Ajker Patrika

বাজেট ২০২৫-২৬

জমি-ফ্ল্যাটের নিবন্ধনে আসছে বড় সংস্কার

  • জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনে মৌজা মূল্য বাতিল হচ্ছে। বাধ্যতামূলক হচ্ছে বাজারমূল্য।
  • কর ও ফি কমছে প্রায় ৪০%। বন্ধ হচ্ছে গেইন ট্যাক্স ফাঁকির পথ।
বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা ­­
জমি-ফ্ল্যাটের নিবন্ধনে আসছে বড় সংস্কার

জমি ও ফ্ল্যাট কেনাবেচায় কালোটাকা ব্যবহার বন্ধের পথে এগোচ্ছে সরকার। আসছে অর্থবছরের বাজেট থেকেই জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনে (নিবন্ধন) কর ও ফি প্রায় ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনা হচ্ছে। তবে আগের মতো ‘মৌজা মূল্য’ ধরে নয়, বরং বাস্তব বাজারদরের ভিত্তিতে হবে রেজিস্ট্রেশন। তার মানে দলিলে প্রকৃত মূল্য দেখাতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে। সরকারের বিশ্বাস, এই নীতিগত বদল একদিকে যেমন কালোটাকার শক্তি ও রাজস্ব ফাঁকির প্রবণতা কমাবে, তেমনি রাজস্ব আদায়ে ফিরবে স্বচ্ছতা ও গতি।

বর্তমানে জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনে মোট কর ও ফি অঞ্চলভেদে ১৪-১৫ শতাংশ পর্যন্ত। আগামী অর্থবছর তা কমিয়ে ৮-৯ শতাংশে আনার প্রস্তাব নিয়ে সম্প্রতি বৈঠকে বসেন এনবিআর, অর্থ মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

সরকারের লক্ষ্য, দলিলে কম দাম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার দীর্ঘদিনের সুযোগ বন্ধ করা। কারণ, ‘মৌজা মূল্য’ অনেক ক্ষেত্রেই বাজারমূল্যের চেয়ে ৫ থেকে ১০ গুণ পর্যন্ত কম। ফলে জমি বা ফ্ল্যাট বিক্রির আসল মূল্য গোপন থেকে যায়, দলিল হয় কম দামে। অবশিষ্ট অর্থ চলে যায় অফিশিয়াল চ্যানেলের বাইরে। এতে তৈরি হয় কালোটাকার অবাধ প্রবাহ, রাজস্ব হারায় সরকার।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ১২ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ এসেছে গেইন ট্যাক্স বাবদ—৬ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসাব অনুযায়ী, দলিলে কম দাম দেখানোর কারণে বছরে গড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব হারায় সরকার।

সম্প্রতি এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, ‘গুলশানে এক কাঠা জমির মৌজা মূল্য ১৫ লাখ টাকা, অথচ বাজারমূল্য ৫ কোটি। এই ব্যবধানেই তৈরি হয় কালোটাকা। আমরা এখন সেটাই বদলাতে চাই। করহার কমালেও দলিল হবে বাস্তব দামে।’ তিনি জানান, এবারের বাজেটে কোনোভাবেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হবে না।

আরেক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তাঁর মতে, দলিলমূল্য যদি বাজারমূল্যের কাছাকাছি না হয়, তাহলে লেনদেনের বড় অংশেই কালোটাকা ঢুকে পড়ে। বাজারদর অনুযায়ী দলিল বাধ্যতামূলক হলে একদিকে যেমন আবাসন বাজারে স্বচ্ছতা বাড়বে, তেমনি রাজস্ব আয়ও হবে সঠিকভাবে।’

তবে তাঁর সতর্ক বার্তার ফলে প্রথম দিকে আবাসন বাজারে কিছুটা মন্দা আসতে পারে। কারণ তখন ক্রেতাকে পুরো অর্থ সাদাটাকায় দিতে হবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এই পদ্ধতি দুর্নীতি কমাবে এবং বাজার হবে স্থিতিশীল ও বাস্তবমুখী।

দেশে আবাসন খাতের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এই করহার কমানোর প্রস্তাবকে স্বস্তিকর বলে দাবি করলেও মৌজা মূল্য বাতিলের উদ্যোগে জানিয়েছে আপত্তি। সংগঠনটি স্পষ্টভাবে জানিয়েছে—তারা বাজারমূল্যে দলিল বাধ্যতামূলক করার পক্ষে নয়। রিহ্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া দাবি করেন, ‘দলিলে বাজারমূল্য বাধ্যতামূলক করা হলে সেক্টরে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসতে পারে।’

তবে এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, অতীতে অনেক সময় আবাসন খাতের দাবি অনুযায়ী কর কমানো হলেও এ খাত কর ফাঁকির সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারেনি। বরং অনেকে জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রি করেও রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করে না।

২০১০ সালের ‘সর্বনিম্ন বাজারমূল্য নির্ধারণ বিধিমালা’ সংশোধনের মাধ্যমে এখন থেকে প্রতিটি মৌজায় শেষ দুই বছরে সম্পাদিত দলিলের গড় মূল্য বিশ্লেষণ করে—গণশুনানি বা গোপন তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হবে। প্রয়োজনে এক মৌজাকে ভেঙে একাধিক ক্লাস্টারে ভাগ করার সুযোগও থাকবে।

বাজারমূল্য নির্ধারণের কমিটিগুলোর নেতৃত্বে থাকবেন বিভাগীয় কমিশনার বা জেলা প্রশাসকেরা। তাঁরা আইন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে সর্বনিম্ন বাজারমূল্য নির্ধারণ করবেন, যা ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডেটাবেইসে প্রকাশ করা হবে। প্রতিবছর এই তথ্য হালনাগাদ করার কথাও থাকছে।

এনবিআর সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে রেজিস্ট্রেশন ফি ১ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকলেও স্ট্যাম্প ফি ১.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশে আনার প্রস্তাব আসছে। স্থানীয় সরকার কর ও গেইন ট্যাক্স নিয়েও ছাড়ের চিন্তা রয়েছে; যাতে সম্মিলিতভাবে কর ও ফি ৮ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে থাকে।

সংস্থাটির কর্মকর্তাদের মতে, এই সংস্কারের মাধ্যমে স্বল্প মেয়াদে কিছুটা চাপ সৃষ্টি হলেও দীর্ঘ মেয়াদে আবাসন বাজার আরও বাস্তবভিত্তিক, সুশৃঙ্খল এবং রাজস্ববান্ধব হয়ে উঠবে, যেখানে দলিল হবে বাস্তব দামে আর কালোটাকার দৌরাত্ম্য কমবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ডিসেম্বরেই নির্বাচন হওয়া উচিত: সেনাপ্রধান

শেখ হাসিনাসহ ৩৯৩ জনের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করে নিলেন বিএনপি নেতা

৪ ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তি চাকরিচ্যুতি

বদলে গেল স্কুল-কলেজের শপথ, বাদ মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা

শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান আটক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত