জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আনিসুর রহমান। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। নিয়মিত লেখালেখি করেন। এ ছাড়া তিনি গ্লোবাল সাউথ স্টাডিস অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার আব্দুর রাজ্জাক খান।
আব্দুর রাজ্জাক খান
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে কি সত্যিকার অর্থে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে?
জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে গেল। ওই অভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। মূলত তারা ফ্যাসিবাদী সরকারব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। মূলত বাংলাদেশের মূল সমস্যা সেটাই যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে একটি কল্যাণকর জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পায়নি। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হলেও জুলাই অভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত একটি জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার কতটুকু অবদান রাখতে পারল, তা বোঝা যাবে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে।
জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হয়েছে, তাদের সম্ভাবনা কতটা দেখছেন?
ভালো কথা যে দেশে তরুণদের নেতৃত্বে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য নতুন নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চেয়েও বেশি দরকার জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করা।
তরুণদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনকে আমি স্বাগত জানাই। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় সংকট হলো বাংলাদেশে হালনাগাদে কোনো রাষ্ট্র দার্শনিকের জন্ম হয়নি। নতুন যে তরুণেরা রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, তাঁদের রাষ্ট্রদর্শন কোথায়? দেখুন আধুনিক যুগের মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতাদের একজন করে রাষ্ট্র দার্শনিক আছেন। ধরুন তুরস্কের এরদোয়ানের রাষ্ট্র দার্শনিক প্রফেসর ডক্টর নেজমুদ্দিন এরবাকান কিংবা বর্তমান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক শিক্ষক কিন্তু মাহাথির মোহাম্মদ। বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দলের রাষ্ট্র দার্শনিক না থাকার জন্য তাদের মাঝেমধ্যে সংকটে পড়ার আশঙ্কা থাকবে। এখন তারা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি বিষয়ে পণ্ডিতদের কাছে শিক্ষা নিতে পারে।
দেশে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে—এটি নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ কী?
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে না পারা। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যে এটার লাগাম টানতে না পারলে মানুষ বলবে যে ফ্যাসিস্ট আমল ভালো ছিল।
যাঁরা দেশে পরিবর্তন আনলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে একধরনের মব চলছে। এটি একধরনের অসভ্যতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পূর্ণ সক্রিয় হলে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। জাতি হিসেবে আমরা কতটুকু সভ্য, তা মব কালচার দেখলে প্রতীয়মান হয়। জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণ যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছে, মব কালচার তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। প্রথম দিকে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, দখল-বাণিজ্য ব্যাপক ছিল। গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এসবের বিরুদ্ধে প্রচারণা চলায় একধরনের গণজাগরণ তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে এসব বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়গুলো বিলুপ্ত করা গেলে আধুনিক রাষ্ট্র গঠন ততটা কঠিন হবে না।
রংপুরের গঙ্গাচড়ায় মহানবী (সা.)-কে নিয়ে অবমাননাকর ফেসবুক পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন হওয়ার বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
দেখুন, ধর্মকে ব্যবহার করে বা ধর্মীয় উসকানিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষকে সবচেয়ে সহজে ইমোশনালি ব্যবহার করা যায়। যারা এ কাজগুলো করে তাদের ব্যাপারে রাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জনগণ সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। প্রায়ই বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ শোনা যায়। এগুলো নিন্দনীয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে এগুলোর সত্য-মিথ্যা যাচাই করা হয় না। তা ছাড়া, একজনের অপরাধের কারণে অন্য নিরপরাধ মানুষদের নিগৃহীত করা কোনো যুক্তির কথা নয়। সব নাগরিককে অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। হুজুগ পরিহার করে চলতে হবে। আবেগসর্বস্ব না হয়ে যুক্তিবাদী হতে হবে।
নির্বাচন নিয়ে আপনি কি কোনো অনিশ্চয়তা দেখছেন?
নির্বাচন নিয়ে আপাতত কোনো অনিশ্চয়তা আছে বলে মনে হচ্ছে না। সরকারপ্রধান এ ব্যাপারে একাধিকবার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায় যে আমরা একটি গ্রহণযোগ্য অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে যাচ্ছি। তবে অনেক সমস্যা একেবারেই নেই, তা নয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক ধরনের জাতীয়, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথা রাজনৈতিক মহল থেকেই বলা হচ্ছে। জুলাই সনদ নিয়েও মতভিন্নতার কথা শোনা যায়। এ ক্ষেত্রে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে।
ছয় বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হতে যাচ্ছে—এ নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন?
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষের মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয় হবে জ্ঞানচর্চার জায়গা, মুক্তবুদ্ধি ও সংস্কৃতিচর্চার জায়গা। এটি কেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পার্টি অফিসের মতো থাকবে? ইউরোপের কোনো দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি নেই। তাই বলে কি তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ও গবেষণা আমাদের চেয়ে পিছিয়ে? একজন ছাত্র ছাত্রত্ব শেষ করে হয়তো চাকরি করবেন, নয়তো রাজনীতি করবেন। তবে ভারতীয় উপমহাদেশের সবগুলো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি সক্রিয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু যেহেতু অতীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক অবদান রেখেছে, তাই ডাকসু নির্বাচনকে ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত।
বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূ-রাজনীতির বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
ভৌগোলিক কৌশলগত দিক থেকে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে একটি বড় শ্রমবাজার রয়েছে। বঙ্গোপসাগর খুবই কৌশলগত স্থানে অবস্থিত। সুতরাং এ দেশটির সঙ্গে প্রতিবেশী ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে রাজনীতিবিদদের ঐকমত্যে আসতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ একটি উন্নত প্রাগমেটিক পররাষ্ট্রনীতি প্রবর্তন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের দেশে পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক অধ্যয়ন বা পরিকল্পনা করার জন্য কোনো নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠান নেই। একটি রাষ্ট্র ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, পররাষ্ট্রনীতি তার দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। এর সঙ্গে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বাণিজ্য, বহিঃসম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আগামী দিনগুলোতে সরকার ও পলিসি মেকাররা একটি বাস্তববাদী পররাষ্ট্রনীতি প্রবর্তন করবেন—এটা আমাদের প্রত্যাশা। পররাষ্ট্রনীতিতে সাধারণত জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভবিষ্যৎ উন্নয়ন, দেশের কৃষ্টি-কালচার ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
আমেরিকার শুল্ক আরোপ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে আপনি আশঙ্কা করছেন?
আপনাকে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার আমেরিকা। সুতরাং আমেরিকার শুল্ক আরোপ বিষয়টি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপ বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে যদি করারোপের মাত্রা অন্যান্য দেশের তুলনায় কম হয়, সেটাই আমাদের জন্য স্বস্তির। তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশি পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক পূর্বঘোষিত ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে সবার মধ্যেই স্বস্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকার সাফল্য দাবি করতেই পারে।
নতুন প্রজন্ম ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য আপনার কী বার্তা থাকবে?
নতুন প্রজন্ম ও নতুন নেতৃত্বের প্রতি আমার ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যাশা অনেক বেশি। কারণ, এই প্রজন্মের মাধ্যমেই বাংলাদেশে একটি মোড় পরিবর্তনকারী গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। তবে নতুন প্রজন্মকে অত্যন্ত বিচক্ষণ ও রাজনৈতিক জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। ইমোশন দিয়ে রাজনীতি চলে না। রাজনীতিতে সব সময় বাস্তববাদী হতে হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট রাজনীতি। এত সুন্দর সবুজ শ্যামল উর্বর ভূমি বাংলাদেশ। এ দেশে সব উন্নয়নের অন্তরায় অপরাজনীতি। ধরুন, আপনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ জন্ম দিলেন। সব ঠিক আছে, কিন্তু যদি হঠাৎ দেশে কোনো রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়, আপনার সব ভেস্তে যাবে। উন্নত দেশগুলো উন্নত হয়েছে উন্নত রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে। রাজনৈতিক চর্চায় অন্য দলের প্রতি, অন্য মতের প্রতি আপনাকে অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আর রাজনীতি হওয়া উচিত জনগণের জন্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতি পরিণত হয়েছে একধরনের ব্যবসায়। আপনি এখানে ইনভেস্ট করবেন, তার বিনিময়ে আপনি জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে কানাডা, আমেরিকায় বেগমপাড়া গড়ে তুলবেন। আমাদের এই অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে এসে বাংলাদেশকে ভালোবেসে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে দুর্নীতিমুক্ত দেশ করতে পারলেই আমরা ভবিষ্যতে উন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারব।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে কি সত্যিকার অর্থে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে?
জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে গেল। ওই অভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। মূলত তারা ফ্যাসিবাদী সরকারব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। মূলত বাংলাদেশের মূল সমস্যা সেটাই যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে একটি কল্যাণকর জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পায়নি। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হলেও জুলাই অভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত একটি জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার কতটুকু অবদান রাখতে পারল, তা বোঝা যাবে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে।
জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হয়েছে, তাদের সম্ভাবনা কতটা দেখছেন?
ভালো কথা যে দেশে তরুণদের নেতৃত্বে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য নতুন নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চেয়েও বেশি দরকার জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করা।
তরুণদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনকে আমি স্বাগত জানাই। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় সংকট হলো বাংলাদেশে হালনাগাদে কোনো রাষ্ট্র দার্শনিকের জন্ম হয়নি। নতুন যে তরুণেরা রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, তাঁদের রাষ্ট্রদর্শন কোথায়? দেখুন আধুনিক যুগের মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতাদের একজন করে রাষ্ট্র দার্শনিক আছেন। ধরুন তুরস্কের এরদোয়ানের রাষ্ট্র দার্শনিক প্রফেসর ডক্টর নেজমুদ্দিন এরবাকান কিংবা বর্তমান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক শিক্ষক কিন্তু মাহাথির মোহাম্মদ। বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দলের রাষ্ট্র দার্শনিক না থাকার জন্য তাদের মাঝেমধ্যে সংকটে পড়ার আশঙ্কা থাকবে। এখন তারা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি বিষয়ে পণ্ডিতদের কাছে শিক্ষা নিতে পারে।
দেশে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে—এটি নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ কী?
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে না পারা। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যে এটার লাগাম টানতে না পারলে মানুষ বলবে যে ফ্যাসিস্ট আমল ভালো ছিল।
যাঁরা দেশে পরিবর্তন আনলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে একধরনের মব চলছে। এটি একধরনের অসভ্যতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পূর্ণ সক্রিয় হলে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। জাতি হিসেবে আমরা কতটুকু সভ্য, তা মব কালচার দেখলে প্রতীয়মান হয়। জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণ যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছে, মব কালচার তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। প্রথম দিকে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, দখল-বাণিজ্য ব্যাপক ছিল। গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এসবের বিরুদ্ধে প্রচারণা চলায় একধরনের গণজাগরণ তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে এসব বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়গুলো বিলুপ্ত করা গেলে আধুনিক রাষ্ট্র গঠন ততটা কঠিন হবে না।
রংপুরের গঙ্গাচড়ায় মহানবী (সা.)-কে নিয়ে অবমাননাকর ফেসবুক পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন হওয়ার বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
দেখুন, ধর্মকে ব্যবহার করে বা ধর্মীয় উসকানিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষকে সবচেয়ে সহজে ইমোশনালি ব্যবহার করা যায়। যারা এ কাজগুলো করে তাদের ব্যাপারে রাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জনগণ সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। প্রায়ই বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ শোনা যায়। এগুলো নিন্দনীয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে এগুলোর সত্য-মিথ্যা যাচাই করা হয় না। তা ছাড়া, একজনের অপরাধের কারণে অন্য নিরপরাধ মানুষদের নিগৃহীত করা কোনো যুক্তির কথা নয়। সব নাগরিককে অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। হুজুগ পরিহার করে চলতে হবে। আবেগসর্বস্ব না হয়ে যুক্তিবাদী হতে হবে।
নির্বাচন নিয়ে আপনি কি কোনো অনিশ্চয়তা দেখছেন?
নির্বাচন নিয়ে আপাতত কোনো অনিশ্চয়তা আছে বলে মনে হচ্ছে না। সরকারপ্রধান এ ব্যাপারে একাধিকবার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায় যে আমরা একটি গ্রহণযোগ্য অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে যাচ্ছি। তবে অনেক সমস্যা একেবারেই নেই, তা নয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক ধরনের জাতীয়, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কথা রাজনৈতিক মহল থেকেই বলা হচ্ছে। জুলাই সনদ নিয়েও মতভিন্নতার কথা শোনা যায়। এ ক্ষেত্রে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে।
ছয় বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হতে যাচ্ছে—এ নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন?
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষের মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয় হবে জ্ঞানচর্চার জায়গা, মুক্তবুদ্ধি ও সংস্কৃতিচর্চার জায়গা। এটি কেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পার্টি অফিসের মতো থাকবে? ইউরোপের কোনো দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি নেই। তাই বলে কি তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ও গবেষণা আমাদের চেয়ে পিছিয়ে? একজন ছাত্র ছাত্রত্ব শেষ করে হয়তো চাকরি করবেন, নয়তো রাজনীতি করবেন। তবে ভারতীয় উপমহাদেশের সবগুলো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি সক্রিয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু যেহেতু অতীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক অবদান রেখেছে, তাই ডাকসু নির্বাচনকে ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত।
বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূ-রাজনীতির বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
ভৌগোলিক কৌশলগত দিক থেকে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে একটি বড় শ্রমবাজার রয়েছে। বঙ্গোপসাগর খুবই কৌশলগত স্থানে অবস্থিত। সুতরাং এ দেশটির সঙ্গে প্রতিবেশী ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে রাজনীতিবিদদের ঐকমত্যে আসতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ একটি উন্নত প্রাগমেটিক পররাষ্ট্রনীতি প্রবর্তন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের দেশে পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক অধ্যয়ন বা পরিকল্পনা করার জন্য কোনো নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠান নেই। একটি রাষ্ট্র ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, পররাষ্ট্রনীতি তার দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। এর সঙ্গে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বাণিজ্য, বহিঃসম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আগামী দিনগুলোতে সরকার ও পলিসি মেকাররা একটি বাস্তববাদী পররাষ্ট্রনীতি প্রবর্তন করবেন—এটা আমাদের প্রত্যাশা। পররাষ্ট্রনীতিতে সাধারণত জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভবিষ্যৎ উন্নয়ন, দেশের কৃষ্টি-কালচার ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
আমেরিকার শুল্ক আরোপ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে আপনি আশঙ্কা করছেন?
আপনাকে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার আমেরিকা। সুতরাং আমেরিকার শুল্ক আরোপ বিষয়টি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপ বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে যদি করারোপের মাত্রা অন্যান্য দেশের তুলনায় কম হয়, সেটাই আমাদের জন্য স্বস্তির। তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশি পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক পূর্বঘোষিত ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে সবার মধ্যেই স্বস্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকার সাফল্য দাবি করতেই পারে।
নতুন প্রজন্ম ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য আপনার কী বার্তা থাকবে?
নতুন প্রজন্ম ও নতুন নেতৃত্বের প্রতি আমার ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যাশা অনেক বেশি। কারণ, এই প্রজন্মের মাধ্যমেই বাংলাদেশে একটি মোড় পরিবর্তনকারী গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। তবে নতুন প্রজন্মকে অত্যন্ত বিচক্ষণ ও রাজনৈতিক জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। ইমোশন দিয়ে রাজনীতি চলে না। রাজনীতিতে সব সময় বাস্তববাদী হতে হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট রাজনীতি। এত সুন্দর সবুজ শ্যামল উর্বর ভূমি বাংলাদেশ। এ দেশে সব উন্নয়নের অন্তরায় অপরাজনীতি। ধরুন, আপনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ জন্ম দিলেন। সব ঠিক আছে, কিন্তু যদি হঠাৎ দেশে কোনো রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়, আপনার সব ভেস্তে যাবে। উন্নত দেশগুলো উন্নত হয়েছে উন্নত রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে। রাজনৈতিক চর্চায় অন্য দলের প্রতি, অন্য মতের প্রতি আপনাকে অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আর রাজনীতি হওয়া উচিত জনগণের জন্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতি পরিণত হয়েছে একধরনের ব্যবসায়। আপনি এখানে ইনভেস্ট করবেন, তার বিনিময়ে আপনি জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে কানাডা, আমেরিকায় বেগমপাড়া গড়ে তুলবেন। আমাদের এই অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে এসে বাংলাদেশকে ভালোবেসে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে দুর্নীতিমুক্ত দেশ করতে পারলেই আমরা ভবিষ্যতে উন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারব।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
ঢুলিভিটা থেকে ধামরাই উপজেলার একটি গ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যাব সীতি গ্রামের আলাদিন পার্কে। হঠাৎ নাকে একটা উৎকট গন্ধ এসে লাগল। যতই এগোচ্ছি গন্ধটা তত বেশি উগ্র হয়ে উঠছে। নাক দিয়ে ঢুকছে দুর্গন্ধযুক্ত বাতাস, পেটের ভেতরটা যেন ঘুলঘুল করে উঠছে। কারণটা কী? একটু এগিয়ে যেতেই ব্যাপারটা খোলাসা হয়ে গেল। রাস্তার
১৩ ঘণ্টা আগেযুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্কহার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণের সিদ্ধান্তে অনেকের মধ্যে যেমন স্বস্তি দেখা যাচ্ছে, তেমনি কারও কারও মধ্যে অস্বস্তি নেই, তা-ও নয়। দেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে একটি পক্ষ এটিকে অর্জন বলে বিবেচনা
১৩ ঘণ্টা আগেএকটি সফল গণ-অভ্যুত্থানের মাত্র এক বছরের মধ্যে প্রশ্নটি সর্বব্যাপী হয়ে উঠেছে। কারণ, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে বৈষম্যহীন অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক দেশ এবং ‘দায় ও দরদের সমাজ’ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছিল, গত এক বছরের চলার পথ তার ধারেকাছেও নেই। বরং এক বছর ধরে দেশবাসী দেখে...
২ দিন আগেঢাকায় প্রতিদিন আমরা যে শ্বাস গ্রহণ করি, তার প্রতিটি কণায় লুকিয়ে আছে অদৃশ্য বিষ, যা নিঃশব্দে আমাদের দেহকে দুর্বল করে দিচ্ছে, কেড়ে নিচ্ছে সুস্থতার অধিকার। একসময় যাকে বলা হতো প্রাণের শহর, আজ তা যেন বিষে ভরা এক মৃত্যুপুরী। ঢাকার বাতাস আর নিছক বাতাস নয়—এ যেন নিশ্বাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক অদৃশ্য...
২ দিন আগে