Ajker Patrika

৪৫ বছর ছদ্মবেশে বিলাসী জীবন, অবশেষে বিচারের মুখে গুম-খুনের হোতা গোয়েন্দাপ্রধান

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২: ৪৩
শাহ পাহলভীর গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান পারভেজ সাবেতি। ছবি: দ্য গার্ডিয়ানের সৌজন্যে
শাহ পাহলভীর গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান পারভেজ সাবেতি। ছবি: দ্য গার্ডিয়ানের সৌজন্যে

ইরানের সাবেক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর কুখ্যাত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার নাম ছিল সাভাক। ভিন্নমতাবলম্বী ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের ধরে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করাই ছিল এই সংস্থার প্রধান কাজ।

এই সংস্থার প্রধান পারভেজ সাবেতি (৮৯) বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের উইন্ডারমেরে একটি অভিজাত এলাকায় বসবাস করেন। পিটার ছদ্মনামে এত দিন নির্ঝঞ্ঝাটেই কাটিয়েছেন তিনি। আপাতদৃষ্টিতে শান্তশিষ্ট এক অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ হিসেবেই মানুষ তাঁকে চিনত। কিন্তু সম্প্রতি পরিচয় ফাঁস হয়ে গেছে। অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য যুক্তরাষ্ট্রেই আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন তিনি।

প্রায় ৪৫ বছর ধরে নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে পেরেছিলেন সাবেতি। তবে সম্প্রতি সাবেক তিন রাজনৈতিক বন্দী তাঁর বিরুদ্ধে ২২৫ মিলিয়ন ডলারের (প্রায় ২,৪০০ কোটি টাকা) ক্ষতিপূরণ মামলা করেছেন।

একজন ইরানি ভিন্নমতাবলম্বী, জ্যেষ্ঠ সাভাক কর্মকর্তার বাড়ির ভান্ডারে পাওয়া বেশ কয়েকটি তিন-স্তরের গ্রিডের একটিতে শুয়ে আছেন। এই বাড়ির নিচেই পাওয়া গেছে মানুষ পোড়ানোর চুল্লি। বিক্ষোভকারীরা সেখানে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১৯৭৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তোলা ছবি। ছবি: দ্য গার্ডিয়ানের সৌজন্যে
একজন ইরানি ভিন্নমতাবলম্বী, জ্যেষ্ঠ সাভাক কর্মকর্তার বাড়ির ভান্ডারে পাওয়া বেশ কয়েকটি তিন-স্তরের গ্রিডের একটিতে শুয়ে আছেন। এই বাড়ির নিচেই পাওয়া গেছে মানুষ পোড়ানোর চুল্লি। বিক্ষোভকারীরা সেখানে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১৯৭৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তোলা ছবি। ছবি: দ্য গার্ডিয়ানের সৌজন্যে

পারভেজ সাবেতি শাহের শাসনামলে সাভাক-এর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক ছিলেন। তাঁকে শাহের শাসনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এবং ভয়ংকর পুরুষদের একজন হিসেবে গণ্য করা হতো। ১৯৭৮ সালে লেখা মার্কিন সিআইএর একটি গোপন নথিতেও সাবেতিকে শাহের একান্ত অনুগত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে মামলার বিবরণের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, দেশজুড়ে বিরোধীদের গ্রেপ্তার, জিজ্ঞাসাবাদ এবং বিচারের ক্ষমতা ছিল সাবেতির হাতে। সাভাক প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৭৯ সালে বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষকে আটক ও নির্যাতন করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে শত শত ব্যক্তিকে হত্যা করেছে এই সাভাক।

মামলার বাদী তিন ব্যক্তি, যাঁদের বয়স এখন ৬৮ থেকে ৮৫ বছরের মধ্যে, তাঁরা বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করেন। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, সাবেতির সরাসরি নির্দেশে তেহরানের কারাগারে তাঁদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছিল। অত্যাচারের মধ্যে ছিল: ধর্ষণ, বৈদ্যুতিক শক, পানিতে চুবানো ও হাত-পায়ের নখ উপড়ে ফেলা।

বাদীপক্ষের অভিযোগ অনুসারে, সাভাক-এর কারাগারে ‘অ্যাপোলো’ নামে একটি বিশেষ বৈদ্যুতিক চেয়ারের মতো যন্ত্র ব্যবহার করা হতো। এ যন্ত্রটিতে একটি ধাতব হেলমেট ছিল। এই হেলমেট পরার কারণে নির্যাতিত ব্যক্তিরা যখন যন্ত্রণায় চিৎকার করতেন, সেই চিৎকার বহুগুণে বর্ধিত হয়ে নিজেদের কানেই ফিরে আসত। ফলে যন্ত্রণায় চিৎকার করলে যন্ত্রণা আরও বেড়ে যেত।

ইরানে শাহের শাসনামলে রাজনৈতিক পুলিশ সাভাকের হাতে নির্যাতনে অঙ্গ হারানো বন্দীরা। ১৯৮০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তোলা ছবি। ছবি: দ্য গার্ডিয়ানের সৌজন্যে
ইরানে শাহের শাসনামলে রাজনৈতিক পুলিশ সাভাকের হাতে নির্যাতনে অঙ্গ হারানো বন্দীরা। ১৯৮০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তোলা ছবি। ছবি: দ্য গার্ডিয়ানের সৌজন্যে

সাবেতির আইনজীবীরা যুক্তি দিয়ে মামলাটি খারিজ করার আবেদন করেছেন। তাঁদের দাবি, এই অভিযোগ ‘দায়ের করার সময়সীমা’ পার হয়ে গেছে। কিন্তু গত ১২ আগস্ট, ফ্লোরিডার কেন্দ্রীয় ফেডারেল জেলা আদালতের বিচারক গ্রেগরি প্রেসনেল তাঁদের আবেদন আংশিকভাবে খারিজ করে দেন। বিচারক রায় দেন, নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা আইনের অধীনে করা অভিযোগ আমলে নেওয়া হবে।

যদিও আদালতের নির্দেশে রাজ্যের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইনি অভিযোগগুলো খারিজ করা হয়েছে। তবে এখন নির্যাতনের অভিযোগটি দায়েরের সময়সীমার বাইরে কি না, তা নির্ধারণের জন্য উভয় পক্ষকে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হবে। যদি অভিযোগটি দায়ের করার সময়সীমার মধ্যে বলে প্রমাণিত হয়, তবে আগামী বছরই এর বিচার শুরু হতে পারে।

সাবেতি এর আগে দাবি করেছিলেন, তিনি ‘সর্বদা নির্যাতনের বিরোধী ছিলেন’ এবং সাভাক কখনো বন্দীদের নির্যাতন করত না।

আত্মগোপন ও পরিচয় ফাঁস

পারভেজ সাবেতি ও তাঁর স্ত্রী নাসরিন (৭৫) ১৯৭৮ সালে তেহরান থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। ফাঁস হওয়া স্টেট ডিপার্টমেন্টের নথি অনুযায়ী, তাঁরা ইরান থেকে ২০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ স্থানান্তর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর তাঁরা নাম পরিবর্তন করে যথাক্রমে পিটার ও ন্যান্সি রাখেন। এই ছদ্মনামে সাবেতি ফ্লোরিডায় একটি রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফ্লোরিডার অরেঞ্জ কাউন্টিতে ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বিলাসবহুল উইন্ডারমের ম্যানশনসহ কমপক্ষে আটটি সম্পত্তির মালিক হন।

মামলার আরজিতে দাবি করা হয়েছে, ৪৫ বছর ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা সাবেতির পরিচয় প্রকাশ্যে আসে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তাঁর এক মেয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে ইরান সরকারের বিরুদ্ধে একটি র‍্যালিতে বাবার ছবি টুইট করেন, এতেই ফাঁস হয়ে যায় পরিচয়। বাদীপক্ষ দাবি করেছে, এই ঘটনাটির ফলেই তাঁরা সাবেতির অবস্থান চিহ্নিত করতে এবং মামলা করতে সক্ষম হন।

বর্তমানে সাবেতি সাবেক শাহের পুত্র রেজা পাহলভীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করছেন বলে জানা যায়।

বাদীপক্ষের আইনজীবী সারা কোলন আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি তাঁর মক্কেলদের নাম গোপন রাখার আবেদন মঞ্জুর করায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। কারণ মামলা দায়ের করার পর থেকেই তাঁদের হত্যার হুমকি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।

নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের পক্ষে কাজ করা ‘ইরানি কালেক্টিভ ফর জাস্টিস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি’ নামের একটি সংস্থা জানিয়েছে, সাবেতির এই মামলা শাহের শাসন এবং তার পরবর্তী ইসলামি সরকারের অধীনে ইরানে চলে আসা ‘হিংসার চক্র’ বন্ধ করতে সাহায্য করবে। সংস্থাটির মুখপাত্র বলেন, ‘বার্তাটি সহজ এবং স্পষ্ট হওয়া উচিত: সমস্ত ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার পাওয়ার যোগ্য এবং নির্যাতন ও নিপীড়নে জড়িত প্রত্যেককেই জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গাজায় ধ্বংসস্তূপের মাঝেই বড়দিনের আনন্দ খুঁজছে ক্ষুদ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
গত ২১ ডিসেম্বর গাজা সিটিতে ক্রিসমাস উদযাপনের আগে হলি ফ্যামিলি ক্যাথলিক চার্চের বাইরে গাজার শিশু ও সন্ন্যাসিনীরা। ছবি: এপির সৌজন্যে
গত ২১ ডিসেম্বর গাজা সিটিতে ক্রিসমাস উদযাপনের আগে হলি ফ্যামিলি ক্যাথলিক চার্চের বাইরে গাজার শিশু ও সন্ন্যাসিনীরা। ছবি: এপির সৌজন্যে

গাজা উপত্যকায় গত দুই বছর ধরে চলা ধ্বংসলীলা আর লাশের মিছিলের মাঝেও বড়দিনের আনন্দ ফিরে পাওয়ার এক বিষাদময় চেষ্টা চালাচ্ছে সেখানকার ক্ষুদ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়। একটি নড়বড়ে যুদ্ধবিরতি কিছুটা স্বস্তি দিলেও, ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি আর বাস্তুচ্যুত মানুষের হাহাকার অনেক ঐতিহ্যবাহী উৎসবকে ম্লান করে দিয়েছে।

৭৬ বছর বয়সী আত্তাল্লাহ তরাজি সম্প্রতি বড়দিনের উপহার হিসেবে এক জোড়া মোজা আর স্কার্ফ পেয়েছেন। গাজার কনকনে শীত থেকে বাঁচতে এগুলোই এখন তাঁর বড় সম্বল। গির্জার অন্যান্য সদস্যদের সাথে তরাজি যখন গাইলেন—‘খ্রিস্টের জন্ম হয়েছে, হালেলুইয়া’ (একটি হিব্রু শব্দ, যার অর্থ প্রভুর প্রশংসা), তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার বিভীষিকা ঢাকা পড়েছিল বিশ্বাসের সুরে।

গাজার সেন্ট্রাল সিটি এলাকার ‘হলি ফ্যামিলি চার্চ’ কম্পাউন্ডে আশ্রয় নেওয়া তরাজি বলেন, ‘আমরা এই পবিত্র মুহূর্তে যুদ্ধ, বিপদ আর বোমাবর্ষণের কথা ভুলে যেতে চাই। খ্রিস্টের জন্মের আনন্দ আমাদের সব তিক্ততাকে ছাপিয়ে যাক।’

তবে সবার জন্য উৎসবের অনুভূতি এক নয়। শাদি আবু দাউদের জন্য এবারের বড়দিনটি অত্যন্ত কষ্টের। গত জুলাই মাসে এই ক্যাথলিক চার্চ কম্পাউন্ডেই ইজরায়েলি হামলায় তাঁর মা নিহত হন ও ছেলে আহত হয়। ইজরায়েল একে ‘দুর্ঘটনা’ বলে দুঃখ প্রকাশ করলেও স্বজন হারানোর ক্ষত এখনও দগদগে। আবু দাউদ বলেন, জখম এখনও কাঁচা। এখানে কোনো উৎসব নেই, আমরা এখনও ‘না যুদ্ধ না শান্তি’র এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে বাস করছি।

গাজার প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে খ্রিস্টানদের সংখ্যা এখন নগণ্য। যুদ্ধের কারণে অনেক পরিবার দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ২৩ বছর বয়সী ওয়াফা ইমাদ এলসায়েঘ জানান, বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়রা না থাকায় আগের মতো আমেজ নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিবার নিয়ে সাজসজ্জা করছি ঠিকই, কিন্তু যাদের সাথে সব আনন্দ ভাগ করে নিতাম, তারা আজ গাজায় নেই। এই পরিবেশ আগের মতো করে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।’

৩৫ বছর বয়সী মা এলিনোর আমাশ তাঁর সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে ঘরে বড়দিনের গাছ (ক্রিসমাস ট্রি) সাজিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানেরা কিছু চকলেট আর মিষ্টি পেয়ে বোমার ভয় ছাড়া শ্বাস নিতে পারছে। কিন্তু তাবুগুলোতে বসবাসকারী মানুষের কষ্ট দেখে চোখে জল আসে।’

গাজার খ্রিস্টানরা মনে করেন, তাঁরা সংখ্যায় যত কমই হোক না কেন, এটি এই ভূমির প্রতি ভালোবাসা এবং বিশ্বাসের এক অটল সাক্ষ্য। আত্তাল্লাহ তরাজি প্রার্থনা করেন যেন তাঁর জাতি শান্তি ও স্বাধীনতা পায়। তিনি বিশ্বাস করেন, এই পরিস্থিতির চেয়েও বড়দিনের আনন্দ এবং তাঁদের বিশ্বাস অনেক বেশি শক্তিশালী।

গত অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির পর গাজায় হামলার তীব্রতা কমলেও মাঝেমধ্যেই প্রাণঘাতী আঘাত আসছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইজরায়েলি অভিযানে এ পর্যন্ত প্রায় ৭১ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অর্ধেকই নারী ও শিশু।

অতিবৃষ্টিতে বাস্তুচ্যুত মানুষের তাবুগুলো তলিয়ে গেছে, যা ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মস্কোতে বিস্ফোরণ, দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ নিহত তিন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১: ৪২
মস্কোর ঘটনাস্থলে পুলিশ। ছবি: বিবিসি
মস্কোর ঘটনাস্থলে পুলিশ। ছবি: বিবিসি

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে এক বিস্ফোরণে দুজন ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা এবং আরেকজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। রাশিয়ার তদন্ত সংস্থাগুলোর বরাতে জানা গেছে, দক্ষিণ মস্কোর ইয়েলেতস্কায়া স্ট্রিট এলাকায় এই বিস্ফোরণ ঘটে স্থানীয় সময় বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) ভোরে। ঘটনাস্থলটি সেই জায়গার কাছে, যেখানে চলতি সপ্তাহের শুরুতে এক রুশ জেনারেল গাড়িবোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন।

রাশিয়ার ইনভেস্টিগেটিভ কমিটির বিবৃতির বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে আটকের চেষ্টা করার সময় বিস্ফোরণটি ঘটে। পুলিশ কর্মকর্তারা যখন ওই ব্যক্তির কাছে যান, তখনই একটি বিস্ফোরক ডিভাইস সক্রিয় হয়ে যায়। বিস্ফোরণের ফলে ঘটনাস্থলেই দুই পুলিশ কর্মকর্তা প্রাণ হারান। এ সময় তাঁদের পাশে থাকা আরেকজন ব্যক্তিও বিস্ফোরণে নিহত হন।

নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার বয়স ছিল ২৪ ও ২৫ বছর। আল জাজিরার মস্কো প্রতিনিধি ইউলিয়া শাপোভালোভার তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে একজনের স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটি তাদের পরিবারের জন্য এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি।’ বিস্ফোরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য এখনো স্পষ্ট নয় বলে জানিয়েছে রুশ কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিস্ফোরণের শব্দ ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। কাছাকাছি বসবাসকারী আলেক্সান্ডার নামের এক ব্যক্তি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘একটা ভয়ংকর শব্দ হয়েছিল, কয়েক দিন আগের গাড়ি বিস্ফোরণের মতোই।’ আরেক বাসিন্দা রোজা জানান, বিস্ফোরণের সময় তাঁদের পুরো ভবনটি কেঁপে ওঠে এবং তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠেন।

বিস্ফোরণের পরপরই এলাকাটি ঘিরে ফেলে পুলিশ বাহিনী। রুশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ছবিতে দেখা গেছে, ঘটনাস্থলে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। তদন্তকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এবং বিস্ফোরক পাচারের অভিযোগে একটি মামলা করেছে।

এই বিস্ফোরণ ঘটেছে সেই এলাকার কাছে, যেখানে গত সোমবার রুশ জেনারেল ফানিল সারভারভ গাড়ির নিচে পেতে রাখা বিস্ফোরক ডিভাইসের মাধ্যমে নিহত হন। সারভারভ রুশ জেনারেল স্টাফের অপারেশনাল ট্রেনিং বিভাগের প্রধান ছিলেন এবং ইউক্রেনে চলমান সামরিক অভিযানের জন্য সেনাদের প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

রাশিয়া জেনারেল সারভারভ হত্যার পেছনে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। তবে ইউক্রেন এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে রাশিয়া ও দখল করা ইউক্রেনীয় অঞ্চলে একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনায় রুশ সামরিক কর্মকর্তা এবং এই যুদ্ধের সমর্থক বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শানলিউরফা: নবীদের যে নগরে মিলেছে তিন ধর্মের মানুষ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
তুরস্কের শানলিউরফা শহর। ছবি: সিএনএন
তুরস্কের শানলিউরফা শহর। ছবি: সিএনএন

দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কের শানলিউরফা শহরকে বলা হয় ‘নবীদের নগরী’। সিরিয়া সীমান্ত থেকে মাত্র ৪০ মাইল উত্তরে অবস্থিত এই শহরটি হাজার বছরের ইতিহাস, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির এক অনন্য সংযোগস্থল। এখানে ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম—এই তিন একেশ্বরবাদী ধর্মের কাহিনি এসে মিলেছে।

বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সিএনএন জানিয়েছে, শানলিউরফার পুরোনো শহরের দেরগাহ মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত নীলাভ পানির ‘বালিক্লিগোল’ বা ‘মাছের হ্রদ’। মূলত এখানে আছে দুটি পুকুর। ধর্মীয় মতে, দুটি পুকুরের বড়টিতে নবী ইব্রাহিম (আ.)-কে আগুনে নিক্ষেপ করেছিলেন মেসোপটেমিয়ার রাজা নমরুদ। আল্লাহ তৎক্ষণাৎ ওই আগুনকে পানি এবং জ্বলন্ত কাঠকে মাছে রূপান্তরিত করেছিলেন। এ ছাড়া ‘আইনজেলিহা’ নামের ছোট পুকুরটির নামকরণ করা হয়েছে নমরুদের কন্যা জেলিহার নামে। ইব্রাহিম নবীর প্রতি বিশ্বাসের কারণে এই পুকুরে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে জেলিহা প্রাণ হারিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস।

দুটি পুকুরই কালো দাগওয়ালা কার্প মাছে ভরা। এগুলোকে পবিত্র মনে করা হয়। তাই এই মাছগুলোকে ধরা বা এগুলোর ক্ষতি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই কারণেই বালিক্লিগোল শুধু একটি পর্যটনস্থল নয়, বরং গভীর ধর্মীয় আবেগ ও ইতিহাসের প্রতীক। মাছের গায়ে থাকা কালো দাগগুলোকে আগুনের ছাইয়ের চিহ্ন হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

বালিক্লিগোলে ভেসে বেড়ায় কালো দাগওয়ালা কার্প মাছ। ছবি: সিএনএন
বালিক্লিগোলে ভেসে বেড়ায় কালো দাগওয়ালা কার্প মাছ। ছবি: সিএনএন

ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে শানলিউরফা নানা নামে পরিচিত ছিল। আরামীয়রা একে ডাকত উরহাই, গ্রিক শাসনামলে নাম ছিল এডেসা, আরব বিজয়ের পর নাম হয় রোহা। অটোমানেরা ১৬০৭ সালে এই নগরীর নাম রাখে উরফা। পরে ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিরোধের স্বীকৃতি হিসেবে যুক্ত হয় ‘শানলি’, অর্থাৎ ‘গৌরবময়’।

এই শহরটি ইব্রাহিম (আ.), আইয়ুব (আ.), নূহ (আ.) ও জেথ্রোর মতো নবীদের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে বিশ্বাস করা হয়। পুরোনো শহরের দেরগাহ মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত বালিক্লিগোল মুসলিম তীর্থযাত্রীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। এখানেই রয়েছে মেভলিদ-ই-হালিল গুহা। বিশ্বাস করা হয়, এখানেই জন্ম হয়েছিল ইব্রাহিম নবীর। নারীরা সন্তান কামনায় ও আরোগ্য লাভের আশায় এই গুহায় আসেন।

তবে শানলিউরফার ইতিহাস শুধু ধর্মগ্রন্থেই সীমাবদ্ধ নয়। শহরটি থেকে ১৪ মাইল দূরেই আছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা বা উপাসনালয় হিসেবে চিহ্নিত ‘গ্যোবেকলি তেপে’। প্রায় ১১-১২ হাজার বছরের পুরোনো এই স্থাপনাটি মানবসভ্যতার ধারণাকেই বদলে দিয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৯৬০০ সালের এই নিওলিথিক স্থাপনাটি কৃষি ও মৃৎশিল্পের আগেই নির্মিত—যা প্রমাণ করে, ধর্মীয় আচার হয়তো সভ্যতার সূচনাতেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখানে পাওয়া টি-আকৃতির স্তম্ভ ও খোদাই করা পশুর ভাস্কর্য বিশ্বব্যাপী বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা বা উপাসনালয় হিসেবে চিহ্নিত ‘গ্যোবেকলি তেপে’। ছবি: সিএনএন
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় স্থাপনা বা উপাসনালয় হিসেবে চিহ্নিত ‘গ্যোবেকলি তেপে’। ছবি: সিএনএন

শানলিউরফা প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে ১০ হাজারের বেশি নিদর্শন। এর মধ্যে ‘উরফা ম্যান’ নামের ১১ হাজার ৫০০ বছরের পুরোনো মানব মূর্তিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাশেই হালেপলিবাহচে মোজাইক জাদুঘর ও কিজিলকয়ুন নেক্রোপলিস শহরের রোমান যুগের ইতিহাস তুলে ধরে।

ইতিহাস ও ধর্মের পাশাপাশি শানলিউরফা খাবার ও আতিথেয়তার জন্যও বিখ্যাত। উরফা কাবাব, পাটলিজান কাবাব, চি কফতে ও শিল্লিক তাতলিসি এখানকার জনপ্রিয় খাবার। স্থানীয়দের সঙ্গে ধীরে চা পান, পুরোনো বাজারে হাঁটা আর ‘সিরা গেসেসি’ নামের সাংস্কৃতিক আড্ডায় অংশ নিলে বোঝা যায়—এই শহর শুধু দেখার নয়, অনুভব করারও।

শানলিউরফা নগরীতে ‘সিরা গেসেসি’ নামে রাতের আড্ডা। ছবি: সিএনএন
শানলিউরফা নগরীতে ‘সিরা গেসেসি’ নামে রাতের আড্ডা। ছবি: সিএনএন

বলা যায়—শানলিউরফা যেন এক জীবন্ত জাদুঘর; যেখানে ধর্ম, ইতিহাস ও মানবসভ্যতার গল্প একসূত্রে গেঁথে পাশাপাশি হাঁটে অতীত ও বর্তমান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

৭ অক্টোবরের দায় এড়াতে ফন্দি খোঁজার দায়িত্ব দিয়েছিলেন নেতানিয়াহু: সাবেক মুখপাত্র

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: এপির সৌজন্যে
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: এপির সৌজন্যে

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পরপরই প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেই ঘটনার দায় এড়ানোর উপায় খুঁজতে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখপাত্র ইলাই ফেল্ডস্টাইন গত সোমবার রাতে ইসরায়েলের ‘কান’ নিউজ চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই বিস্ফোরক দাবি করেছেন।

গোপন নথি ফাঁসের দায়ে বর্তমানে বিচারের মুখোমুখি হওয়া ফেল্ডস্টাইন এই প্রথম সরাসরি নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনলেন।

ইলাই ফেল্ডস্টাইন জানান, ৭ অক্টোবরের সেই রক্তক্ষয়ী হামলার ঠিক পরেই নেতানিয়াহু তাঁকে ‘প্রথম কাজ’ হিসেবে দিয়েছিলেন—কীভাবে জবাবদিহি বা দায়বদ্ধতার প্রশ্ন থেকে রেহাই পাওয়া যায় তার উপায় বের করা। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘হামলার পর নেতানিয়াহু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘এখন কী ধরনের সংবাদ প্রচার হচ্ছে? তারা কি এখনো দায়বদ্ধতার কথা বলছে?’’ তাঁকে তখন বেশ আতঙ্কিত দেখাচ্ছিল। নেতানিয়াহু চেয়েছিলেন এমন কিছু বলা হোক, যাতে গণমাধ্যমে তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে যে ঝড় উঠেছে, তা স্তিমিত হয়ে যায়।’

ফেল্ডস্টাইন আরও দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যেন যেকোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে ‘দায়বদ্ধতা’ (Responsibility) শব্দটি ব্যবহার না করা হয়।

তবে নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে এই সাক্ষাৎকারকে ‘মিথ্যা ও বানোয়াট’ বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। হিব্রু সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে এবং নিজের অপরাধ থেকে মানুষের দৃষ্টি সরাতে এক ব্যক্তি এমন ডাহা মিথ্যা অভিযোগ করছেন।

কে এই ইলাই ফেল্ডস্টাইন

ইলাই ফেল্ডস্টাইন নেতানিয়াহুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। তবে বর্তমানে তিনি দুটি বড় কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত। গোপন নথি ফাঁস—গত আগস্টে গাজায় ছয় জিম্মি নিহতের পর প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে একটি জার্মান সংবাদমাধ্যমে সামরিক গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগে তাঁর বিচার চলছে। কাতারগেট স্ক্যান্ডাল—নেতানিয়াহুর হয়ে কাজ করার সময় কাতারের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়া দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগীর মধ্যে তিনি একজন।

উল্লেখ্য, ৭ অক্টোবরের হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত ও ২৫১ জন অপহৃত হয়। এর জবাবে ইসরায়েলের টানা দুই বছরের যুদ্ধে গাজায় এ পর্যন্ত প্রায় ৭১ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অর্ধেকই নারী ও শিশু।

২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাসের হামলাকে ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সামরিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয়। অনেকে মনে করেন, এই ব্যর্থতার দায় ঠেকানোর জন্য নেতানিয়াহু বরাবরই স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনে বাধা দিয়ে আসছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত