Ajker Patrika

তাদের ঈদযাত্রার গল্পটা আলাদা

নাজমুল হাসান সাগর, ঢাকা
তাদের ঈদযাত্রার গল্পটা আলাদা

রাজধানীর গাবতলী ব্রিজের মুখে কাঠফাটা রোদ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছয় কিশোর। পিঠে ও হাতে ভারী ব্যাগ। চোখেমুখে রাজ্যের ক্লান্তি। চাহনিতে তুমুল অসহায়ত্ব। ঢাকা থেকে রংপুর, নীলফামারীসহ উত্তরবঙ্গগামী বেশির ভাগ যানবাহন গাবতলী ব্রিজে এসে গতি কমায়। বাড়তি আয়ের আশায় চালক ও সহকারীরা মাঝরাস্তা থেকে তুলে নেন দুয়েকজন যাত্রী। তেমন কয়েকটি যানবাহনের পাশে গিয়ে কথা বলতে দেখা গেল ওই ছয় কিশোরকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়তো বনিবনা হলো না কারও সঙ্গেই। তীব্র গরমে কাহিল কিশোরেরা ব্রিজঘেঁষা একটি টং দোকানের চালার ছায়ায় গিয়ে আশ্রয় নিল।

এগিয়ে গিয়ে জানতে চাই, ‘গন্তব্য কোথায়?’

ছয় কিশোরের একজন জানাল, ‘নীলফামারীর জলঢাকায়।’

‘যাবে কীভাবে?’

‘বেরাইছি যখন কোনো একভাবে যামোয়।’

এসব উত্তর দিচ্ছিল সিরাজুল ইসলাম। ছয়জনের ওই দলে বয়সে তাকেই কিছুটা ‘বড়’ মনে হলো। বাকিদের বয়স চৌদ্দ থেকে বিশের মধ্যে। গত তিন মাস মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানসংলগ্ন একটি নির্মাণাধীন অ্যাপার্টমেন্টে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করেছে তারা। ছয়জনের মধ্যে কয়েকজন এখনো পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই খরচ জোগাতেই শহরে এসেছিল নির্মাণশ্রমিকের কাজ করতে। বাকিরা সংসারের হাল ধরতে পড়াশোনা ছেড়েছে। 

সিরাজুল জানায়, ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফিরতে গতকাল বেলা ১১টার দিকে বেরিয়েছে তারা। কল্যাণপুর, টেকনিক্যাল এবং গাবতলীর বিভিন্ন কাউন্টারে ঢুঁ মেরেছে। রংপুর ও নীলফামারীর নামী কোম্পানির বাসে টিকিটের দাম দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা। ভাড়া শুনে সিরাজুলদের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা এবং স্বপ্ন যেন অনেকটাই মিইয়ে গেছে।

এরপর বাসের আশা ছেড়ে তারা গাবতলী ব্রিজে এসেছে ট্রাক কিংবা অন্য কোনো যানবাহনে কম খরচে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয় কি না দেখতে। কিন্তু এখানেও খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না জানিয়ে মুখ খুলল রবিউল নামে আরেক কিশোর। সে বলল, ‘হানিফ, নাবিল, বাবলু বাসে পনেরো শ থাকিয়া ২ হাজার টাকা দাম চাহেছে ভালো কথা। কিন্তু টাটা মিনি ট্রাকগিলাও সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত যেতে ১২০০ টাকা চায়! এই টাকাত তো হামরা এসি গাড়িত যাবার পারমো।’

কথায় কথায় সে আরও জানায়, শুধু দূরপাল্লার বাসে নয়, ঈদ সামনে রেখে সব ধরনের যানবাহনেই বাড়তি টাকা নেওয়া হচ্ছে। মোহাম্মদপুর থেকে গাবতলী ব্রিজ পর্যন্ত আসতে লোকাল বাস ও লেগুনাতেও নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে জনপ্রতি দশ টাকা করে বেশি গুনতে হয়েছে।

ভাড়া নিয়ে এত দুশ্চিন্তার কারণ জানাল হাবিউল নামে আরেকজন। সে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। অভাবের সংসারে পরিবার পড়াশোনার খরচ দিতে পারছে না। কিন্তু পরীক্ষায় ভালো ফল করতে প্রাইভেট পড়তে এবং কোচিং করতে হবে। এ জন্য কিছু বাড়তি টাকা দরকার। সেই টাকা জোগাড় করতেই নির্মাণশ্রমিকের কাজ করতে শহরে এসেছে হাবিউল। হাড়ভাঙা খাটুনির পর যে টাকা আয় হয়েছে সেখান থেকে কোচিং ও প্রাইভেটের টাকা আলাদা করে রেখেছে সে। বাকি যে টাকা আছে তা দিয়ে বাবা-মায়ের জন্য পোশাক কিনতে হবে, বাড়ি ফেরার খরচও মেটাতে হবে সেখান থেকেই। ২ হাজার টাকা গাড়ির ভাড়া দিলে বাবা-মাকে ভালো কিছু কিনে দিতে পারবে না বলে ৫০০-৭০০ টাকায় বাড়ি ফেরার উপায় খুঁজছে হাবিউল। নিজের জন্য কী কিনবে জানতে চাইলে লাজুক হেসে সে জানাল, সব খরচের পর টাকা বাঁচলে নিজের জন্য কিনবে কিছু।

হাবিউল, সিরাজুলদের মতো আরও অনেকের দেখা মিলল গাবতলী ব্রিজ ও আমিনবাজার এলাকায়। কম খরচে বিকল্প উপায়ে বাড়ি ফেরার সুযোগের অপেক্ষায় একা কিংবা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল তারা। তাদের সবার জীবনের গল্পটা কমবেশি অনটনের। তবু ঈদের আনন্দে আপনজনের পাশে থাকতে চায় তারা। সেই তাড়না নিয়েই তাদের ঈদযাত্রা। সেই যাত্রার গল্প মিলবে না অন্য আর দশজনের সঙ্গে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত