বিভুরঞ্জন সরকার
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট হতে যাচ্ছে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের সাক্ষী। কারণ এই বাজেট তৈরি করছে এমন একটি সরকার, যার মেয়াদ সীমিত, কিন্তু প্রত্যাশার ভার অপরিসীম। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে যে অর্থনৈতিক দর্শনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তা আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়—বাজেট কি শুধু টাকার হিসাব? নাকি এটা আমাদের রাষ্ট্রদর্শনের প্রতিফলন?
প্রথমেই বলা দরকার, এই বাজেট ঘোষিত হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন দেশে কার্যকর সংসদ নেই, নির্বচনের সময়সীমা নিয়ে কিছুটা রাজনৈতিক উত্তাপ যেমন আছে, তেমনি আস্থার সংকট এখনো পুরোপুরি কাটেনি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে, মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে না পেরে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে সরকার বলছে, তারা ‘বাস্তবভিত্তিক, সময়োপযোগী ও বাস্তবায়নযোগ্য’ বাজেট তৈরি করছে। শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু মানুষ এখন শুধু কথায় আশ্বস্ত হয় না, প্রমাণ দেখতে চায়।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এই বাজেট হবে ব্যয়ের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী, রাজস্ব আহরণে উদ্ভাবনী এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক। সবচেয়ে প্রশংসনীয় যে ঘোষণা এসেছে তা হলো: ‘কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা জনকল্যাণহীন প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করব না।’ দীর্ঘদিন ধরে আমাদের উন্নয়ন ব্যয়ের বড় অংশ চলে গেছে এমন সব খাতে, যা ছিল চোখধাঁধানো কিন্তু প্রাণবন্ত নয়। গরিবের ভাগ্যে জুটত না সেই উন্নয়নের আলো।
এই বাজেটে সরকার বলছে, মেগা প্রকল্পে তারা যাবে না, বরং শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে ব্যয় করবে। অর্থাৎ, মানুষের ‘বাস্তব জীবন’-এর সঙ্গে সম্পর্কিত খাতগুলো অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শুধু খাত নির্ধারণ করলেই কি বাজেট বাস্তবায়ন হয়? দেশের ইতিহাসে আমরা বহুবার দেখেছি, চমৎকার পরিকল্পনা মাঠে নেমে হয়ে যায় খণ্ড খণ্ড ব্যর্থতা। কারণ একটাই—ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং যথাযথ নজরদারির অভাব।
অর্থ উপদেষ্টার একাধিক বক্তব্যে যে বিষয়টি বারবার এসেছে তা হলো—‘ভ্যালু ফর মানি’। অর্থাৎ, ব্যয় যেন কার্যকর হয়, অপচয় যেন না হয়। এটি নিঃসন্দেহে একটি দায়িত্বশীল অবস্থান। তবে এটাও ঠিক, যে অর্থব্যয় সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়, তা হলো মানুষের জন্য খরচ। যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান খাতে আমরা যথার্থ বিনিয়োগ করি, তবে উন্নয়ন নিজেই তার ফলাফল দেখাবে। শুধু রাস্তাঘাট, সেতু বা বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে মানুষের জীবন বদলায় না।
এবারের বাজেট ঘাটতি হবে জিডিপির ৪ শতাংশের মধ্যে—এমন ঘোষণা এসেছে। এটি অর্থনৈতিকভাবে সহনীয়। দেশীয় উৎস থেকে রাজস্ব আহরণে জোর দেওয়া হচ্ছে, বিদেশি সহযোগীদের কাছ থেকেও সহায়তার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তবে অতীতে এসব প্রতিশ্রুতির অনেকটাই ‘থাকে কাগজে, নামে না মাটিতে’। তাই এবার দরকার বাস্তবায়নের ওপর কঠোর নজরদারি।
এত দিন আমরা দেখেছি, বাজেট মানেই বিশাল অঙ্ক, তারপর পত্রিকায় কিছু হেডলাইন, তারপর ভুলে যাওয়া। অথচ বাজেট হওয়া উচিত এমন এক নথি, যা একজন খেটে খাওয়া মানুষের জীবনেও বদল আনে। ডাল-চাল-ওষুধের দাম যদি কমে, যদি প্রতিটি স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ঠিকমতো উপস্থিত থাকে, যদি কোনো কৃষকের কাছে পৌঁছায় ভর্তুকির বীজ—তবেই আমরা বলব বাজেট সফল। না হলে এ কেবলই মেগা অঙ্ক, মেগা ঘোষণার জগৎ।
ড. সালেহউদ্দিন বলেছেন, ‘টাকার যথাযথ ব্যবহারই হবে মূলনীতি, তবে সেটি যেন “না খেয়ে বাঁচা” না হয়।’ তাঁর এই বক্তব্য আমাদের আরেকটি বিষয় মনে করিয়ে দেয়—অর্থনীতিতে কৃচ্ছ্রসাধনের নামে যদি মানুষের জীবন আরও সংকুচিত হয়, ডাল-ভাতের সংস্থানও যদি কঠিন হয়ে পড়ে, তবে সেটি হবে আত্মঘাতী। বাজেট বাস্তবায়নের সময় তাই মানবিকতা ও বাস্তবতা—দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা জরুরি।
সবশেষে বলা যায়, বাজেট কখনোই কেবল একটি সরকারের বিষয় নয়, এটা জাতির ভবিষ্যৎ রূপরেখাও। এই অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সীমিত সময়েও যদি একটি বাস্তবায়নযোগ্য ও মানবিক বাজেট উপহার দিতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারগুলোর জন্য সেটি হতে পারে এক শক্তিশালী বার্তা—উন্নয়ন মানেই যেন মানুষ, উন্নয়ন মানেই যেন সাম্য।
বাজেটে সরকার লক্ষ-কোটি টাকার হিসাব মিলিয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু লক্ষ-কোটি দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের জীবনের হিসাবের খাতা শূন্যই থেকে যায়। এই শূন্যতা পূরণের উদ্যোগ কি কেউ কখনো আসলেই নেবে?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট হতে যাচ্ছে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের সাক্ষী। কারণ এই বাজেট তৈরি করছে এমন একটি সরকার, যার মেয়াদ সীমিত, কিন্তু প্রত্যাশার ভার অপরিসীম। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে যে অর্থনৈতিক দর্শনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তা আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়—বাজেট কি শুধু টাকার হিসাব? নাকি এটা আমাদের রাষ্ট্রদর্শনের প্রতিফলন?
প্রথমেই বলা দরকার, এই বাজেট ঘোষিত হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন দেশে কার্যকর সংসদ নেই, নির্বচনের সময়সীমা নিয়ে কিছুটা রাজনৈতিক উত্তাপ যেমন আছে, তেমনি আস্থার সংকট এখনো পুরোপুরি কাটেনি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে, মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে না পেরে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে সরকার বলছে, তারা ‘বাস্তবভিত্তিক, সময়োপযোগী ও বাস্তবায়নযোগ্য’ বাজেট তৈরি করছে। শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু মানুষ এখন শুধু কথায় আশ্বস্ত হয় না, প্রমাণ দেখতে চায়।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এই বাজেট হবে ব্যয়ের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী, রাজস্ব আহরণে উদ্ভাবনী এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক। সবচেয়ে প্রশংসনীয় যে ঘোষণা এসেছে তা হলো: ‘কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা জনকল্যাণহীন প্রকল্পে অর্থ ব্যয় করব না।’ দীর্ঘদিন ধরে আমাদের উন্নয়ন ব্যয়ের বড় অংশ চলে গেছে এমন সব খাতে, যা ছিল চোখধাঁধানো কিন্তু প্রাণবন্ত নয়। গরিবের ভাগ্যে জুটত না সেই উন্নয়নের আলো।
এই বাজেটে সরকার বলছে, মেগা প্রকল্পে তারা যাবে না, বরং শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে ব্যয় করবে। অর্থাৎ, মানুষের ‘বাস্তব জীবন’-এর সঙ্গে সম্পর্কিত খাতগুলো অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শুধু খাত নির্ধারণ করলেই কি বাজেট বাস্তবায়ন হয়? দেশের ইতিহাসে আমরা বহুবার দেখেছি, চমৎকার পরিকল্পনা মাঠে নেমে হয়ে যায় খণ্ড খণ্ড ব্যর্থতা। কারণ একটাই—ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং যথাযথ নজরদারির অভাব।
অর্থ উপদেষ্টার একাধিক বক্তব্যে যে বিষয়টি বারবার এসেছে তা হলো—‘ভ্যালু ফর মানি’। অর্থাৎ, ব্যয় যেন কার্যকর হয়, অপচয় যেন না হয়। এটি নিঃসন্দেহে একটি দায়িত্বশীল অবস্থান। তবে এটাও ঠিক, যে অর্থব্যয় সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়, তা হলো মানুষের জন্য খরচ। যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান খাতে আমরা যথার্থ বিনিয়োগ করি, তবে উন্নয়ন নিজেই তার ফলাফল দেখাবে। শুধু রাস্তাঘাট, সেতু বা বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে মানুষের জীবন বদলায় না।
এবারের বাজেট ঘাটতি হবে জিডিপির ৪ শতাংশের মধ্যে—এমন ঘোষণা এসেছে। এটি অর্থনৈতিকভাবে সহনীয়। দেশীয় উৎস থেকে রাজস্ব আহরণে জোর দেওয়া হচ্ছে, বিদেশি সহযোগীদের কাছ থেকেও সহায়তার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তবে অতীতে এসব প্রতিশ্রুতির অনেকটাই ‘থাকে কাগজে, নামে না মাটিতে’। তাই এবার দরকার বাস্তবায়নের ওপর কঠোর নজরদারি।
এত দিন আমরা দেখেছি, বাজেট মানেই বিশাল অঙ্ক, তারপর পত্রিকায় কিছু হেডলাইন, তারপর ভুলে যাওয়া। অথচ বাজেট হওয়া উচিত এমন এক নথি, যা একজন খেটে খাওয়া মানুষের জীবনেও বদল আনে। ডাল-চাল-ওষুধের দাম যদি কমে, যদি প্রতিটি স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ঠিকমতো উপস্থিত থাকে, যদি কোনো কৃষকের কাছে পৌঁছায় ভর্তুকির বীজ—তবেই আমরা বলব বাজেট সফল। না হলে এ কেবলই মেগা অঙ্ক, মেগা ঘোষণার জগৎ।
ড. সালেহউদ্দিন বলেছেন, ‘টাকার যথাযথ ব্যবহারই হবে মূলনীতি, তবে সেটি যেন “না খেয়ে বাঁচা” না হয়।’ তাঁর এই বক্তব্য আমাদের আরেকটি বিষয় মনে করিয়ে দেয়—অর্থনীতিতে কৃচ্ছ্রসাধনের নামে যদি মানুষের জীবন আরও সংকুচিত হয়, ডাল-ভাতের সংস্থানও যদি কঠিন হয়ে পড়ে, তবে সেটি হবে আত্মঘাতী। বাজেট বাস্তবায়নের সময় তাই মানবিকতা ও বাস্তবতা—দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা জরুরি।
সবশেষে বলা যায়, বাজেট কখনোই কেবল একটি সরকারের বিষয় নয়, এটা জাতির ভবিষ্যৎ রূপরেখাও। এই অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সীমিত সময়েও যদি একটি বাস্তবায়নযোগ্য ও মানবিক বাজেট উপহার দিতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারগুলোর জন্য সেটি হতে পারে এক শক্তিশালী বার্তা—উন্নয়ন মানেই যেন মানুষ, উন্নয়ন মানেই যেন সাম্য।
বাজেটে সরকার লক্ষ-কোটি টাকার হিসাব মিলিয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু লক্ষ-কোটি দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের জীবনের হিসাবের খাতা শূন্যই থেকে যায়। এই শূন্যতা পূরণের উদ্যোগ কি কেউ কখনো আসলেই নেবে?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে লন্ডনে অনুষ্ঠিত সভা এখন অতীত বিষয়। ওই সভার পর দেশের রাজনীতিতে অনেক কিছুই সমন্বয় হয়ে গেছে এবং এখনো হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি একটি দ্রুত অগ্রসরমাণ বিষয়। তার কয়েক দিনও এক জায়গায় অবস্থানের সুযোগ নেই।
১৯ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি বিশ্বজুড়ে আলোচনায় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়—শুধু গবেষণায় নয়, মানবিক দায়বদ্ধতায়ও। যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে নেমে বিশ্ববিদ্যালয়টি দেখিয়ে দিয়েছে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেবল জ্ঞানচর্চার স্থান নয়; বরং তা ন্যায়, স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীল...
১৯ ঘণ্টা আগেএই জীবনে মানুষ হয়ে জন্মানো আর মানুষ হয়ে ওঠা—এই দুইয়ের মাঝে যে সংযোগ, তাকে যদি ‘ম্যাজিক রিয়্যালিজম’ বলি? কথাটির সহজ কোনো মানে কি করা যায়? জীবনের শুরুতে কিংবা বেড়ে উঠতে উঠতে কতটুকুইবা বুঝতে পারা যায়? বোঝাটুকুর জন্যই যে মনের বৃদ্ধি দরকার!
১৯ ঘণ্টা আগেআমাদের দেশে ক্রমান্বয়ে নদী হারিয়ে যাচ্ছে। নদী হলো পরিবেশ, কৃষি, মৎস্য সম্পদ আহরণ, যোগাযোগব্যবস্থা ও সেচের অন্যতম মাধ্যম। সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশে নদীর ভূমিকা অনেক। কিন্তু দিন দিন বিভিন্ন কারণে নদী দখল হয়ে যাচ্ছে। নদীতে বর্জ্য ফেলে যখন নদীকে দূষিত করা হয়, তখন বোঝা যায় আমরা জাতি হিসেবে কতটুকু...
১৯ ঘণ্টা আগে