Ajker Patrika

মেরি স্টোপসের অবহেলা: ব্যথার চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত

রাশেদ রাব্বি, ঢাকা
মেরি স্টোপসের অবহেলা: ব্যথার চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত

পেটে নিয়মিত ব্যথা। সেই ব্যথা সারাতে চিকিৎসকের কাছ যান টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের রিনা বেগম। চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানান, তাঁর কিডনিতে পাথর আছে, যা অপসারণ করতে হবে। এরপর জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে কিডনির পাথর অপসারণ করান ওই রোগী। এই ঘটনা ২০২০ সালের। তবে এখানেই শেষ নয়, সমস্যার সূত্রপাত কেবল।

কিডনির পাথর অপসারণের পর বছর তিনেক সুস্থ ছিলেন রিনা বেগম। ২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পেটের ব্যথায় আবারও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয় তাঁকে। এবার টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের যমুনা ক্লিনিকের চিকিৎসক ডা. সুমাইয়া হক তানি রোগীর আলট্রাসনোগ্রাম করে দেখেন, তিনি এক মাসের গর্ভবতী। তাঁর কিডনিতে কিছু পাথর তখনো উপস্থিত।

রোগী এবার ছুটে যান জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে অধ্যাপক নুরুল হুদা লেলিনের কাছে। গর্ভবতী থাকায় অধ্যাপক লেলিন তাঁকে একজন স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বলেন। রোগী যান ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে অধ্যাপক ডা. মেরিনা খানমের কাছে। তিনি রেফার করেন মেরি স্টোপসে। ২০২৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে মেরি স্টোপসের একটি ক্লিনিকে ডিএনসি (ছোট অস্ত্রোপচার, যা দিয়ে গর্ভপাত ঘটানো হয়) করা হয় রিনা বেগমের। কিন্তু ডিএনসি করাতে গিয়ে রোগীর জরায়ু, খাদ্যনালি, অন্ত্র ও পিত্তথলিতে ছিদ্র করে ফেলা হয়। পরিস্থিতি জটিল দেখে রোগীকে রেখে পালিয়ে যান মেরি স্টোপসের স্বাস্থ্যকর্মীরা।

এ ঘটনার পর রোগীকে দ্রুত ধানমন্ডির পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। পরদিন ২৪ সেপ্টেম্বর রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা রোগীর আরেক দফা অস্ত্রোপচার করেন এবং আইসিইউতে রেফার করেন। কিন্তু সেখানে আইসিইউ শয্যা ফাঁকা না থাকায় পান্থপথের ইউনিহেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় তাঁকে। এরই মধ্যে অস্ত্রোপচারের স্থানে ইনফেকশন দেখা দেয়।

এ কারণে ১৪ দিন পরে রিনা বেগমকে পুনরায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি ২৩ দিন চিকিৎসা গ্রহণ করেন। তবে এই দীর্ঘ সময়েও তাঁর পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা হয়নি। এখনো অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছিদ্র রয়েছে তাঁর। বৃহদান্ত্রে ছিদ্র থাকায় বিকল্প পথে কোলোরেক্টাল ব্যাগে মলমূত্র ত্যাগ করতে হচ্ছে এই রোগীকে। বর্তমানে তিনি রাজধানীর ইডেন মাল্টিকেয়ার হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. এ কে এম ফজলুল হকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন আছেন।

পেটের ব্যথা সারাতে গিয়ে একের পর এক হাসপাতালে ছুটতে ছুটতে স্বাভাবিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে ৩৮ বছর বয়সী রিনা বেগম ও তাঁর পরিবারের। মেরি স্টোপসের স্বাস্থ্যকর্মীদের এমন অপেশাদার কাণ্ডে গত ১৪ নভেম্বর ঢাকা সিএমএম আদালতে একটি সিআর মামলা করেছেন ভুক্তভোগীর স্বামী মোস্তফা তালুকদার। আদালত সিআইডিকে মামলাটি তদন্ত করতে বলেছেন।

রিনা বেগমের ডিএনসি করার ক্ষেত্রে কী ধরনের সমস্যা হয়েছে, জানতে চাইলে মেরি স্টোপস এলিফ্যান্ট শাখার ম্যানেজার মো. জহুরুল আবেদীন বলেন, ‘রিনা বেগমের চিকিৎসার বিষয়ে একটি মামলা হয়েছে। সিআইডির পক্ষ থেকে তদন্ত চলছে। আমরা এ-সংক্রান্ত সব তথ্য সিআইডিকে দিয়েছি। এর বেশি বলতে পারছি না।’ মেরি স্টোপসে ডিএনসি কারা করেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবা কর্মী আছেন। তবে তাঁরা নার্স নন।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী রিনা বেগমের স্বামী মো. মোস্তফা তালুকদার বলেন, ‘একজন স্বল্প আয়ের মানুষ হয়ে স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমি এখন নিঃস্বপ্রায়। মেরি স্টোপসের স্বাস্থ্যকর্মীর ভুল ও অবহেলায় আজ আমার স্ত্রী মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। তাই প্রতিকার চেয়ে মামলা করেছি। এখন মেরি স্টোপস থেকে আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’

গর্ভবতী অবস্থায় কিডনির পাথর অপসারণ করা যায় কি না, জানতে চাইলে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, কিডনির পাথর অপসারণ করতে রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া দিতে হয়। এতে রোগীর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। ফলে গর্ভজাত শিশুর ক্ষতি হতে পারে। তাই খুব জটিল সমস্যা না হলে গর্ভাবস্থায় কিডনির পাথর অপসারণ না করাই ভালো।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত