Ajker Patrika

ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ ও আমাদের মানসিকতা

ইমরান খান
ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ ও আমাদের মানসিকতা

যৌনতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা আমাদের সমাজে এখনো ‘ট্যাবু’। শুধু এ উপমহাদেশ নয়, যৌনতার ধারণার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে স্বয়ং মনঃসমীক্ষণের জনক সিগ্মুন্ড ফ্রয়েডও পড়েছিলেন তোপের মুখে। অ্যাডলফ হিটলারের তাড়া খেয়ে বেচারা ১৯৩৮ সালে তো ভিয়েনা ছেড়েই ঊর্ধ্বশ্বাসে পালালেন। অবশ্য তাঁর ধর্ম ইহুদি হওয়াটাও হিটলারের আরেক মাথাব্যথার কারণ ছিল বলে উল্লেখ করেছে জার্মান গণমাধ্যমে ডয়েচে ভেলে। 

সমাজে যৌনতা নিয়ে আলোচনা কম হলেও যৌনতা কি থেমে আছে? কিছুদিন ধরে কনসেন্টে (নারী, পুরুষ উভয়ের সম্মতি) যৌনতার ধারণা নিয়ে আলোচনা হলেও আগে পরে কি মানুষ এভাবে মিলিত হচ্ছে না? প্রেম কি কোনো একপর্যায়ে যৌনতায় পা বাড়ায় না? জোরপূর্বক, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে যৌনতার সব খবর কি মিথ্যা? পরকীয়া হচ্ছে না? হয়তো মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বে ফ্রয়েড যে ইডের (প্রবৃত্তি) কথা বলেছেন, তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ মিলবে এসব প্রশ্নের উত্তরে। 

ফ্রয়েড মনে করতেন, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সবারই তীব্র আকর্ষণ রয়েছে। ১৯২৫ সালে তাঁর লেখা ‘দ্য ফিজিক্যাল কনসিকুয়েন্সেস অব দ্য এনাটমিক ডিসটিংসেস অ্যান্ড সেক্স’ প্রবন্ধে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এ প্রবন্ধে ফ্রয়েড নারীকে পুরুষ কর্তৃক চালিত হওয়ার ভূমিকার কথা বলেছেন। তবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে এসব আকর্ষণ প্রকাশে বাধা পাওয়ার বাস্তবতাও তিনি অস্বীকার করেননি। এই আবেগের অবদমনই বিভিন্নভাবে হয়। জীবিত তো বটেই, স্বপ্নেও দৈনন্দিন জীবনে দেখা পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গের প্রতীকগুলো ফিরে আসে বলে উল্লেখ করেছেন এ মনোবিদ। 

সম্প্রতি শোবিজ তারকাদের জীবনযাপন নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। তারকাদের সঙ্গে ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, সরকারি কর্মকর্তাসহ সম্পদশালীদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়গুলো গণমাধ্যমে উঠে আসছে। ২০১৮ সালে অভিনেতা পরিচালক গাজী রাকায়েতের বিরুদ্ধে ‘ম্যাসেঞ্জারে অশ্লীল প্রস্তাব’ দেওয়ার বিষয় নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে। ডিসি, এমপির মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভিডিওও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যৌন নিপীড়নের বিচার নিয়ে থানায় গিয়ে নিপীড়িত হওয়ার খবরও উঠে আসছে গণমাধ্যমে। এমনকি ধর্মীয় নেতাদের যৌন লালসার প্রমাণও দেখেছে দেশ। 

এসব ঘটনা যখনই সামনে এসেছে, লুফে নিয়েছে মানুষ। সামাজিক মাধ্যমে চলেছে জোর আলোচনা-সমালোচনা। ঘটনার মোড় ঘুরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সামনে এসেছে নারী। তাঁর ফেসবুক ঘেঁটে বিশেষ কিছু ছবি ও ভিডিও বের করে নিজের টাইমলাইন, গ্রুপে শেয়ারের হিড়িক পড়েছে। ভুয়া করোনা রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার ডা. সাবরিনা চৌধুরী, ফাহমির কক্ষে মিথিলার ছবি, নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া, প্রবাসী টম ইমাম ও তাঁর স্ত্রী মিষ্টি ইমামের ছবি এবং বর্তমানে পরীমণির মতো অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে এমন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে এসব বাছাইকৃত ছবি প্রচার করাটা কি প্রতিবাদ নাকি ফ্রয়েডীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ‘সচেতন, অর্ধচেতন ও অবচেতন’ মনের নিজেরই যৌনতার বহিঃপ্রকাশ—সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। 

কেন এমন হচ্ছে? তথাকথিত শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের ফেসবুকও কেন এসব ছবিতে সয়লাব হচ্ছে? নিজেকে ওই যৌনতার অংশ হিসেবে না পাওয়ার বঞ্চনাবোধ থেকেই কি তবে এমন কর্ম? নাকি সময়ের উত্তেজনায় অবচেতনে খসে পড়ছে ‘আমি ভালো’র মুখোশ? 

শুধু কি ব্যক্তিপর্যায়? এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যমই বা কতটা পেশাদারি বজায় রাখতে পারছে বা রাখছে? গণমাধ্যমে ব্যবহৃত ছবি, শিরোনাম সচেতনভাবে ব্যবহৃত হয়, নাকি পাঠককে উসকে দিতে বা কাটতি বাড়ানোর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তা নিয়েও আছে বিস্তর প্রশ্ন। কোনো ঘটনায় নারী যুক্ত হলেই তাঁকে নিউজ কেমিস্ট্রি হিসেবে কাজে লাগানোটা একটি ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। অপরাধের চেয়ে নারীর চরিত্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোই যেন মূল উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে। আবার নারীর প্রাণনাশের অভিযোগেও যখন কোনো প্রভাবশালীর নাম আসে, তখন মিডিয়ার ভূমিকা কেমন হয়, তা তো দেশবাসী মুনিয়া-আনভীরের ঘটনায় স্পষ্টই দেখেছে। 

বাস্তব জীবন কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেকে ভালো প্রমাণের প্রতিযোগিতা এক চিরন্তন বাস্তবতা। নার্সিসিজমের ধারণায় নিজেকে সুন্দর ভাবা, অন্যের ভালোবাসার পাত্র হওয়ার কথা রয়েছে। সব সময় সবাই তো এমন সুযোগ পায় না। তাই বলে সুযোগ পেলেই যে কাউকে পেঁয়াজকুচি করা কতটা যৌক্তিক। সমালোচনার নামে নিপীড়নকে কী দিয়ে জাস্টিফাই করবেন? প্রশ্ন করতে পারেন নিজের বিবেককে, আমিই বা কতটা সাধু? প্রতিবাদী শিল্পী শায়ান তো গানে গানে বলেই দিয়েছেন ‘তোমাকে যেমন ভাবছে সবাই, আসলে কি তুমি তাই? আমি তো আমার মুখোমুখি হলে ভীষণ লজ্জা পাই।’ 

এই লজ্জাটা আসলে সবারই থাকা প্রয়োজন। নইলে বাস্তব বা ভার্চ্যুয়াল পরিসর; কোথাও নিরাপদ থাকবে না নারী। 

ইমরান খান: সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ডে স্থায়ী বসবাসের আবেদন করবেন যেভাবে

‘ম্যামের মুখটা দেখলাম, মনে হলো—শুয়ে আছেন, কিছুই হয়নি তাঁর’

তিন ভোটে দায়িত্ব পালনকারীদের ‘যথাসম্ভব’ দূরে রাখতে হবে

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ চাইলেন ফখরুল

নেপালে সরকার পতনের পর ভাইরাল মনীষা কৈরালার পুরোনো ভিডিও

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত