Ajker Patrika

এত শঙ্কা এত ভয় তবু আশায় থাকা

সরকার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে বলেই মনে করছে জামায়াত ও তার সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে থাকা দলগুলো। ওই দলগুলোর নেতারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সরাসরি বিরোধিতা না করলেও বাস্তবে তাঁরা নানা হিসাবনিকাশ থেকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চান না।

আজাদুর রহমান চন্দন
এত শঙ্কা এত ভয় তবু আশায় থাকা

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যতই জোর দেওয়া হচ্ছে, চারপাশে ততই বইছে আশঙ্কার গুমোট হাওয়া। আশঙ্কা দানা বাঁধছে সরকারেরই কিছু কথায়। সরকারের পক্ষ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে জোর দেওয়ার পাশাপাশি বলা হচ্ছে নির্বাচন ভন্ডুল করার ষড়যন্ত্রের কথাও। ২ সেপ্টেম্বর কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সতর্ক করে বলেন, ‘যারা অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে দিতে চায় না, তারা যত রকমভাবে পারে বাধা দেবে। বাংলাদেশের সত্তাকে গড়ে তুলতে তারা বাধা দেবে। তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে নির্বাচন বানচাল করার। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার, যাতে নির্বাচন না হয়।’

কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও এমন ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে। যদিও প্রথম দিকে সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে প্রায় সবারই অভিযোগের তির ছিল পতিত আওয়ামী লীগ ও প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে। তবে দিনদিন তিরের লক্ষ্য ঘুরে যাচ্ছে ক্রিয়াশীল প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের দিকেও। কিছু রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নানা ধরনের অপরিণামদর্শী দাবি তোলা হচ্ছে। আলোচনার টেবিলেও প্রাধান্য পাচ্ছে হুমকির সুর। এভাবে গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে তোলা হচ্ছে।

এ দেশের মানুষের কাছে ভোট একটি বড় উৎসবের মতো। পাকিস্তান আমলে বছরের পর বছর সাধারণ নির্বাচন না হওয়ায় ভোট-উৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত ছিল বাংলাদেশের মানুষ। পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্য আর ভোট-বঞ্চনার জবাব বাঙালি খুব ভালোভাবেই দিয়েছিল সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের ১৫ বছরেও আর্থিক দুর্নীতির পাশাপাশি নির্বাচনকে তামাশায় পরিণত করায় দেশের সাধারণ মানুষ ভেতরে ভেতরে কতটা ফুঁসছিল, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেপথ্যে যার যে ডিজাইন বা ভূমিকাই থাকুক না কেন, মানুষের ক্ষোভ যে স্বতঃস্ফূর্ত ছিল, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আন্দোলনে বৈষম্যমুক্তির যে আওয়াজ তোলা হয়েছিল, তা সহি ছিল নাকি মেকি, সেটিও বিচার করতে যায়নি বিক্ষুব্ধ জনতা।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের কোনো বিকল্প আমাদের হাতে নেই।’ ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর বাসভবন যমুনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সেদিন ব্রিফিংয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন, দেশের মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে আসবে। কোনো শক্তিই সুষ্ঠু নির্বাচন ঠেকাতে পারবে না। তিনি অবশ্য এও বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন শুধু সরকারের ইচ্ছায় নয়, সমাজের বিভিন্ন অংশ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার ওপরও নির্ভর করে। ইলেকশন করে সোসাইটি, পলিটিক্যাল পার্টিগুলো—তারা যদি চায়, তাহলে একটি ভালো নির্বাচন অবশ্যই সম্ভব। এর মাত্র পাঁচ দিন আগে শফিকুল আলম বলেছিলেন, নির্বাচন যে করেই হোক ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হবে। পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই এই নির্বাচনকে ঠেকাতে পারে।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না করলেও এরই মধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। কিন্তু নতুন করে সীমানা নির্ধারণের পর দেশের কয়েকটি স্থানে এই সীমানা নিয়ে চলছে বাদ-প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। ৩০০ আসনের সীমানা নতুন করে নির্ধারণ করার কারণে ৩৭টি আসনে পরিবর্তন এসেছে। এর প্রভাব পড়েছে ঢাকাসহ সারা দেশের ৪৬টি আসনে। তবে ইসির পক্ষ থেকে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা হলেও রাজনৈতিক দলগুলো সে অর্থে নির্বাচনমুখী হয়নি এখনো। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন, সংসদের উভয় কক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতি চালুসহ পাঁচ দফা দাবিতে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে। এই দলগুলো ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে বিক্ষোভের অভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, দলগুলোর টার্গেট হলো বিএনপি।

জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি দলের চলমান কর্মসূচিকে ‘অহেতুক চাপ সৃষ্টি’ হিসেবে গণ্য করছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ‘আলোচনার মধ্যে এ ধরনের কর্মসূচির অর্থই হচ্ছে—অহেতুক একটা চাপ সৃষ্টি করা; যা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়।’ বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মধ্যে নির্বাচন নিয়ে নানা ইস্যুতে মতভেদ আছে। জুলাই সনদ ও এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আছে মতবিরোধ। বিএনপি চায় নির্বাচিত সংসদ এটা করবে। জামায়াত গণভোট চায়। আর এনসিপি চায় গণপরিষদ নির্বাচন। জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ করার একটা ইস্যুও আছে। জামায়াত চায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম যেভাবে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, জাতীয় পার্টির কার্যক্রমও সেভাবেই নিষিদ্ধ করা হোক। এনসিপিও তা-ই চায়। তবে বিএনপির কথা, কোনো নির্বাহী আদেশে নয়, সেটা করা হোক বিচারের মাধ্যমে। নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসবে, এই ইস্যুটিও ততই বড় হবে। এটা রাজনীতিতে দর-কষাকষির একটা বড় ইস্যু হবে। কারণ, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিতে পারলে সেটা জামায়াত ও এনসিপির জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেবে। প্রধান বিরোধী দল হওয়ার বিষয়ে জামায়াত অনিশ্চয়তায় পড়বে। আবার জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে সেটা বিএনপিকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। কারণ, তখন জামায়াত ও এনসিপি মিলে বিএনপিকে বড় ধরনের চাপ দিতে পারবে।

কেউ কেউ মনে করছেন, জামায়াত ও তার সহ-আন্দোলনকারী দলগুলো আসলে বিএনপিকে শক্তি দেখাতে চাইছে। সে কারণেই তারা রাজধানী, জেলাসহ সারা দেশে ধারাবাহিক কর্মসূচি দিচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা নির্বাচনে বিএনপির কাছ থেকে সুবিধা নিতে চাইছে। এ ছাড়া এই কর্মসূচির মাধ্যমে তারা নির্বাচনের আগে একটা রাজনৈতিক মোর্চাও গড়তে চাইছে। সে লক্ষ্য থেকেই ‘সব ভোট এক বাক্সে আনার’ কথাও বলছেন দলগুলোর কোনো কোনো নেতা। এদিকে অতিসম্প্রতি জামায়াত ও এর মিত্র দলগুলোর সঙ্গে কর্মসূচি নিয়ে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে এনসিপির। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনে না যাওয়া প্রসঙ্গে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে যেই যুগপৎ আন্দোলন হচ্ছে, সেটাতে আমরা নাই। কারণ, নিম্নকক্ষে আমরা পিআর চাই না। নিম্নকক্ষে পিআরের বিরুদ্ধে আমরা অবস্থান নিয়েছি। আমরা শুধু উচ্চকক্ষে পিআর এবং জবাবদিহির জন্য একটি কার্যকর উচ্চকক্ষ চাচ্ছি।’ গত শুক্রবার সন্ধ্যায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। জামায়াতসহ সংশ্লিষ্ট দলগুলো যেসব ইস্যুতে কর্মসূচি পালন করছে, সেগুলোর সঙ্গে একমত নয় এবি পার্টি এবং গণঅধিকার পরিষদও। আগে শোনা যাচ্ছিল যুগপৎ আন্দোলনে তারাও থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা থাকেনি।

সরকার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে বলেই মনে করছে জামায়াত ও তার সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে থাকা দলগুলো। ওই দলগুলোর নেতারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সরাসরি বিরোধিতা না করলেও বাস্তবে তাঁরা নানা হিসাবনিকাশ থেকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চান না। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভালো করায় তাঁরা মনে করছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে রাজনীতির মাঠে তাঁদের অবস্থা দিনদিন আরও ভালো হবে।

ওই দলগুলোর নির্বাচন চাওয়ার পাশাপাশি ‘দাবি না মানলে আমরা নির্বাচনে যাব না’—এমন মনোভাব দেখানোয় তাদের আসল উদ্দেশ্যটা বোঝা যায়। সব মিলিয়ে নির্বাচন নিয়ে এখনই আশায় বুক বাঁধতে পারছেন না অনেকেই। খেলাফত মজলিসের নেতা মামুনুল হকের হঠাৎ আফগানিস্তান সফর নিয়েও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এমন এক সময়ে এই সফর যখন কিনা তালেবান সরকার দেশটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম থেকে নারীদের লেখা সব বই নিষিদ্ধ করেছে। ফলে এই সফর উদারমনা মানুষের মনে শঙ্কা না জাগিয়ে কি পারে?

মার্কিন সেনা ও বিমানবাহিনীর শতাধিক কর্মকর্তা ১০ সেপ্টেম্বর উড়োজাহাজে করে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে অবতরণ করেন। সেই সঙ্গে দুটি হারকিউলিস পরিবহন বিমানে প্রচুর যন্ত্রপাতিও এসেছে। সরকারি ভাষ্যমতে, ‘প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল মহড়ার মাধ্যমে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এগিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, মার্কিন সেনা এত ঘন ঘন কেন আসছে বাংলাদেশে? এ বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একের পর এক বাংলাদেশে আসছে-যাচ্ছে মার্কিন সেনা প্রতিনিধিদল। কখনো প্রশিক্ষণের নামে, কখনো দ্বিপক্ষীয় মতবিনিময়ের ছুতোয়, কখনোবা মহড়ার নামে। তলেতলে কি কিছু ঘটছে? এতসব শঙ্কা-উদ্বেগের মধ্যেও আশায় আছি, ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে অনুষ্ঠিত হয়। যদিও জানি, নির্বাচিত সরকার এলেই দেশে সব ঠিক হয়ে যাবে না।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত