Ajker Patrika

কথা-কাজে মিল নেই, কী করবেন ট্রাম্প নিজেও জানেন না

অনলাইন ডেস্ক
ট্রাম্প কি ভারত-পাকিস্তানের মতো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও বিরতি আনতে পারবেন? ছবি: এএফপি
ট্রাম্প কি ভারত-পাকিস্তানের মতো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও বিরতি আনতে পারবেন? ছবি: এএফপি

গত এক সপ্তাহ ধরে ইরান নিয়ে একের পর এক পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কখনো তিনি যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছেন, আবার অন্যদিকে—ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার হুমকি দিচ্ছেন। এমনকি ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে যুক্ত হওয়ার কথাও বলছেন তিনি।

সবশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, ট্রাম্প আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবেন যে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে কি না। প্রেসিডেন্টের এমন অবস্থান পরিবর্তন দেখে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ট্রাম্পের হয়তো সুস্পষ্ট কোনো কৌশল বা লক্ষ্য নেই—বরং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চাপেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কথা ভাবছেন তিনি।

অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করছেন, ট্রাম্প হয়তো ইরানকে চূড়ান্তভাবে পরমাণু কর্মসূচি ত্যাগে বাধ্য করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে কঠোর ও যুদ্ধোন্মুখ বক্তব্য দিয়ে কূটনৈতিক চাপ বাড়াচ্ছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—এ ধরনের দ্বিমুখী চাপে উত্তেজনা এতটাই বেড়ে যেতে পারে যে তা শেষ পর্যন্ত এক সর্বাত্মক মার্কিন-ইরান যুদ্ধে পরিণত হতে পারে।

ন্যাশনাল ইরান-ইউএস কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদি বলছেন, হুমকি-ধমকি দিয়ে ইরানকে আত্মসমর্পণ বাধ্য করতে কেবল একটি কৌশল নিচ্ছেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, তিনি নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছেন, যিনি কখন কী করবেন কেউ জানে না। আর এমন একটা অস্থির পরিস্থিতি তৈরি তিনি বহু বছর ধরেই চেয়ে আসছেন, যাতে ইরানকে পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণ বন্ধ করতে বাধ্য করা যায়। আর নিজের এই চাওয়া পূরণ করতে গিয়েই তিনি নেতানিয়াহুর ফাঁদে পা দিচ্ছেন। আর সেই ফাঁদ হলো—ইরানের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া।’

যুক্তরাষ্ট্রবিষয়ক ইরানি বিশ্লেষক নিগার মোর্তাজাভি মনে করেন, নেতানিয়াহুর কূটচালের কাছে পরাজিত হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প নিজে কী চান তা তিনি আদৌও জানেন কিনা—তা নিয়ে আমি সন্দিহান। তিনি নির্বাচনের আগে “শান্তির দূত” হিসেবে প্রচার চালিয়েছেন। অঙ্গীকার করেছিলেন যে তিনি বিশ্বজুড়ে সব যুদ্ধ থামাবেন। কিন্তু পরিস্থিতি এখন কেমন? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামেনি। গাজা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে। এবং তিনি মধ্যপ্রাচ্যে আরও একটি বড় যুদ্ধ ঘটতে দিলেন! খুব নিশ্চিতভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে এটি মূলত সরকার পরিবর্তনের যুদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে তিনি বলেন এক, আর করেন আরেক।’

গত সপ্তাহের রোববার পরমাণু ইস্যুতে ষষ্ঠ দফায় আলোচনায় বসার কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের। এর ঠিক দুদিন আগেই তেহরানে হামলা চালায় তেলআবিব। হামলার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মার্কিন দূতাবাস থেকে কর্মচারীদের সরিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। আর হামলার পর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম বক্তব্য যেন নিজেদের দায় ঢাকার চেষ্টাই ছিল। তারা জানায়, হামলায় তাদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। তবে, হামলার ব্যাপারে যে ট্রাম্প বা অন্য মার্কিন কর্মকর্তারা জানতেন তা নিজেই জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

গত সাত দিনে ধীরে ধীরে পরিবর্তন এসেছে ট্রাম্পের অবস্থানে। সম্পৃক্ততা নেই বললেও পরবর্তীতে তাঁর বলা বিভিন্ন কথা ও সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া পোস্টে ইঙ্গিত ছিল উল্টো। গত মঙ্গলবার তিনি সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্টে লেখেন, ‘ইরানের আকাশের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছি আমরা। ইরানের অনেক ভালো ভালো স্কাই ট্র্যাকার এবং অন্য প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আছে বটে। কিন্তু মার্কিন প্রযুক্তির সঙ্গে সেগুলোর তুলনা চলে না।’

তবে, ওই পোস্টে তিনি ‘আমরা’ বলতে কোন কোন পক্ষকে বুঝিয়েছেন তা স্পষ্ট করেননি। কিন্তু স্পষ্ট না করলেও তিনি যে ইসরায়েল এবং আমেরিকাকে বুঝিয়েছেন তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

ইসরায়েলের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, পারমাণবিক কেন্দ্র, তেল স্থাপনা, আবাসিক ভবনসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো। বহু শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন বহু বেসামরিক মানুষও। জবাবে ইরানও ইসরায়েলি ভূখণ্ডে শক্তিশালী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, মোসাদসহ বহু সরকারি ও সামরিক কাঠামোতে হামলা চালিয়েছে ইরান।

নেতানিয়াহু প্রশাসনের দাবি—ইরান ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। খুব শিগগিরই তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে সেই অস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে। তাই বাধ্য হয়ে ইরানি পরমাণু কর্মসূচি থামাতে এই হামলা চালিয়েছে তারা। তবে, বিশ্লেষক থেকে শুরু করে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ নিজেও স্বীকার করেছে মার্কিন সহায়তা ছাড়া ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র ধ্বংস করা সম্ভব নয়।

বিশ্লেষক মোর্তাজাভি বলেন, ‘ইসরায়েল ট্রাম্পকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে এটা কোনো সরকার পরিবর্তনের যুদ্ধ নয়। মূলত ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম বন্ধই এর একমাত্র উদ্দেশ্য—যা যুক্তরাষ্ট্রও বহুদিন ধরে চেয়ে আসছে। তবে, ট্রাম্পকে যুদ্ধে টেনে আনতে নেতানিয়াহু যে কৌশল অবলম্বন করছেন তা খুবই উদ্বেগজনক। তারা এই পরিকল্পনাকে একটি সহজ, স্বল্পমেয়াদি সামরিক অভিযানের চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করছে—যেন একটি বাংকার-বাস্টার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লেই কাজ শেষ!’

তিনি সতর্ক করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে জড়ালে তা আফগানিস্তান ও ইরাকের সমন্বিত ক্ষয়ক্ষতিকেও ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘এই সংঘাত যদি পূর্ণমাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে এর ফলাফল হবে ভয়াবহ—এটি একযোগে ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধ-পরিস্থিতিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। ইরান একটি বড় ও জটিল দেশ, যেখানে যেকোনো রাজনৈতিক পতন অনিবার্যভাবে বিশৃঙ্খলা, গৃহযুদ্ধ ও মানবিক সংকট ডেকে আনবে। এটি কোনো রঙিন বিপ্লব হবে না—বরং এটি যুদ্ধ, বিশৃঙ্খলা ও দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার শঙ্কা নিয়ে হাজির হবে।’

ইরান ইতিমধ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি দেশটির ওপর সামরিক হামলা চালায়, তবে তারা কঠোর জবাব দেবে। এতে করে মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন থাকা হাজার হাজার মার্কিন সেনা ইরানি প্রতি আক্রমণের ঝুঁকিতে পড়বে। সংঘাত আরও বাড়লে ইরান পারস্য উপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক রুটগুলো বন্ধ করে দিতে পারে, যা বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

স্বামীকে ভিডিও কলে রেখে ফাঁস দিলেন স্ত্রী

ইরানে ভূমিকম্প নিয়ে পারমাণবিক পরীক্ষার জল্পনা, যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

‘আমেরিকা যুদ্ধে জড়ালে ইরানের হাতে অনেক বিকল্প আছে’

‘ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যায় নয়, গুণে বিশ্বাসী ইরান, ইসরায়েল এবার আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখবে’

এবার আক্রমণের অগ্রভাগে ড্রোন, ইরানের ‘হাইব্রিড’ হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ ইসরায়েল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত