Ajker Patrika

তারুণ্যের দিশেহারা ভবিষ্যৎ

নতুন সরকার কি জ্বালাতে পারবে ভরসার আলো

আবুবকর হানিপ
নতুন সরকার কি জ্বালাতে পারবে ভরসার আলো

দিনকয়েক আগে ফেসবুকে একটি স্ক্রিনশটসহ পোস্টে চোখ আটকে যায়। সেখানে এক ফ্রান্সপ্রবাসী বাংলাদেশি লিখেছেন, তিনি ১২ ঘণ্টা উবার চালিয়ে আয় করেছেন ১৬৯ ইউরো—বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২১ হাজার টাকা। এই আয়ে তিনি সন্তুষ্ট এবং জানিয়েছেন—এ জন্যই তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে এসেছেন। কারণ, তাঁর বিশ্বাস, দেশে থাকলে এক মাসেও এই ২১ হাজার টাকা আয় করতে তাঁকে হিমশিম খেতে হতো।

তাঁর এই বক্তব্যে সন্দেহ নেই, বাস্তবতার প্রতিফলন আছে। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে বিদেশযাত্রা নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য সমাধান নয়। অথচ ওই যুবকের কাছে মনে হয়েছে, এভাবেই যেন তাঁর জীবনের সব হিসাব মিলে গেছে। বাস্তব কি সত্যিই তাই? নিশ্চয়ই না। বরং এমন ঝুঁকিপূর্ণ বিদেশযাত্রা নিরুৎসাহিত করাই শ্রেয়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের যুবসমাজ করবে কী? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও তারা কাজ পাচ্ছে না। আর পেলেও সেটি তাদের যোগ্যতার তুলনায় অনেক কম মানের, আয়ও সামান্য। তাই ফ্রান্সে ১২ ঘণ্টা খেটে ১৬৯ ইউরো কামানোই ওই যুবকের কাছে সবচেয়ে বড় অর্জন মনে হচ্ছে। অথচ সেটি আসলে ওই দেশের ন্যূনতম মজুরি মাত্র।

এরপরও সবাই বিদেশেই যেতে চায়। সম্প্রতি ব্রিটিশ কাউন্সিলের ‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ’-এর তৃতীয় সিরিজের গবেষণা প্রতিবেদনে নানা শ্রেণি-পেশার ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৩ হাজার ৮১ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকারভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও চাকরির প্রয়োজনে বিদেশে যেতে চায় বাংলাদেশের ৫৫ শতাংশ তরুণ। চিন্তা করা যায়, একটি দেশের ৫৫ শতাংশ তরুণ বিদেশে চলে যেতে চায়! ওই গবেষণাতেই দেখা গেছে, দেশে বেকারত্ব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ৪২ শতাংশ তরুণ। ফলাফল কী? কর্মহীন ও উচ্চশিক্ষিত, স্বল্প বা আধা শিক্ষিত এই বিপুল তরুণ জনশক্তি কোথাও কাজে লাগতে না পারায় তাদেরই ৩২ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সে অপরাধের তুলনায় সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশে গিয়ে কামাইয়ের চেষ্টা অবশ্য কমই উদ্বেগের।

এখানে আমি আরেকটি প্রশ্ন তুলতে চাই। আমাদের তারুণ্য যখন বিদেশে যায়, তারা কি শুধু উবার চালাবে, অথবা হোটেল-রেস্টুরেন্টে কাজ করে বাংলাদেশের তুলনায় কিছু বেশি আয়ের গর্বে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেবে? নিশ্চয়ই নয়! তাহলে তারা করবে কী? পড়াশোনা শেষে বাংলাদেশের তরুণদের গন্তব্য কোথায় হবে? তাদের ভবিষ্যৎইবা কীভাবে নির্ধারিত হবে? এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়, আর সেখান থেকেই চোখে পড়ল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালে পরিচালিত এক জরিপ প্রতিবেদন। এতে দেখানো হচ্ছে, বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই স্রেফ নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ তারা পড়াশোনা, কর্মসংস্থান কিংবা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণেও নেই। ছেলেদের চেয়ে এই নিষ্ক্রিয়তার হার আবার দেড় গুণের বেশি মেয়েদের মধ্যে। সে হার ৬০ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

তারুণ্য নিয়ে আমাদের গর্ব আছে। সব আন্দোলন-সংগ্রামে তারুণ্যই সবচেয়ে বেশি শক্তি জুগিয়েছে। আর ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের গর্ব তো আমরা সারাক্ষণই করি। শিক্ষায় মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া নিয়েও গর্ব কম নয়। কিন্তু দেশের তরুণ শ্রেণি যে বেকারত্বের ভারে ন্যুব্জ এবং ক্রমাগত অন্যায়-অপরাধে ঝুঁকে পড়ছে, তার প্রমাণ হিসেবে ওপরের পরিসংখ্যানগুলোই কি যথেষ্ট নয়? এসব দেখে আর গর্বের লেশমাত্র থাকে না!

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এই ছেলেমেয়েরা চাকরি পাচ্ছে না? কেন তারা থেকে যাচ্ছে বেকার বা আংশিক বেকার? কেন নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও তারা কর্মহীন হয়ে বসে আছে? সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চোখ ফেলতে হবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকেই। একে ত্রুটি বলতে চাই না, তবে এটুকু বলতে চাই—আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এমন কিছু ঘাটতি আছে, যা এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত বেকার তৈরির জন্য দায়ী। সেই ঘাটতি কী? আমার ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি—কর্মমুখী শিক্ষার অভাবই এ বেকারত্বের মূল কারণ।

অনেকেই বলতে পারেন কর্মমুখী শিক্ষা তো হচ্ছেই। আমাদের কারিগরি শিক্ষা আছে, ভোকেশনাল ট্রেনিং রয়েছে। কিন্তু আমি বলব, সেটা মোটেও যথেষ্ট নয়। ওপরের পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ। আমাদের এখন উচিত সাধারণ শিক্ষাক্রমেই পরিবর্তন আনা। অর্থাৎ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েই এই দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। যাতে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়েই, কিংবা পেরোনোর আগেই কোনো একটি কাজে যোগ দিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম থেকেই তারা শিখবে কর্মক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো।

বর্তমান সরকারের কাছে এই প্রত্যাশাই ব্যক্ত করছি। বলছি, বিষয়টি নিয়ে আর বসে থাকার সময় নেই। দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম এখন সময়ের প্রয়োজন। আপনার শিক্ষার্থী যদি স্রেফ একটি ডিপ্লোমা কিংবা সনদ হাতে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসে, তারা সেই সনদ দেখিয়ে চাকরি পাবে না। এ যুগে কেউ পায় না। যেকোনো নিয়োগদাতা প্রথমেই জানতে চায়—এই চাকরি প্রার্থীটি কী পারে? কোন কাজটিতে তার দক্ষতা রয়েছে? কাজে যোগ দিয়েই সে কি সক্ষম প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো অবদান রাখতে? লেখাপড়ার ফাঁকে এই দক্ষতা অর্জন হয়তো সম্ভব। কিন্তু তার প্রয়োজন কেন—বিশ্ববিদ্যালয়ই তো পারে ক্লাসরুম থেকে এই দক্ষতাটুকু শিখিয়ে দিতে। সে জন্যই পরিবর্তন আনতে হবে শিক্ষাক্রমে। পরিবর্তন আনতে হবে শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে।

যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে আমরা এই পদ্ধতির প্রয়োগে সফলতা পাচ্ছি। এখানে শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুম থেকে বিষয়ভিত্তিক গভীর আলোচনা যেমন করতে পারছে, তেমনি ল্যাবভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় বিষয়-সংশ্লিষ্ট দক্ষতাও পাচ্ছে হাতে-কলমে। আমাদের শিক্ষকেরা একাধারে স্কলার এবং ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্ট। বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রিতে সক্রিয় রয়েছেন, এমন স্কলাররাই আসছেন ক্লাসরুমে। ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁদের গড় অভিজ্ঞতা ১৮ বছর। ফলে তাঁরা তাঁদের স্কলারি জ্ঞান ও যোগ্যতার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নিত্যদিনের দক্ষতাও শেয়ার করতে পারছেন ক্লাসরুমে। শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে ইন্ডাস্ট্রির সবশেষ উৎকর্ষের তথ্য ও দক্ষতা। ক্লাসরুমটিই হয়ে উঠছে কর্মক্ষেত্রের রেপ্লিকা। এতে শিক্ষার্থীরা তৈরি হচ্ছে কর্মক্ষেত্রের উপযোগী হয়ে। এটি একটি ব্লেন্ডেড মডেল। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তৈরি হচ্ছে তাদের উন্নত ক্যারিয়ারের জন্যও। ডিগ্রি-স্কিল-ক্যারিয়ার—বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ট্রিপল মিশন মাথায় রেখেই এমন শিক্ষাপদ্ধতির নকশা তৈরি করা হয়েছে। এর সারকথা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে শিক্ষার্থীরা আর এন্ট্রি লেভেল জব খুঁজবে না। বরং তারা কাজ শুরুই করবে মিড কিংবা সিনিয়র পর্যায় থেকে। এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত ডিগ্রি ও স্কিল ব্যবহার করেই তারা এগিয়ে যাবে উন্নত ক্যারিয়ারের পথে।

বস্তুত এন্ট্রি লেভেলের কাজগুলো এখন আর নেই বললেই চলে। জেনেরেটিভ এআইয়ের দখলে চলে গেছে সেসব কাজ। স্রেফ এআই এজেন্ট ব্যবহার করে কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছে কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে প্রাথমিক ধাপের সাধারণ কাজ আর ব্যক্তি-মানুষের জন্য থাকছে না। তাহলে মিড বা সিনিয়র পর্যায়ের কাজগুলোই ভরসা। আর সে কারণেই এই বিশেষ মডেল কার্যকর হয়ে উঠছে।

এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে যে কাজটি করতে হয়েছে তা হচ্ছে, শিক্ষাক্রমে কিছু পরিবর্তন আনা। সময়ের সবচেয়ে উপযোগী ও আগামী দিনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া। অর্থাৎ দক্ষতা তৈরির বিষয় ও টুলসগুলোকে, কিংবা ল্যাবভিত্তিক কার্যক্রমগুলোই পাঠ্যসূচির অংশ করে নেওয়া। এতে বিভিন্ন বিষয় ও টুলসভিত্তিক ল্যাব গ্রেডেড অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে শিক্ষার্থীরা চর্চা করছে এবং শিখছে সরাসরি হাতে-কলমে। পদ্ধতিটি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় একটি মডেল হিসেবেই আজ স্বীকৃত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ডব্লিউইউএসটির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই মডেল ব্যবহার করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৫৭টি পাবলিক, ১১৬টি প্রাইভেট ও ৩টি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি রয়েছে। এরা সবাই চাইলে এই মডেল ব্যবহার করতে পারে।

(আগামীকাল শেষ পর্ব)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হাসিনার পতনের আগের দিন ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা হয়: নাহিদ

শেষ ওভারে নবির ছক্কাবৃষ্টি, বাংলাদেশের সমীকরণ কী দাঁড়াল

কুমিল্লায় ৪ মাজারে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, পুলিশ-সেনাবাহিনী মোতায়েন

দিয়াবাড়ির কাশবনে নারীর অর্ধগলিত লাশ, মৃত্যু ১০-১২ দিন আগে: পুলিশ

সেনা আশ্রয় ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে নেপালের সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত