শোয়েব সাম্য সিদ্দিক
দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় আচার নয়, এটি আনন্দ, মিলন আর প্রাণের উৎসবও বটে। উৎসব মানেই নতুন প্রাণের সঞ্চার—শিশুর চোখে নতুন জামার স্বপ্ন, মায়ের মুখে সিঁদুরের লাল আভা, আর পরিবারের সবাই মিলে জমে ওঠে কেনাকাটার উৎসব। তখন ঘরে ঘরে বাজে আনন্দের ঢোল, চারপাশ ভরে ওঠে উৎসবের আমেজে।
উৎসবের আবহে অর্থনীতি
বাজারে গিয়ে দেখা যায়, উৎসব যেন কেবল দেবী প্রতিমার সামনে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি অলিগলির দোকান, শপিং মল, এমনকি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত। গ্রামের হাট থেকে শুরু করে শহরের অভিজাত বিপণিবিতান—সবখানেই বেচাকেনার ঢল নামে। ঢাকার শাঁখারীবাজারে প্রতিমার মুকুট, শাঁখা, সিঁদুর কিংবা ফুলের মালা কিনতে মানুষের ভিড় দেখে মনে হয়, এ যেন শুধু ধর্মীয় আচার নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যেরও এক প্রাণবন্ত উৎসব। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এই সময়ে যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পান। কুমারপাড়ার কারিগরেরা প্রতিমা গড়ায় ব্যস্ত, সোনা-রুপার শিল্পীরা বানাচ্ছেন নতুন অলংকার, আর পোশাক ব্যবসায়ীরা খুঁজে নিচ্ছেন বাড়তি আয়ের আনন্দ। একই সঙ্গে খাবারের দোকান, পরিবহন খাত, এমনকি অস্থায়ী স্টলগুলোরও রমরমা ব্যবসা হয়। ফলে দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে এক সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের দুর্গাপূজা আজ আর কেবল ভক্তির আয়োজন নয়, বরং একটি জাতীয় অর্থনৈতিক উৎসবে রূপ নিয়েছে। এই উৎসবের আবেগে যেমন মানুষ মিলিত হয়, তেমনি অর্থনীতিও প্রাণ ফিরে পায়। ভক্তি আর অর্থনীতির মিলনে দুর্গাপূজা পেয়েছে নতুন রূপ।
২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে দুর্গাপূজা
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর দেশে মোট ৩৩ হাজার ৩৫৫টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা উদ্যাপিত হচ্ছে। শুধু রাজধানী ঢাকায়ই এবার পূজা হচ্ছে ২ হাজার ৫৮০টি মণ্ডপে। এটি যেমন শহরের বিপুল জনঘনত্বের প্রতিচ্ছবি, তেমনি ঢাকার অর্থনৈতিক গুরুত্বেরও এক সুস্পষ্ট প্রমাণ। প্রতিটি মণ্ডপ ঘিরে শুরু হয় কয়েক মাসব্যাপী প্রস্তুতি—প্রতিমা গড়া থেকে শুরু করে অলংকরণ, মণ্ডপের নকশা, আলোকসজ্জা, বাদ্যযন্ত্রের আয়োজন, প্রসাদ প্রস্তুতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, এমনকি ডিজিটাল প্রচারণা পর্যন্ত। এই প্রতিটি ধাপে যুক্ত থাকেন অসংখ্য মানুষ—কারিগর, শ্রমিক, উদ্যোক্তা ও স্বেচ্ছাসেবক। কারও হাতে রংতুলি, কারও হাতে বাঁশ ও কাপড়, কেউ আবার ব্যস্ত আলোকসজ্জা নিয়ে। ফলে দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়ে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং প্রতিটি মণ্ডপ পরিণত হয় এক একটি ক্ষুদ্র বাজারের প্রাণকেন্দ্রে।
ফুলচাষি তাঁর ফুল বিক্রি করছেন, কাপড়ের দোকানি নতুন শাড়ি বা পাঞ্জাবি তুলে ধরছেন, মিষ্টির কারিগরেরা ব্যস্ত নতুন অর্ডার সামলাতে, আবার আলোকসজ্জার কারিগরেরা আলো দিয়ে সাজাচ্ছেন পুরো এলাকা। এমনকি ডিজিটাল ব্যানার, অনলাইন প্রচারণা এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট খাতেও জোয়ার দেখা যায়। সবার জীবনেই খুলে যায় বাড়তি আয়ের পথ। তাই দুর্গাপূজা শুধু ভক্তির প্রতীক নয়, বরং এটি এখন স্থানীয় অর্থনীতির স্পন্দন। প্রতিটি মণ্ডপই হয়ে ওঠে কর্মসংস্থানের উৎস, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ভরসার জায়গা এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি।
দুর্গাপূজার অর্থনৈতিক বিস্তার
পরিসংখ্যান বলছে, এ বছর দুর্গাপূজা ঘিরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল অঙ্কের অর্থ প্রবাহিত হয় শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত, প্রতিটি মণ্ডপ থেকে প্রতিটি বাজারে। প্রতিমা তৈরির জন্য মাটির কারিগর, ঢাকি, আলোকসজ্জাকারী, ফুলচাষি, কাপড়ের ব্যবসায়ী, গয়নার দোকানদার, কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান—সবাই এই উৎসব থেকে বাড়তি আয়ের সুযোগ পান। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার কাছে দুর্গাপূজার মৌসুমই হয়ে ওঠে বছরের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক সময়। যেমন কুমারপাড়ার কারিগরেরা পুরো বছরের আয় প্রায় এই কয়েক মাসেই তুলে নিতে পারেন। অভিজ্ঞতা দেখায়, একটি হিন্দু পরিবার গড়ে অন্তত ৩০ হাজার টাকা বাড়তি ব্যয় করে পূজার সময়। প্রায় ৩৫ লাখ পরিবার মিলে এই অতিরিক্ত খরচ দাঁড়ায় কয়েক হাজার কোটি টাকায়, যা দেশের খুচরা বাজারে বড় ধরনের চাঙাভাব সৃষ্টি করে। নতুন শাড়ি, অলংকার, প্রসাধনী, শাঁখা-সিঁদুর, মিষ্টি, প্রসাদ ও নানা ধরনের খাবারের চাহিদা যে কতটা বেড়ে যায়, তা পূজার আগে বাজারে গেলে সহজেই চোখে পড়ে।
এই অতিরিক্ত ভোগ শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যকে গতিশীল করে না, বরং কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্রও তৈরি করে। অনেক অস্থায়ী দোকান খোলে, পরিবহন খাতে চাপ বাড়ে, এমনকি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোতেও অর্ডারের বন্যা নামে। অর্থাৎ দুর্গাপূজা ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সজীব ও বহুমাত্রিক করে তোলে।
সীমাবদ্ধতা ও সুযোগ: পূজার অর্থনীতি
যদিও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতির ছায়া বাজারে বিরাজ করছে, তবু উৎসব মানুষকে কিছুটা বাড়তি ব্যয় করতে অনুপ্রাণিত করে। ধর্মীয় আবেগ ও সামাজিক আনন্দ মানুষকে সঞ্চয়ের হিসাব ভেঙে খরচের দিকে টানে। তবে এর মাঝেই তৈরি হয় এক ভিন্ন বাস্তবতা।
বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় অনেক মানুষ পূজার বাজার করতে ভারত অভিমুখে যায়। সেখানে তুলনামূলক কম দামে শাড়ি, গয়না কিংবা সাজসজ্জার সামগ্রী পাওয়া যায় বলে ক্রেতারা দেশীয় বাজার এড়িয়ে যান। এতে দেশীয় উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতার মুখে পড়েন। উৎসবের আনন্দ থাকলেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মনে তাই থেকে যায় অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা। তবে সত্য হলো, সঠিক পরিকল্পনা থাকলে পূজার এই অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। দেশীয় কারিগরদের তৈরি শাঁখা, অলংকার, কাপড় কিংবা হস্তশিল্প যদি আমরা ব্র্যান্ড আকারে গড়ে তুলতে পারি, তবে বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারি নীতিগত সহায়তা, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ এবং ন্যায্যমূল্যে কাঁচামাল সরবরাহ বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
অন্যদিকে, অনলাইন ব্যবসায় আস্থা তৈরি এবং কুরিয়ার সেবার মান উন্নত করা গেলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য পূজার বাজার এক আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে। ই-কমার্সের শক্তিকে কাজে লাগানো গেলে গ্রামের কারিগরের তৈরি শাঁখা বা শহরের ছোট দোকানের অলংকার সহজেই পৌঁছে যেতে পারে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
সবশেষে বলা যায়, দুর্গাপূজা শুধু আনন্দ ও ভক্তির উৎসব নয়, সঠিক পরিকল্পনা ও কৌশল থাকলে এটি হতে পারে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক টেকসই উন্নয়নের এক বড় ভরসা।
পর্যটন সম্ভাবনা ও সম্প্রীতির বার্তা
অন্যদিকে, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ধর্মীয় পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবছর পশ্চিমবঙ্গ, আসাম বা ত্রিপুরার বহু মানুষ বাংলাদেশের পূজা দেখতে আগ্রহী হয়। যদি আমরা পর্যটকদের জন্য নিরাপদ, আকর্ষণীয় ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারি, তবে শুধু পূজাকেন্দ্রিক পর্যটন থেকেই কয়েক শ কোটি টাকার বৈদেশিক আয় সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতে বৌদ্ধ পর্যটন তাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। একইভাবে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশও পর্যটন খাতের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
অর্থনৈতিক প্রভাবের পাশাপাশি দুর্গাপূজার রয়েছে এক বিশেষ সামাজিক গুরুত্ব। পূজার বাজারে ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ থাকে না—মুসলিম ব্যবসায়ীরা কাপড় বিক্রি করেন, খ্রিষ্টান ডিজাইনাররা মণ্ডপ সাজান, আর বৌদ্ধ শিল্পীরা আলো দিয়ে সাজিয়ে তোলেন উৎসবের পরিবেশ। এই মিলনমেলা কেবল ভক্তির সীমারেখা অতিক্রম করে দুর্গাপূজাকে রূপ দেয় সর্বজনীন উৎসবে। এখানে অর্থনীতি কেবল টাকার হিসাবেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি গড়ে তোলে নতুন মানবিক সম্পর্ক আর সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধন।
তাই বলা যায়, দুর্গাপূজা আমাদের শেখায়—উৎসব মানে শুধু আনন্দ নয়। এটি অর্থনীতির চাকা সচল রাখা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আশা জাগানো। পূজার অর্থনীতি সমাজে সমতার বার্তা ছড়িয়ে দেয়। কারণ, এই উৎসবে সবাই কোনো না কোনোভাবে অংশগ্রহণ করে।
সমাপনী ভাবনা
মোদ্দা কথা এই যে দুর্গাপূজার অর্থনীতি আমাদের দেশের আর্থসামাজিক জীবনে এক অপূর্ব আলোকচ্ছটা ছড়ায়। দেবী দুর্গার আগমনের মতোই এই অর্থনীতি প্রতিবছর নতুন সম্ভাবনা বয়ে আনে। তৈরি হয় নতুন উদ্যম, বাড়ে কর্মসংস্থান। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার স্বপ্ন, ব্যবসায়ীর ব্যস্ততা আর সাধারণ মানুষের কেনাকাটার আনন্দ—সব মিলেই গড়ে ওঠে এক প্রাণবন্ত অর্থনৈতিক পরিবেশ। তবে এর মাঝেই সচেতন থাকার মতো কিছু বাস্তবতা আছে। মণ্ডপে নাশকতার আশঙ্কা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো, মবোক্রেসির সংস্কৃতি কিংবা সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো বিষয়গুলো উৎসবের আনন্দকে ব্যাহত করতে পারে। তাই রাষ্ট্র, সমাজ ও নাগরিক সবার দায়িত্ব এসব নেতিবাচক প্রবণতার বিরুদ্ধে একসঙ্গে দাঁড়ানো এবং সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ করা।
সবশেষে বলা যায়, দুর্গাপূজার এই রঙিন অর্থনীতি কেবল কয়েক দিনের উৎসব নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনার দ্বার। যদি পরিকল্পিতভাবে দেশীয় কারিগর, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আর পর্যটন খাতকে এগিয়ে নেওয়া যায়, তবে ভবিষ্যতে দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং বাংলাদেশের আর্থিক প্রবাহর এক শক্তিশালী ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে। ভক্তির আচার থেকে সামাজিক সম্প্রীতি, আর্থিক প্রবাহ থেকে টেকসই উন্নয়ন—সব দিক মিলিয়ে দুর্গাপূজা হয়ে উঠতে পারে আমাদের দেশের এক অনন্য উন্নয়নমুখী উৎসবের মডেল।
লেখক: ব্যাংকার এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় আচার নয়, এটি আনন্দ, মিলন আর প্রাণের উৎসবও বটে। উৎসব মানেই নতুন প্রাণের সঞ্চার—শিশুর চোখে নতুন জামার স্বপ্ন, মায়ের মুখে সিঁদুরের লাল আভা, আর পরিবারের সবাই মিলে জমে ওঠে কেনাকাটার উৎসব। তখন ঘরে ঘরে বাজে আনন্দের ঢোল, চারপাশ ভরে ওঠে উৎসবের আমেজে।
উৎসবের আবহে অর্থনীতি
বাজারে গিয়ে দেখা যায়, উৎসব যেন কেবল দেবী প্রতিমার সামনে সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি অলিগলির দোকান, শপিং মল, এমনকি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত। গ্রামের হাট থেকে শুরু করে শহরের অভিজাত বিপণিবিতান—সবখানেই বেচাকেনার ঢল নামে। ঢাকার শাঁখারীবাজারে প্রতিমার মুকুট, শাঁখা, সিঁদুর কিংবা ফুলের মালা কিনতে মানুষের ভিড় দেখে মনে হয়, এ যেন শুধু ধর্মীয় আচার নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যেরও এক প্রাণবন্ত উৎসব। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এই সময়ে যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পান। কুমারপাড়ার কারিগরেরা প্রতিমা গড়ায় ব্যস্ত, সোনা-রুপার শিল্পীরা বানাচ্ছেন নতুন অলংকার, আর পোশাক ব্যবসায়ীরা খুঁজে নিচ্ছেন বাড়তি আয়ের আনন্দ। একই সঙ্গে খাবারের দোকান, পরিবহন খাত, এমনকি অস্থায়ী স্টলগুলোরও রমরমা ব্যবসা হয়। ফলে দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে এক সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের দুর্গাপূজা আজ আর কেবল ভক্তির আয়োজন নয়, বরং একটি জাতীয় অর্থনৈতিক উৎসবে রূপ নিয়েছে। এই উৎসবের আবেগে যেমন মানুষ মিলিত হয়, তেমনি অর্থনীতিও প্রাণ ফিরে পায়। ভক্তি আর অর্থনীতির মিলনে দুর্গাপূজা পেয়েছে নতুন রূপ।
২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে দুর্গাপূজা
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর দেশে মোট ৩৩ হাজার ৩৫৫টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা উদ্যাপিত হচ্ছে। শুধু রাজধানী ঢাকায়ই এবার পূজা হচ্ছে ২ হাজার ৫৮০টি মণ্ডপে। এটি যেমন শহরের বিপুল জনঘনত্বের প্রতিচ্ছবি, তেমনি ঢাকার অর্থনৈতিক গুরুত্বেরও এক সুস্পষ্ট প্রমাণ। প্রতিটি মণ্ডপ ঘিরে শুরু হয় কয়েক মাসব্যাপী প্রস্তুতি—প্রতিমা গড়া থেকে শুরু করে অলংকরণ, মণ্ডপের নকশা, আলোকসজ্জা, বাদ্যযন্ত্রের আয়োজন, প্রসাদ প্রস্তুতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, এমনকি ডিজিটাল প্রচারণা পর্যন্ত। এই প্রতিটি ধাপে যুক্ত থাকেন অসংখ্য মানুষ—কারিগর, শ্রমিক, উদ্যোক্তা ও স্বেচ্ছাসেবক। কারও হাতে রংতুলি, কারও হাতে বাঁশ ও কাপড়, কেউ আবার ব্যস্ত আলোকসজ্জা নিয়ে। ফলে দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়ে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং প্রতিটি মণ্ডপ পরিণত হয় এক একটি ক্ষুদ্র বাজারের প্রাণকেন্দ্রে।
ফুলচাষি তাঁর ফুল বিক্রি করছেন, কাপড়ের দোকানি নতুন শাড়ি বা পাঞ্জাবি তুলে ধরছেন, মিষ্টির কারিগরেরা ব্যস্ত নতুন অর্ডার সামলাতে, আবার আলোকসজ্জার কারিগরেরা আলো দিয়ে সাজাচ্ছেন পুরো এলাকা। এমনকি ডিজিটাল ব্যানার, অনলাইন প্রচারণা এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট খাতেও জোয়ার দেখা যায়। সবার জীবনেই খুলে যায় বাড়তি আয়ের পথ। তাই দুর্গাপূজা শুধু ভক্তির প্রতীক নয়, বরং এটি এখন স্থানীয় অর্থনীতির স্পন্দন। প্রতিটি মণ্ডপই হয়ে ওঠে কর্মসংস্থানের উৎস, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ভরসার জায়গা এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি।
দুর্গাপূজার অর্থনৈতিক বিস্তার
পরিসংখ্যান বলছে, এ বছর দুর্গাপূজা ঘিরে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল অঙ্কের অর্থ প্রবাহিত হয় শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত, প্রতিটি মণ্ডপ থেকে প্রতিটি বাজারে। প্রতিমা তৈরির জন্য মাটির কারিগর, ঢাকি, আলোকসজ্জাকারী, ফুলচাষি, কাপড়ের ব্যবসায়ী, গয়নার দোকানদার, কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান—সবাই এই উৎসব থেকে বাড়তি আয়ের সুযোগ পান। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার কাছে দুর্গাপূজার মৌসুমই হয়ে ওঠে বছরের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক সময়। যেমন কুমারপাড়ার কারিগরেরা পুরো বছরের আয় প্রায় এই কয়েক মাসেই তুলে নিতে পারেন। অভিজ্ঞতা দেখায়, একটি হিন্দু পরিবার গড়ে অন্তত ৩০ হাজার টাকা বাড়তি ব্যয় করে পূজার সময়। প্রায় ৩৫ লাখ পরিবার মিলে এই অতিরিক্ত খরচ দাঁড়ায় কয়েক হাজার কোটি টাকায়, যা দেশের খুচরা বাজারে বড় ধরনের চাঙাভাব সৃষ্টি করে। নতুন শাড়ি, অলংকার, প্রসাধনী, শাঁখা-সিঁদুর, মিষ্টি, প্রসাদ ও নানা ধরনের খাবারের চাহিদা যে কতটা বেড়ে যায়, তা পূজার আগে বাজারে গেলে সহজেই চোখে পড়ে।
এই অতিরিক্ত ভোগ শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যকে গতিশীল করে না, বরং কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্রও তৈরি করে। অনেক অস্থায়ী দোকান খোলে, পরিবহন খাতে চাপ বাড়ে, এমনকি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোতেও অর্ডারের বন্যা নামে। অর্থাৎ দুর্গাপূজা ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সজীব ও বহুমাত্রিক করে তোলে।
সীমাবদ্ধতা ও সুযোগ: পূজার অর্থনীতি
যদিও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও মুদ্রাস্ফীতির ছায়া বাজারে বিরাজ করছে, তবু উৎসব মানুষকে কিছুটা বাড়তি ব্যয় করতে অনুপ্রাণিত করে। ধর্মীয় আবেগ ও সামাজিক আনন্দ মানুষকে সঞ্চয়ের হিসাব ভেঙে খরচের দিকে টানে। তবে এর মাঝেই তৈরি হয় এক ভিন্ন বাস্তবতা।
বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় অনেক মানুষ পূজার বাজার করতে ভারত অভিমুখে যায়। সেখানে তুলনামূলক কম দামে শাড়ি, গয়না কিংবা সাজসজ্জার সামগ্রী পাওয়া যায় বলে ক্রেতারা দেশীয় বাজার এড়িয়ে যান। এতে দেশীয় উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতার মুখে পড়েন। উৎসবের আনন্দ থাকলেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মনে তাই থেকে যায় অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা। তবে সত্য হলো, সঠিক পরিকল্পনা থাকলে পূজার এই অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। দেশীয় কারিগরদের তৈরি শাঁখা, অলংকার, কাপড় কিংবা হস্তশিল্প যদি আমরা ব্র্যান্ড আকারে গড়ে তুলতে পারি, তবে বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারি নীতিগত সহায়তা, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ এবং ন্যায্যমূল্যে কাঁচামাল সরবরাহ বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
অন্যদিকে, অনলাইন ব্যবসায় আস্থা তৈরি এবং কুরিয়ার সেবার মান উন্নত করা গেলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য পূজার বাজার এক আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে। ই-কমার্সের শক্তিকে কাজে লাগানো গেলে গ্রামের কারিগরের তৈরি শাঁখা বা শহরের ছোট দোকানের অলংকার সহজেই পৌঁছে যেতে পারে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
সবশেষে বলা যায়, দুর্গাপূজা শুধু আনন্দ ও ভক্তির উৎসব নয়, সঠিক পরিকল্পনা ও কৌশল থাকলে এটি হতে পারে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক টেকসই উন্নয়নের এক বড় ভরসা।
পর্যটন সম্ভাবনা ও সম্প্রীতির বার্তা
অন্যদিকে, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ধর্মীয় পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবছর পশ্চিমবঙ্গ, আসাম বা ত্রিপুরার বহু মানুষ বাংলাদেশের পূজা দেখতে আগ্রহী হয়। যদি আমরা পর্যটকদের জন্য নিরাপদ, আকর্ষণীয় ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারি, তবে শুধু পূজাকেন্দ্রিক পর্যটন থেকেই কয়েক শ কোটি টাকার বৈদেশিক আয় সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতে বৌদ্ধ পর্যটন তাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। একইভাবে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশও পর্যটন খাতের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
অর্থনৈতিক প্রভাবের পাশাপাশি দুর্গাপূজার রয়েছে এক বিশেষ সামাজিক গুরুত্ব। পূজার বাজারে ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ থাকে না—মুসলিম ব্যবসায়ীরা কাপড় বিক্রি করেন, খ্রিষ্টান ডিজাইনাররা মণ্ডপ সাজান, আর বৌদ্ধ শিল্পীরা আলো দিয়ে সাজিয়ে তোলেন উৎসবের পরিবেশ। এই মিলনমেলা কেবল ভক্তির সীমারেখা অতিক্রম করে দুর্গাপূজাকে রূপ দেয় সর্বজনীন উৎসবে। এখানে অর্থনীতি কেবল টাকার হিসাবেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি গড়ে তোলে নতুন মানবিক সম্পর্ক আর সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধন।
তাই বলা যায়, দুর্গাপূজা আমাদের শেখায়—উৎসব মানে শুধু আনন্দ নয়। এটি অর্থনীতির চাকা সচল রাখা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আশা জাগানো। পূজার অর্থনীতি সমাজে সমতার বার্তা ছড়িয়ে দেয়। কারণ, এই উৎসবে সবাই কোনো না কোনোভাবে অংশগ্রহণ করে।
সমাপনী ভাবনা
মোদ্দা কথা এই যে দুর্গাপূজার অর্থনীতি আমাদের দেশের আর্থসামাজিক জীবনে এক অপূর্ব আলোকচ্ছটা ছড়ায়। দেবী দুর্গার আগমনের মতোই এই অর্থনীতি প্রতিবছর নতুন সম্ভাবনা বয়ে আনে। তৈরি হয় নতুন উদ্যম, বাড়ে কর্মসংস্থান। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার স্বপ্ন, ব্যবসায়ীর ব্যস্ততা আর সাধারণ মানুষের কেনাকাটার আনন্দ—সব মিলেই গড়ে ওঠে এক প্রাণবন্ত অর্থনৈতিক পরিবেশ। তবে এর মাঝেই সচেতন থাকার মতো কিছু বাস্তবতা আছে। মণ্ডপে নাশকতার আশঙ্কা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো, মবোক্রেসির সংস্কৃতি কিংবা সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো বিষয়গুলো উৎসবের আনন্দকে ব্যাহত করতে পারে। তাই রাষ্ট্র, সমাজ ও নাগরিক সবার দায়িত্ব এসব নেতিবাচক প্রবণতার বিরুদ্ধে একসঙ্গে দাঁড়ানো এবং সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ করা।
সবশেষে বলা যায়, দুর্গাপূজার এই রঙিন অর্থনীতি কেবল কয়েক দিনের উৎসব নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনার দ্বার। যদি পরিকল্পিতভাবে দেশীয় কারিগর, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আর পর্যটন খাতকে এগিয়ে নেওয়া যায়, তবে ভবিষ্যতে দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং বাংলাদেশের আর্থিক প্রবাহর এক শক্তিশালী ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে। ভক্তির আচার থেকে সামাজিক সম্প্রীতি, আর্থিক প্রবাহ থেকে টেকসই উন্নয়ন—সব দিক মিলিয়ে দুর্গাপূজা হয়ে উঠতে পারে আমাদের দেশের এক অনন্য উন্নয়নমুখী উৎসবের মডেল।
লেখক: ব্যাংকার এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
‘আপনি আবুল হলে, আপনার আবুলত্ব দূর করার দায়িত্ব অথরিটির না’—এ রকম একটা মন্তব্য নাকি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি করেছেন তাঁর ফেসবুকে। বিষয়টা পড়লাম বিডিনিউজ ২৪ ডটকমে। নিশ্চিত হতে তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুকে ঢুঁ মারলাম। দু-এক মিনিট ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। কিন্তু পেলাম না।
৪ ঘণ্টা আগেবিশ্ব পর্যটন দিবসেই আজকের পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে এক মন খারাপ করা খবর। দখল হয়ে যাচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের বালিয়াড়ি। দখল করে অবৈধ স্থাপনা বসানো হচ্ছে।
৫ ঘণ্টা আগেমাত্র ২০০ বছর আগেও পৃথিবীটা ভালো ছিল, ছিল স্বাস্থ্যকর, পরিবেশ ছিল সবুজ-শ্যামলিমায় শান্ত-স্নিগ্ধ আরামদায়ক। বনে বনে ছিল বন্য প্রাণীদের আনন্দময় বিচরণ, গাছে গাছে ছিল পাখিদের কূজন, নদীতে-সাগরে সাঁতরে বেড়াত ডানকানা মাছ-ডলফিন ও দৈত্যাকার তিমিরা। মানুষও ছিল হাসিখুশি, বায়ুমণ্ডল থেকে মানুষও বুকভরে নিতে পারত
১ দিন আগে‘আচ্ছা, আমরা গেলাম, তোমরা ভালো থেকো’—ডোনাল্ড ট্রাম্পের গত সপ্তাহের ইউক্রেন-সম্পর্কিত বক্তব্যকে এভাবেই সংক্ষেপে বলা যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হঠাৎ ঘোষণা করলেন, ইউক্রেন রাশিয়ার কাছ থেকে তার সব হারানো ভূখণ্ড ফিরে পেতে পারে, তবে সেটা কেবল ইউরোপের সমর্থনে।
১ দিন আগে