Ajker Patrika

বাজারের বুলডোজারে বাদ যাচ্ছে না কিছুই

মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ঢাকা
আপডেট : ২৮ মে ২০২২, ১৪: ০০
বাজারের বুলডোজারে বাদ যাচ্ছে না কিছুই

বাজার মানে তো শুধু চাল-ডাল, তেল-সবজি, মাছ-মাংস নয়; থলেতে ভরতে হয় আরও শত পদ। চাল-তেল-সবজির দাম বাড়লেই খবর হয়। চ্যানেল-পত্রিকা-সামাজিক মাধ্যমে শোরগোলও হয়। তাতে হয়তো কখনো দুই টাকা কমেও। কিন্তু টুথপেস্টের দাম ৭০ টাকা থেকে ৭৫ টাকা হলে কেউ আর তা নিয়ে কথা বলে না, যে কেনে সে বোঝে। ৫০ টাকার পাউরুটি ৬৫ টাকা হয়ে গেলেও প্রতিদিন কেনাই লাগে। গায়ে মাখার বা কাপড় কাচার সাবান-ডিটারজেন্ট না হলে চলবে কীভাবে? কিন্তু তার দামও তো বেড়ে গেছে। এভাবে বলতে থাকলে বাদ যাচ্ছে না কোনো পণ্যই। আসলে বাজারের দামটাই যেন বেড়ে গেছে।

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মধ্যবয়সী সালেহ আহমেদ। রাজধানীর দিলু রোডের মাঝারি মাপের একটি ভাড়া বাসায় স্ত্রী, তিন সন্তান আর মাকে নিয়ে বসবাস করেন। মরণব্যাধি করোনায় তাঁর পরিবারে ঘা পড়েনি, কিন্তু ছুরি পড়েছে তাঁর উপার্জনে। বেতন কমে গেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। হাতে বাজারের থলে নিয়ে মলিন মুখে ঘুরছিলেন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে। মহল্লার চেয়ে একটু কম দামে জিনিস কিনতে তিনি নিয়মিতই এখানে আসেন।

আগে বাসায় দুধ চা খাওয়া হতো। গুঁড়োদুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় সে সখ কাটা পড়েছে। সালেহ আহমেদ, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা

কথায় কথায় সালেহ আহমেদ বললেন, ‘সংসারের খরচ কাটছাঁট করে কোনোমতে দুবেলা খেয়ে-পরে আছি। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, ভবিষ্যতে হয়তো তা-ও সম্ভব হবে না। আগে বাসায় দুধ-চা খাওয়া হতো। গুঁড়ো দুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেই শখ কাটা পড়েছে। আগে যে পাউরুটি কিনতাম ৫০ টাকায়, এখন কিনতে হচ্ছে ৬৫ টাকায়। টুথপেস্ট, টিস্যু, টয়লেট ক্লিনার, কাপড় কাচা সাবান—কোনটির নাম বলব? সবকিছুর দামই তো বেড়েছে।’

তাহলে সামলাচ্ছেন কীভাবে? এই প্রশ্নে সালেহ আহমেদ জানালেন দুই তরিকা। এক. পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছেন। দুই. ছাড় দিয়েছেন ব্র্যান্ডে। আগে হয়তো টুথপেস্ট বা টিস্যু কেনার সময় দোকানিকে কোনো নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের কথা বলতেন। এখন জানতে চান, দাম কম হবে কোনটার।

 সবকিছুর দাম যে বেড়ে গেছে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে বাজারের থলে হাতে নিলেই। দুই দিন রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, চাল-ডাল-তেলের সঙ্গে যেন তাল মিলিয়ে বাড়ছে সব পণ্যের দাম। এক মাসের ব্যবধানে সুগন্ধি সাবান, কাপড় কাচার পাউডার, হেয়ার অয়েল, হ্যান্ডওয়াশ, বিস্কুট, গুঁড়ো দুধ, পাউরুটি, চানাচুর, এয়ারফ্রেশনার, অ্যারোসলসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে।

এমনকি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে অনেকে ইসবগুলের ভুসি খান, বাদ যায়নি তার দামও।

বাজারের এই অবস্থায় কখনো কখনো মেজাজ হারিয়ে ফেলছেন ক্রেতারা। বেধে যাচ্ছে বিক্রেতাদের সঙ্গে। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের মুদি দোকান শওকত এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ শওকত আলী বলেন, ‘পণ্যের দাম নিয়ে প্রতিদিন কাস্টমারের সঙ্গে ঝগড়া হয়। অনেক কাস্টমার মনে করেন আমরা পণ্যের দাম বেশি রাখছি। অনেকেই আবার আমাদের চোরও ডাকে। আগে প্রতিক্রিয়া দেখাতাম। এখন সয়ে গেছে।’

শওকত আলী জানান, ১৩৫ গ্রাম ওজনের ডাভ সাবান এক লাফে ২০ টাকা বেড়ে ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যে ডেটল সাবানের দাম আগে ৫৫ টাকা ছিল এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকায়। ১৫০ গ্রাম ওজনের স্যান্ডালিনা স্যান্ডাল সোপের দাম ৫৫ থেকে বেড়ে ৬৫ টাকা হয়েছে। এক কেজি ওজনের হুইল পাউডার গত মার্চে বিক্রি হয়েছিল ৯৫ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়। ১২৫ গ্রাম ওজনের ৫৭০ তিব্বত বল সাবানের দাম মাসখানেক আগেও ছিল ১৮ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়।

গত শুক্রবার মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে বাজার করছিলেন আদাবরের বাসিন্দা স্কুলশিক্ষিকা সোহেলি শিমু। তিনি বলেন, ‘দামের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে আমরা এখন পছন্দের ব্র্যান্ডগুলো কেনা বাদ দিয়ে সস্তায় বিকল্প খুঁজছি।’

কারওয়ান বাজার ঘুরে জানা যায়, ২০০ গ্রাম ওজনের টুথপেস্টের দাম কোম্পানিভেদে ১৫ টাকা থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে এক মাসে। ১৭০ গ্রাম ওজনের যে হ্যান্ডওয়াশের দাম ছিল ৬০ টাকা, ছয় মাসে দুই দফায় ৫ টাকা করে দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। গত দুই মাসে গুঁড়ো দুধের দাম ব্র্যান্ডভেদে কেজিতে বেড়েছে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা।

প্যাকেটজাত বিস্কুট, পাউরুটি ও চানাচুরের দাম বেড়েছে। টিস্যু ও এয়ারফ্রেশনার, অ্যারোসল ও টয়লেট ক্লিনারের দামও ঊর্ধ্বমুখী। এক মাস আগেও যে ফেসিয়াল টিস্যু এক বক্স ৫০ টাকায় বিক্রি হতো, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। মশার উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় বাজারে যে অ্যারোসলের দাম এক মাস আগেও ছিল ২৯০ টাকা, এখন এক লাফে ৬০ টাকা বেড়ে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৭৫০ মিলিলিটারের এক ব্র্যান্ডের টয়লেট ক্লিনারের দাম ১০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়।

কারওয়ান বাজারে দুই সপ্তাহ আগেও ময়দা প্রতি কেজি পাওয়া যেত ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। প্রায় কাছাকাছি ছিল আটার দামও। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ২০ টাকা। বর্তমানে খোলা ময়দা ৬০ টাকা ও আটা ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চিনি দুই দিন আগেও ৮০ টাকা ছিল, এখন তা ৮৫ টাকা।

পণ্যের দাম যেভাবে হু হু করে বাড়ছে, কাস্টমারের মুখের দিকে চাইতে কষ্ট লাগে। আব্দুল্লাহ আল নোমান, কারওয়ান বাজারের দোকানদার

কারওয়ান বাজারের মেসার্স বিসমিল্লাহ স্টোরের মালিক আব্দুল্লাহ আল নোমান রাসেল বলেন, ‘পণ্যের দাম যেভাবে হুহু করে বাড়ছে, কাস্টমারের মুখের দিকে চাইতে কষ্ট লাগে।’
নিত্যপণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংসারের খুঁটিনাটি পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে মহামারির পর মানুষের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ছে বলে মনে করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, পণ্যবাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে সব জায়গায় লাগামহীনভাবে দাম বেড়ে যাচ্ছে। সরকারের উচিত বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।’

নিত্যপণ্য সম্পর্কিত খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে স্টারলিংকের প্রস্তাবিত কার্যক্রমের বিস্তারিত চায় ভারত

নির্দেশনা মানেননি পাইলট, মদিনা–ঢাকা ফ্লাইটকে নামতে হলো সিলেটে

ভারত–বাংলাদেশ বাণিজ্য বিধিনিষেধের মূল্য গুনছেন ব্যবসায়ীরা

সরকারি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষকেরা পাচ্ছেন গেজেটেড মর্যাদা

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে আরেকটি প্রক্সি ওয়ারে জড়াতে চায়: ফরহাদ মজহার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত