Ajker Patrika

বাঙালির রাত পোহালো শারদ প্রাতে

অজয় দাশগুপ্ত
বাঙালির রাত পোহালো শারদ প্রাতে

রবীন্দ্রনাথের ঋতু বন্দনা আমরা জানি। বসন্ত হেমন্ত শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সব ঋতু নিয়েই কবিতা আর গান আছে তাঁর। অথচ এই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে। তার মানে কি অন্য ঋতুতে তাঁর রাত পোহায়নি? আসলে এই একটি ঋতুই আমাদের কাব্য-কলা-শিল্পে সমাদৃত বেশি। তাই কবি লিখেছেন, ‘ভালোই হয়েছে শরৎ এসেছে মেঘের সিংহ বাহনে’।

এই শরৎকালের আনন্দ পূর্ণ করে শারদ উৎসব, যা বাঙালি হিন্দুর জন্য দুর্গাপূজা। শারদীয় দুর্গাপূজার লেখা মানে কি শুধুই দেবীকে নিয়ে লেখা? তার বাইরেও পা ফেলার দরকার আছে। কারণ, দুর্গা যে শক্তি আর সাহসের উৎস, তার সঙ্গে যোগসূত্র না থাকলে বাঙালির উত্তরণ হবে না। উত্তরণ কোথা থেকে? কেন তার প্রয়োজন এই উত্তরণ?

আমি যেটা বলতে চাই, অধিক হারে কমে যাওয়া একটি জনসংখ্যার জীবনে পূজার আনন্দ আসলে কতটা? সংখ্যাধিক্য যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে তা-ও কিন্তু নয়। তবে কথা হচ্ছে, সংখ্যাগুরু যদি কোনো দেশে সংখ্যালঘুকে পায়ে দলে আনন্দ পায়, তাদের জীবন ও সম্মান সব সময় ভয়ের কাছে জিম্মি থাকে, তাহলে সে দেশে আনন্দ সর্বজনীন হয় কীভাবে? এর পরও আমরা দেখি পূজা এলেই আনন্দ আর পূজার ঢল নামে। আনন্দটা বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য হয়তো, তাই এটা চলমান। কিন্তু এত এত পূজা কী প্রমাণ করে?

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের অধিবেশনে যাওয়ার আগে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়েছিলেন। ভালো লেগেছে যখন তিনি বললেন দেশে থাকা হবে না বলেই তিনি আগেভাগে এসেছেন তাঁর সমর্থন ও শুভেচ্ছা জানাতে। এই প্রথম কেউ খুব সাধারণ ভাষায় নমস্কার জানিয়ে ভাষণ দিলেন। তাঁর এই শুভচিন্তার সঙ্গে সরকার বা প্রশাসনের যোগ ঘটলেই কাজ হবে। আমাদের কোনো খারাপ বা বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে না। এই স্বাভাবিক ও সাধারণ বিষয়টা আমরা ভুলে যাই। সংবিধান স্বীকৃত সব মানুষের ধর্মীয় অধিকার পালন করা না গেলে কী হয়, তা আমরা আগেও দেখেছি।

খুব বেশি দিনের কথা নয়, দেশত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর আমলে কুমিল্লার একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে পূজা বিঘ্নিত হয়েছিল। আক্রমণের শিকার হয়েছিল হিন্দু জনগোষ্ঠী। নারীর কান্না, শিশুর আর্তনাদ আর বয়স্কদের ভয়ার্ত মুখ আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল, এই দেশ যেন আমাদের নয়। অথচ সেটা ছিল কথিত সেক্যুলার আমল। কথিত বললাম এই কারণে, সে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত বা বিচার কিছুই দেখিনি আমরা। এরপর জাতীয় টেলিভিশনের এক টক শোতে আমার সঙ্গে অতিথি ছিলেন স্বনামধন্য বর্ষীয়ান অধ্যাপক সাবেক ভিসি সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। এই ভদ্রলোক মিতভাষী। যুক্তি দিয়ে কথা বললেও সে রাতে তিনি ঘটমান বাস্তবতার কথা মানতে চাননি। এই যে চোখ বুজে অস্বীকার, এর ফলাফল হাতে হাতে পেয়েছে স্বদেশ। মজার বিষয় হচ্ছে, কুমিল্লার এই ঘটনার নেপথ্যে থাকা তখনকার সরকারি দলের যে নেতা, তাঁকেও পালাতে হয়েছে। এবং পালিয়ে কোথায় আছেন তিনি? জান নিয়ে পালিয়ে বাঁচা এসব নেতা কোনো দিনই বাস্তবতা মানেননি। মানলে আজকে দেশের এই হাল দেখতে হতো না।

আমরা যাঁরা বিদেশে আছি, আমাদের জীবন এখানে নিরাপদ। আমাদের জীবন ও সম্মান হারানোর ভয় কম। কিন্তু আমরা যে দেশে জন্মেছি, যে দেশে বড় হয়েছি, সে দেশে আমাদের স্বজনেরা না নিরাপদ না আতঙ্কমুক্ত। এই আতঙ্কমুক্তির উপায় কি আমাদের অজানা?

দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বিদেশে যে উৎসব বা আয়োজন, তার ভেতর সংহতির বিষয়টা এখনো অনুপস্থিত। দেশে নির্যাতিত হিন্দু বা মুসলমান কিংবা যেকোনো গোষ্ঠীর জন্য দাঁড়াতে হবে আমাদের। গণতান্ত্রিক উন্নত দেশগুলোর সমস্যা হচ্ছে তারা আন্তর্জাতিকতার নামে এমন সব বিষয় অনুমোদন করে, যা হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। পশ্চিমা দেশ নামে পরিচিত অনেক দেশ এখন এর মাশুল দিচ্ছে। তারপরও তাদের চোখ খোলে না।

শারদ উৎসব শুধু পূজায় সীমাবদ্ধ কিছু না। এর সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিনোদনের যোগ নিবিড়। বাংলাদেশ বা পাশের বঙ্গে পূজার বাজার অর্থনীতিতে রাখে ব্যাপক অবদান। সেই কবে থেকে পূজাসংখ্যা মানেই বাঙালির ঘরে ঘরে লেখক-শিল্পীদের জয়জয়কার। একসময় পূজার গান ছিল আমাদের আনন্দের উপকরণ। আমাদের দেশেও তার প্রভাব আছে। আছে নিজস্ব ভঙ্গিতে গড়ে ওঠা গান, কবিতা অন্যকিছু। বাংলাদেশ বারবার প্রমাণ করেছে তার জীবনে অন্ধত্বের জায়গা নেই। যুগ যুগ ধরে মানুষ এখানে যার যার বিশ্বাস ও প্রথা মেনে জীবনযাপন করছে। তার ব্যতিক্রম হলেই নিয়তি আমাদের ছেড়ে কথা বলে না। আজ যেসব উৎপাত বা ঝামেলা, তা সাময়িক। ইতিহাস আর ঐতিহ্য তা-ই বলে। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমাদের মূল শক্তিই হচ্ছে বিশ্বাস, পারস্পরিক সম্মান আর সহাবস্থান। এখানে রাজনীতি মুখ্য হতে পারে না। তার জায়গায় সে থাকুক। আমাদের দরকার সমাজ সম্মিলন, যা শারদীয়ার মাধ্যমে পালিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। দেশ সবার। সমাজ সবার। আনন্দও সবার।

পূজায় আমাদের সংকল্প হোক মাতৃভূমির পবিত্রতা ও সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা। শুরুতে যে পরিসংখ্যান দিয়েছি, তা ভয়াবহ।

শান্তি কামনা করা আর শান্তি স্থাপন করা দুটো ভিন্ন বিষয়। শান্তি কামনা করলেও শান্তি আসবে না, যদি মানুষ নিজে নিজেকে বাঁচাতে না পারে। এই আত্মত্রাণের উপায় সংঘবদ্ধ হওয়া। তারপর নিজেরা নিজেদের এবং অপরের কল্যাণে কাজ করা। মনে রাখতে হবে, ভগবান রামচন্দ্রকেও দেবী দুর্গার শরণ নিতে হয়েছিল। তাঁর করুণা আর কৃপাতেই সম্ভব হয়েছিল রাবণবধ। তাহলে আমরা কেন পিছিয়ে? উগ্রতা, সন্ত্রাস ও হানাহানির বিরুদ্ধে একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ এখন জরুরি।

আসন্ন শারদীয় উৎসবের এই লেখাটি ভক্তিরসের বিপরীতে শক্তিরসে জাগ্রত করুক সবাইকে। দেবী মাতা দুর্গার আশীর্বাদে দুর্গতি কাটুক।

লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত