মযহারুল ইসলাম বাবলা
চব্বিশের ৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর নিষ্ক্রিয় অবস্থান গ্রহণ অর্থাৎ, ক্ষমতায় থাকা সরকারের নির্দেশ অমান্যের ফলে এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থানে বিগত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। ত্যাগ-আত্মত্যাগের পর সরকার বদলে ভিন্ন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে কি? না, হয়নি—সেটা আমরা গত প্রায় এক বছরের অভিজ্ঞতায় নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলন নিশ্চয়ই যৌক্তিক ছিল বলেই আপামর জনগণ তাতে সমর্থন করেছিল। কিন্তু একটি নিরীহ কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের এক দফায় পরিণত হলো কীভাবে? এই আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটবে—এটা সরকার এবং দেশের আপামর জনগণের চিন্তা-ভাবনায় মোটেও আসেনি। স্বীকার করতে হবে, বিগত সরকারপ্রধানের বেফাঁস বক্তব্য এবং ছাত্রলীগের মাস্তানদের আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার ফলেই আন্দোলনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। আমাদের বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা প্রকাশ্যে বলেছেন, একটি ‘ম্যাটিকুলাস ডিজাইন’-এর মাধ্যমে এই আন্দোলন সফল পরিণতি লাভ করেছে। সেই ম্যাটিকুলাস ডিজাইন বাস্তবায়নে আন্দোলনকারী নেতৃত্ব সফল হয়েছিল। আর এটা বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী জনৈক মাহফুজ আলমকে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে আমেরিকায় প্রকাশ্যে পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিলেন।
গত এক বছরে আন্দোলনকারীদের নানা রহস্য উন্মোচিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম রহস্য হচ্ছে স্নাইপার রাইফেলের ব্যবহার। আন্দোলনে প্রাণদানকারীদের শরীরে বিদ্ধ গুলি নিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন স্বয়ং বলেছেন, এই গুলির অস্ত্র পুলিশের কাছে থাকার কথা নয়। কেননা, পুলিশের এই অস্ত্র নেই। এটা ন্যাটো বাহিনীর অস্ত্র। তাহলে কি ওই অস্ত্র ব্যবহার ম্যাটিকুলাস ডিজাইনেরই অংশ ছিল? দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দল আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করলেও তারা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী বৃত্তের আশপাশেও ঘেঁষতে পারেনি। সৎ আকাঙ্ক্ষায় ব্যাপক অংশগ্রহণের পরও ম্যাটিকুলাস ডিজাইন বাস্তবায়নে তাদের কামলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ব্যাপক ত্যাগ-আত্মত্যাগ করলেও নীতিনির্ধারণে তাদের কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি এবং দেওয়াও হয়নি।
ম্যাটিকুলাস ডিজাইন সফল হওয়ার ফলে এবং সেনাপ্রধানের ভূমিকায় বিমানবাহিনীর বিমানে করে শেখ হাসিনাকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার পরই ঘটে অনভিপ্রেত অরাজকতা। আন্দোলনকারীর বাতাবরণে মিছিল করে লুণ্ঠনকারীরা নেমে পড়ে অবাধ লুণ্ঠনে, ভাঙা হয় ঢাকায় স্থাপিত প্রায় সব ভাস্কর্য। এরা যে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ছিল না, সেটা পরিষ্কার বোঝা গেছে তাদের পোশাক ও মুখচ্ছবিতে। ধর্মীয় স্লোগানে তারা সব শিল্পকর্ম গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য, শিল্পী জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ভিত্তিক স্মারক ভাস্কর্যগুলোও। দেশের কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা দায়িত্ব নেওয়া সেনাসদস্যদের দেখা যায়নি অরাজক, লুণ্ঠনকারীদের রুখতে। পরিস্থিতির এই মোক্ষম সুযোগ গ্রহণ করে সুযোগসন্ধানীরা। জাতীয় স্থাপনা, সম্পদ ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে বিনা বাধায়। অরক্ষিত গণভবন, জাতীয় সংসদ ভবন—সর্বত্রই লুণ্ঠনকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশবাসী তাদের অপকীর্তির ভিডিও ফুটেজ দেখেছে। মারাত্মক ঘৃণিত কাজটি করেছে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণে, যেটা আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ওপর কুঠারাঘাততুল্য। আশার কথা, দেশের আপামর জনগণ তাৎক্ষণিক বিষয়টি উপলব্ধি করে নিজেরাই পাহারা দিয়ে রক্ষা করেছে হিন্দুমন্দির, আশ্রম এবং তাদের বাড়িঘর। শিক্ষার্থীদের সফল আন্দোলনের পর থেকে চার দিন দেশ কার্যত অরক্ষিত এবং লুণ্ঠনকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পরও অবাধ লুণ্ঠন, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে দেশব্যাপী। ওদিকে আমাদের পুলিশের অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়ায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে। ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের দেখা গেছে তারা নিজ দায়িত্বে দেশের ট্রাফিক-ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেছে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে, যেটি আমরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে দেখেছিলাম। তাই সড়কে যানজট নিরসন সম্ভব হয়েছিল।
যে বাড়িটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, স্মৃতি জাদুঘর—সেটা তো রাষ্ট্রের সম্পদ। সেটা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার কারণ খুঁজে পেলাম না। ওই বাড়ি একাত্তরে কিংবা পঁচাত্তরের মধ্য আগস্টেও পোড়ানোর সাহস হয়নি পাকিস্তানি হানাদারদের এবং আত্মস্বীকৃত খুনিদের। অথচ ধর্মীয় স্লোগান দিয়ে সুযোগসন্ধানীরা সেটা পুড়িয়ে দিয়েছে বিনা বাধায়। পরবর্তী সময়ে ম্যাটিকুলাস ডিজাইন বাস্তবায়নকারীরা তিন দিন ধরে রাষ্ট্রের বুলডোজার, এক্সকাভেটর দিয়ে ভবনটিই গুঁড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ ও সেনাসদস্যদের উপস্থিতিতে। স্বীকার করছি, বিগত স্বৈরাচারী সরকারের প্রতি মানুষের তীব্র ক্ষোভ-ঘৃণা রয়েছে। অগণিত শিক্ষার্থী-জনতার নৃশংস হত্যার কারণে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ও তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে নির্মিত স্মারক ভাস্কর্য ভাঙা। এটা অনিবার্যরূপে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তাতে সন্দেহ নেই। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করা ইত্যাদি অপকর্ম নিশ্চয়ই মেনে নেওয়া যায় না। এগুলো অনিবার্যরূপে উদ্দেশ্যমূলক স্বাধীনতাবিরোধীদেরই কাজ, তাতে দ্বিমতের অবকাশ নেই। আমাদের অতীত ইতিহাস এবং ঐতিহ্য-সংস্কৃতি অসাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টান্ত ধ্বংসযজ্ঞে দেশবাসী প্রকৃত বার্তা তখনই পেয়েছে। সাম্প্রদায়িক হানাহানিকে এ জাতি কখনো বরদাশত করেনি। বাংলাদেশ আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত রেখেছে। ছাত্রছাত্রীদের আত্মত্যাগে যে অর্জন, সেই অর্জন কলুষিত করা হয়েছে এসব অপকীর্তিতে। ধর্ম-বর্ণ-জাতিনির্বিশেষে সব নাগরিকের অভিন্ন অধিকার আমাদের সংবিধান নিশ্চিত করেছে। সেটা রক্ষা করা সব সরকারের যেমন, তেমনি দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক মানুষেরও অনিবার্য কর্তব্য বলেই মনে করি।
গত এক বছরের সীমাহীন মব সন্ত্রাস ও অরাজক অপকীর্তিতে প্রমাণিত হয়েছে এটি হাজার বছরের বাঙালির অর্জন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গঠিত রাষ্ট্রকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত, যা অবিরাম ঘটে চলেছে। অর্থাৎ, ১৬ ডিসেম্বরের অর্জন উল্টো পথে ঘুরিয়ে দেওয়ার অজস্র দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে।
এত অধিক মানুষের ত্যাগ-আত্মত্যাগের অর্জন যে ছিনতাই হয়ে গেছে, সেটা বিলক্ষণ। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরবর্তী সময়ে সমাজে সব ধরনের বৈষম্য বেড়েছে বলে অভিযোগ উঠছে। অতীতের গণ-অভ্যুত্থানের অভিন্ন পরিণতিই কি ঘটল এবারও? রাষ্ট্র, সরকার ও সরকারি দল কিংস পার্টির প্রতিহিংসা, লুণ্ঠনের দৃশ্যমানতা জনমনে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। মানুষ বারবার আশাবাদী হয়ে ওঠে, কিন্তু বারবার আশাহত হয়েছে। একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, কিন্তু সেই স্বাধীনতা সমষ্টিগত মানুষকে স্বাধীন করেনি, দেয়নি মুক্তিও। নির্বাচিত এবং অনির্বাচিত স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার অধীনে ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু সমষ্টিগত মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এবারও যে হবে না, তার আলামত তো পরিষ্কার। শাসকশ্রেণির বৃত্ত অতিক্রম করে জনগণের রাষ্ট্র ও সরকার গঠন করা সম্ভব না হলে আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেখানেই আমাদের অবস্থান নিশ্চিত হয় পড়বে।
সরকার বদলই শেষ কথা নয়। আমরা গত ৫৪ বছর সরকার বদলের অনেক ঘটনা দেখেছি, নানা রূপে। কিন্তু সরকার বদলে দেশের যে মূল সমস্যা বৈষম্য, তার অবসান ঘটেনি। বরং উত্তরোত্তর বেড়েছে। সব মানুষের অধিকার, মর্যাদা ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠায় অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রত্যাশা কি অধরাই রয়ে যাবে? পূরণ হওয়ার লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না।
লেখক ও কলামিস্ট
চব্বিশের ৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর নিষ্ক্রিয় অবস্থান গ্রহণ অর্থাৎ, ক্ষমতায় থাকা সরকারের নির্দেশ অমান্যের ফলে এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থানে বিগত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। ত্যাগ-আত্মত্যাগের পর সরকার বদলে ভিন্ন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে কি? না, হয়নি—সেটা আমরা গত প্রায় এক বছরের অভিজ্ঞতায় নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলন নিশ্চয়ই যৌক্তিক ছিল বলেই আপামর জনগণ তাতে সমর্থন করেছিল। কিন্তু একটি নিরীহ কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের এক দফায় পরিণত হলো কীভাবে? এই আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটবে—এটা সরকার এবং দেশের আপামর জনগণের চিন্তা-ভাবনায় মোটেও আসেনি। স্বীকার করতে হবে, বিগত সরকারপ্রধানের বেফাঁস বক্তব্য এবং ছাত্রলীগের মাস্তানদের আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার ফলেই আন্দোলনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। আমাদের বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা প্রকাশ্যে বলেছেন, একটি ‘ম্যাটিকুলাস ডিজাইন’-এর মাধ্যমে এই আন্দোলন সফল পরিণতি লাভ করেছে। সেই ম্যাটিকুলাস ডিজাইন বাস্তবায়নে আন্দোলনকারী নেতৃত্ব সফল হয়েছিল। আর এটা বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী জনৈক মাহফুজ আলমকে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে আমেরিকায় প্রকাশ্যে পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছিলেন।
গত এক বছরে আন্দোলনকারীদের নানা রহস্য উন্মোচিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম রহস্য হচ্ছে স্নাইপার রাইফেলের ব্যবহার। আন্দোলনে প্রাণদানকারীদের শরীরে বিদ্ধ গুলি নিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন স্বয়ং বলেছেন, এই গুলির অস্ত্র পুলিশের কাছে থাকার কথা নয়। কেননা, পুলিশের এই অস্ত্র নেই। এটা ন্যাটো বাহিনীর অস্ত্র। তাহলে কি ওই অস্ত্র ব্যবহার ম্যাটিকুলাস ডিজাইনেরই অংশ ছিল? দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দল আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করলেও তারা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী বৃত্তের আশপাশেও ঘেঁষতে পারেনি। সৎ আকাঙ্ক্ষায় ব্যাপক অংশগ্রহণের পরও ম্যাটিকুলাস ডিজাইন বাস্তবায়নে তাদের কামলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ব্যাপক ত্যাগ-আত্মত্যাগ করলেও নীতিনির্ধারণে তাদের কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি এবং দেওয়াও হয়নি।
ম্যাটিকুলাস ডিজাইন সফল হওয়ার ফলে এবং সেনাপ্রধানের ভূমিকায় বিমানবাহিনীর বিমানে করে শেখ হাসিনাকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার পরই ঘটে অনভিপ্রেত অরাজকতা। আন্দোলনকারীর বাতাবরণে মিছিল করে লুণ্ঠনকারীরা নেমে পড়ে অবাধ লুণ্ঠনে, ভাঙা হয় ঢাকায় স্থাপিত প্রায় সব ভাস্কর্য। এরা যে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ছিল না, সেটা পরিষ্কার বোঝা গেছে তাদের পোশাক ও মুখচ্ছবিতে। ধর্মীয় স্লোগানে তারা সব শিল্পকর্ম গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বাদ যায়নি বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য, শিল্পী জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ভিত্তিক স্মারক ভাস্কর্যগুলোও। দেশের কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা দায়িত্ব নেওয়া সেনাসদস্যদের দেখা যায়নি অরাজক, লুণ্ঠনকারীদের রুখতে। পরিস্থিতির এই মোক্ষম সুযোগ গ্রহণ করে সুযোগসন্ধানীরা। জাতীয় স্থাপনা, সম্পদ ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে বিনা বাধায়। অরক্ষিত গণভবন, জাতীয় সংসদ ভবন—সর্বত্রই লুণ্ঠনকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশবাসী তাদের অপকীর্তির ভিডিও ফুটেজ দেখেছে। মারাত্মক ঘৃণিত কাজটি করেছে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণে, যেটা আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ওপর কুঠারাঘাততুল্য। আশার কথা, দেশের আপামর জনগণ তাৎক্ষণিক বিষয়টি উপলব্ধি করে নিজেরাই পাহারা দিয়ে রক্ষা করেছে হিন্দুমন্দির, আশ্রম এবং তাদের বাড়িঘর। শিক্ষার্থীদের সফল আন্দোলনের পর থেকে চার দিন দেশ কার্যত অরক্ষিত এবং লুণ্ঠনকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পরও অবাধ লুণ্ঠন, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে দেশব্যাপী। ওদিকে আমাদের পুলিশের অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়ায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে। ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের দেখা গেছে তারা নিজ দায়িত্বে দেশের ট্রাফিক-ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেছে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে, যেটি আমরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে দেখেছিলাম। তাই সড়কে যানজট নিরসন সম্ভব হয়েছিল।
যে বাড়িটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, স্মৃতি জাদুঘর—সেটা তো রাষ্ট্রের সম্পদ। সেটা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার কারণ খুঁজে পেলাম না। ওই বাড়ি একাত্তরে কিংবা পঁচাত্তরের মধ্য আগস্টেও পোড়ানোর সাহস হয়নি পাকিস্তানি হানাদারদের এবং আত্মস্বীকৃত খুনিদের। অথচ ধর্মীয় স্লোগান দিয়ে সুযোগসন্ধানীরা সেটা পুড়িয়ে দিয়েছে বিনা বাধায়। পরবর্তী সময়ে ম্যাটিকুলাস ডিজাইন বাস্তবায়নকারীরা তিন দিন ধরে রাষ্ট্রের বুলডোজার, এক্সকাভেটর দিয়ে ভবনটিই গুঁড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ ও সেনাসদস্যদের উপস্থিতিতে। স্বীকার করছি, বিগত স্বৈরাচারী সরকারের প্রতি মানুষের তীব্র ক্ষোভ-ঘৃণা রয়েছে। অগণিত শিক্ষার্থী-জনতার নৃশংস হত্যার কারণে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ও তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে নির্মিত স্মারক ভাস্কর্য ভাঙা। এটা অনিবার্যরূপে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তাতে সন্দেহ নেই। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করা ইত্যাদি অপকর্ম নিশ্চয়ই মেনে নেওয়া যায় না। এগুলো অনিবার্যরূপে উদ্দেশ্যমূলক স্বাধীনতাবিরোধীদেরই কাজ, তাতে দ্বিমতের অবকাশ নেই। আমাদের অতীত ইতিহাস এবং ঐতিহ্য-সংস্কৃতি অসাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টান্ত ধ্বংসযজ্ঞে দেশবাসী প্রকৃত বার্তা তখনই পেয়েছে। সাম্প্রদায়িক হানাহানিকে এ জাতি কখনো বরদাশত করেনি। বাংলাদেশ আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত রেখেছে। ছাত্রছাত্রীদের আত্মত্যাগে যে অর্জন, সেই অর্জন কলুষিত করা হয়েছে এসব অপকীর্তিতে। ধর্ম-বর্ণ-জাতিনির্বিশেষে সব নাগরিকের অভিন্ন অধিকার আমাদের সংবিধান নিশ্চিত করেছে। সেটা রক্ষা করা সব সরকারের যেমন, তেমনি দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক মানুষেরও অনিবার্য কর্তব্য বলেই মনে করি।
গত এক বছরের সীমাহীন মব সন্ত্রাস ও অরাজক অপকীর্তিতে প্রমাণিত হয়েছে এটি হাজার বছরের বাঙালির অর্জন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গঠিত রাষ্ট্রকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত, যা অবিরাম ঘটে চলেছে। অর্থাৎ, ১৬ ডিসেম্বরের অর্জন উল্টো পথে ঘুরিয়ে দেওয়ার অজস্র দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে।
এত অধিক মানুষের ত্যাগ-আত্মত্যাগের অর্জন যে ছিনতাই হয়ে গেছে, সেটা বিলক্ষণ। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরবর্তী সময়ে সমাজে সব ধরনের বৈষম্য বেড়েছে বলে অভিযোগ উঠছে। অতীতের গণ-অভ্যুত্থানের অভিন্ন পরিণতিই কি ঘটল এবারও? রাষ্ট্র, সরকার ও সরকারি দল কিংস পার্টির প্রতিহিংসা, লুণ্ঠনের দৃশ্যমানতা জনমনে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। মানুষ বারবার আশাবাদী হয়ে ওঠে, কিন্তু বারবার আশাহত হয়েছে। একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, কিন্তু সেই স্বাধীনতা সমষ্টিগত মানুষকে স্বাধীন করেনি, দেয়নি মুক্তিও। নির্বাচিত এবং অনির্বাচিত স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার অধীনে ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু সমষ্টিগত মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এবারও যে হবে না, তার আলামত তো পরিষ্কার। শাসকশ্রেণির বৃত্ত অতিক্রম করে জনগণের রাষ্ট্র ও সরকার গঠন করা সম্ভব না হলে আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেখানেই আমাদের অবস্থান নিশ্চিত হয় পড়বে।
সরকার বদলই শেষ কথা নয়। আমরা গত ৫৪ বছর সরকার বদলের অনেক ঘটনা দেখেছি, নানা রূপে। কিন্তু সরকার বদলে দেশের যে মূল সমস্যা বৈষম্য, তার অবসান ঘটেনি। বরং উত্তরোত্তর বেড়েছে। সব মানুষের অধিকার, মর্যাদা ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠায় অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রত্যাশা কি অধরাই রয়ে যাবে? পূরণ হওয়ার লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না।
লেখক ও কলামিস্ট
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। গত বছর জুলাই-আগস্টে দেশে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। তখন সাধারণ মানুষের মনে একধরনের ইতিবাচক প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল।
৩ ঘণ্টা আগেবর্ষাকাল এলেই যেন ঢাকায় জলাবদ্ধতা ভর করে বসে। জলাবদ্ধতা যখন এই শহরের ঘাড়ে চেপে বসে, তখন এই নগরের মানুষকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আজ এই শহরের এত সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো না যদি তারা অপরিকল্পিত নগরায়ণের দিকে না ঝুঁকত, যদি নদী কিংবা খালের স্থান দখল না করে কোনো স্থাপনা করার পরিকল্পনা করত।
৩ ঘণ্টা আগেটাঙ্গাইলের সখীপুর-কচুয়া-আড়াইপাড়া সড়কের যে করুণ অবস্থা, তা আসলে আমাদের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার এক করুণ প্রতিচ্ছবি। সাত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক—যেখানে প্রতিদিন স্কুলশিক্ষার্থী, রোগী, কৃষিপণ্যবাহী ট্রাক ও হাজারো সাধারণ মানুষ চলাচল করে।
৩ ঘণ্টা আগেজুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে গেল। ওই অভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। মূলত তারা ফ্যাসিবাদী সরকারব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। মূলত বাংলাদেশের মূল সমস্যা সেটাই যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে একটি
১ দিন আগে