Ajker Patrika

ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ মদিনা সনদ

ফয়জুল্লাহ রিয়াদ
মসজিদে নববী, মদিনা। ছবি: সংগৃহীত
মসজিদে নববী, মদিনা। ছবি: সংগৃহীত

ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু দলিল-দস্তাবেজ পাওয়া যায়, যা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়, বরং যুগযুগান্তর মানবসভ্যতার জন্য চিরন্তন শিক্ষা হয়ে থাকে। মদিনা সনদ বা মদিনার সংবিধান তেমনই একটি দলিল। আরব উপদ্বীপে বহুধর্মীয় ও বহুজাতীয় সমাজে শান্তি, ন্যায়বিচার ও সহাবস্থানের এক অনন্য চুক্তি ছিল এটি।

হিজরতের পর মদিনার সমস্ত গোত্র ও সম্প্রদায়কে নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) এ সনদ প্রণয়ন করেন। ইসলামের ইতিহাসে এ সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। কারণ এটি ছিল মুসলিম ও অমুসলিম—উভয় সম্প্রদায়কে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রথম লিখিত সংবিধান।

মদিনা সনদের প্রেক্ষাপট: ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, মদিনায় তখন প্রধানত তিনটি জনগোষ্ঠী বসবাস করত—

  • ১. মক্কা থেকে হিজরত করে আসা মুহাজির, মদিনার স্থানীয় আনসার এবং পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণকারী মুসলমান সম্প্রদায়।
  • ২. বনু কায়নুকা, বনু নাদির, বনু কুরাইজা প্রভৃতি গোত্রের ইহুদি সম্প্রদায়।
  • ৩. এমন মুশরিক সম্প্রদায়, যারা তখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি এবং নির্দিষ্ট কোনো ধর্মমতেরও অনুসারী ছিল না।

মদিনায় বসবাসকারী এসব ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ছিল। বিশেষত আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যকার দীর্ঘকালীন যুদ্ধ-বিগ্রহ চলে আসছিল। ইহুদিরাও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িত ছিল। এমন পরিস্থিতিতে কেবল নবী হিসেবেই নয়, বরং একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেও রাসুলুল্লাহ (সা.) এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমাধান, মদিনায় বসবাসকারী সমস্ত মানুষের পারস্পরিক সহাবস্থান, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সবাইকে নিয়ে এক লিখিত চুক্তি করেন। এ চুক্তিটাই ইতিহাসে ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত।

মদিনা সনদ ও বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা:

ঐতিহাসিকদের মতে, মদিনা সনদ মোট ৪৭টি ধারা নিয়ে গঠিত হয়েছিল। সনদে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অধিকার, কর্তব্য, পারস্পরিক সহাবস্থান ও সম্পর্কের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। এ সংবিধানের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ধারা নিম্নরূপ—

  • ১. সনদে স্বাক্ষরকারী গোত্রসমূহ একটি রাষ্ট্র গঠন করবে।
  • ২. কোনো গোত্র গোপনে মদিনার বহিরাগত কারও সঙ্গে কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবে না। ৩. সব ধর্মাবলম্বী পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে।
  • ৪. মদিনার ওপর বহিরাগত আক্রমণ হলে সবাই মিলে তা প্রতিহত করবে।
  • ৫. পারস্পরিক যুদ্ধ বা বিরোধ সৃষ্টি হলে তার ফয়সালা আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুলের হাতে ন্যস্ত করা হবে।
  • ৬. ব্যক্তিগত অপরাধের শাস্তি ব্যক্তি নিজেই ভোগ করবে। এক ব্যক্তির অপরাধের জন্য গোত্রের সবাইকে দায়ী করা যাবে না।
  • ৭. কেউ অন্যায় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করলে সবাই মিলে তার শাস্তির বিধান করবে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, আত্মীয় বা নিজ সন্তান হলেও কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
  • ৮. অসহায় ও দুর্বলদের সব সময় সাহায্য করা হবে।
  • ৯. সব ধর্মের লোকেরা পরস্পর বন্ধুসুলভ আচরণ করবে।

সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো যে সংবিধান মেনে চলে, সেখানে মানবাধিকার সংরক্ষণ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পদ ও জীবনের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ মানুষের মৌলিক অধিকার সংবলিত যতগুলো নীতি স্থান পেয়েছে, তার সবই মদিনা সনদে বিদ্যমান ছিল। ফলে বলা যায়, মদিনা সনদ আধুনিক সংবিধান ও বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম প্রাচীন ভিত্তি।

মদিনা সনদ সর্বযুগের সমগ্র মানবজাতির জন্য এক অনন্য শিক্ষা। নবীজি (সা.) প্রমাণ করেছেন, ভিন্ন মত, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন গোত্র সবাইকে সঙ্গে নিয়েও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। আজকের পৃথিবী যখন যুদ্ধ-বিগ্রহ, সাম্প্রদায়িকতা ও বিভাজনের অন্ধকারে নিমজ্জিত, তখন মদিনা সনদ আমাদের শেখায় একতাবদ্ধ থাকাই শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল চাবিকাঠি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত