয়।’

পিটার হোর বলেন, ঝড় কিংবা সৌড়ঝড় তেজস্ক্রিয়তার সময় চৌম্বকক্ষেত্র বিঘ্নিত হয়, তখন পাখিরা হয়তো অন্য সংকেতে ভরসা করে।

সবশেষে, এই দুর্দান্ত দক্ষতার ভিত্তি হলো পাখির জিনগত অভিবাসন প্রবণতা। এই অভ্যাস পাখির পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া। কত দূর যাবে, কোন দিকে যাবে—সবই জিনের মাধ্যমে নির্ধারিত। তবে ঠিক কোন জিনগুলো এ জন্য দায়ী, তা নিয়ে গবেষণা চলছে।

পাখি সংরক্ষণের জন্য তাদের এই রহস্যময় দক্ষতা বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় পাখিদের নতুন পরিবেশে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় বা পুনর্বাসনের চেষ্টা চলে। তবে একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৪৫ শতাংশ ক্ষেত্রে পাখিরা নতুন জায়গা ছেড়ে চলে যায়।

হোর বলেন, ‘মানুষের চেষ্টায় পাখিদের পুনর্বাসন খুব সফল হয়নি। কারণ, তারা এতটাই দক্ষ পথপ্রদর্শক যে তাদের সরিয়ে নিলেও তারা আবার ফিরে আসে।’

তথ্যসূত্র: লাইভ সায়েন্স

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল বাসায় নিয়ে গায়েব করেন উপদেষ্টা— আসিফ মাহমুদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের মেয়রের অভিযোগ

চীনা যুদ্ধবিমান থেকে এলএস-৬ বোমা ফেলে কেন নিজ দেশে ‘হত্যাযজ্ঞ’ চালাল পাকিস্তান

ভবদহের দুঃখ ঘোচাতে আসছে সেনাবাহিনী, খনন করবে ৫ নদ-নদীর ৮১.৫ কিমি

ধর্ষণের শিকার শিশুর স্বজনকে মারতে উদ্যত হওয়া সেই চিকিৎসক বরখাস্ত

তাহসান তো জিহাদিদের মতোই কথা বললেন: তসলিমা

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত