Ajker Patrika

ওস্তাদ জাকির হোসেনের মতো শিল্পীদের মৃত্যু নেই: সুজিত মোস্তফা

বিনোদন ডেস্ক
ওস্তাদ জাকির হোসেন (১৯৫১-২০২৪)
ওস্তাদ জাকির হোসেন (১৯৫১-২০২৪)

আমি ১৯৮৭ সালে দিল্লিতে চলে যাই শান্তিনিকেতন থেকে ট্রান্সফার নিয়ে। পণ্ডিত অমরনাথজির কাছে ইন্দোর ঘরানার খেয়াল শিখতে। শ্রীরাম ভারতীয় কলা কেন্দ্রের হোস্টেলে থাকি, মান্ডি হাউসের প্রতিটি কোনায় অডিটরিয়াম এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মেলা বসে প্রতি সন্ধ্যায়। সংগীত, নৃত্য, অভিনয় প্রতি সন্ধ্যায়ই দেখি, ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ পারফরমারদের একদম চোখের সামনে। আমার মনোজগৎ ঋদ্ধ হয়, অভিনয়, সুর এবং নৃত্য ভঙ্গিমার প্রাচুর্যে আমি বিমোহিত হই, ঋদ্ধ হই, মরে যাই বারবার।

পণ্ডিত বিরজু মহারাজ তখন তাঁর খ্যাতির শীর্ষে। ১৯৯০ সালে প্রথম সেদিন আমি তাঁর ঘরে গিয়েছি—তাঁর কর্মস্থল কত্থক কেন্দ্রে তাঁর একটি নিজস্ব ঘর ছিল, যেখানে তিনি বিশ্রাম নিতেন—আমাকে পেয়ে তিনি খুব উচ্ছ্বসিত। জানি না কোন যোগ্যতায় তাঁর ভালোবাসা পেয়েছিলাম। তিনি ঢাকায় এলেও আমাকে বারবার স্মরণ করতেন—সুজিত কিধার হ্যায়, উসকো বুলাও। মহারাজজি সেদিন বারবার বলছিলেন, শান্তি শর্মা কই, ওর একজনকে নিয়ে আসার কথা। সেই একজন যে আমি, সেটা আমি জানতাম না। শান্তি শর্মা আমার গুরু বোন, পণ্ডিত অমরনাথজির প্রিয় শিষ্যদের একজন। বেদনার বিষয় হলো, তিনি অকালপ্রয়াত হয়েছেন। বেলা ৩টায় শান্তি শর্মা এলেন এবং তিনি আমাকে দেখে খানিকটা ক্ষুব্ধই হলেন। বললেন, তোমাকে খুঁজে খুঁজে পেরেশান, আর তুমি এখানে? কী কারণে খুঁজছেন? কারণ হচ্ছে, কত্থক নাচের সঙ্গে গাইবার জন্য আমাকে কিছু বন্দিশ শিখতে হবে। মহারাজজি যখন জানলেন আমাকে খুঁজতেই শান্তি শর্মা দেরি করেছেন, তৎক্ষণাৎ তিনি বসে গেলেন আমাদের দুজনকে গান শেখাতে। একটি বন্দনা, একটি ভজন এবং দুটি ঠুমরি একবারের বসায় শিখলাম। তারপর তিনি আমার পিলে চমকে বললেন, একটা পাঞ্জাবি পরে সন্ধ্যাবেলায় চলে আসো সিরি ফোর্ট অডিটরিয়ামে। ওখানে পণ্ডিত রবিশঙ্করের আজ ৭০তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠান। আমি নাচব, তুমি ও শান্তি শর্মা আমার সঙ্গে গাইবে।

সিরি ফোর্ট অডিটরিয়ামে গিয়ে আমরা অডিয়েন্সে বসার সুযোগ পেলাম না সিকিউরিটির কারণে। কিন্তু গ্রিনরুমে ভিড় করে আমরা শুনতে লাগলাম মঞ্চের পরিবেশনা। পণ্ডিত শিব কুমার শর্মার সন্তুর বাদন হচ্ছিল। অডিয়েন্সে বসে ছিলেন ভারতবর্ষের তাবৎ গুণী ব্যক্তি, সংগীত ব্যক্তিত্ব পণ্ডিত রবিশঙ্কর ছিলেন, আরও ছিলেন বিদুষী কিশোরী আমানকার থেকে শুরু করে ওস্তাদ বিলায়েত খান, ওস্তাদ আল্লারাখা খানসহ ভারতের সংগীত নক্ষত্ররাজি।

সুজিত মোস্তফা।
সুজিত মোস্তফা।

আমি যখন মহারাজজির নাচের সময় সংগীতশিল্পীদের কাতারে এগিয়ে বসলাম, দেখলাম তবলার আসনটা খালি এবং সেখানে এক জোড়া তবলা রাখা আছে। সেই তবলার কারুকাজ নয়ন-মন হরণ করে নিল। আমি জানি, পণ্ডিত বিরজু মহারাজের নিয়মিত তবলা সংগতকার পণ্ডিত অম্বিকা প্রসাদ। কিন্তু তাঁর তবলা তো এত এক্সক্লুসিভ লেভেলের দেখিনি। আমি একটু সন্ত্রস্ত হয়ে বসলাম। খানিক পরে দেখি আমার পাশে এসে বসেছেন ওস্তাদ জাকির হোসেন। সমীহ, ভয়, শ্রদ্ধা, ভালো লাগা, ভালোবাসা—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে গাইতে বসলাম। কী এক অপূর্ব সংগতের সঙ্গে মিশে গেলাম নতুন শেখা সব বন্দিশ নিয়ে। আমি জাকিরজির অটোগ্রাফ চেয়েছিলাম। তিনি একটা খুব মূল্যবান কথা বলেছিলেন, ‘এইসা কারো সুজিত, কি লোগ তুমসে অটোগ্রাফ মাঙ্গে।’ আমার আর তাঁর অটোগ্রাফ নেওয়া হয়নি। অনুষ্ঠান শেষে ওস্তাদ আল্লারাখা মঞ্চ থেকে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ করেছিলেন। সে অন্য গল্প। আজ মন ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে, সেই ওস্তাদ জাকির হোসেন আর নেই জেনে। মঞ্চে তিনি যখন আসতেন, বসতেন, তবলায় আঙুলের ঝড় তুলতেন, ফুলেল বসন্তের সমস্ত রং নিয়ে তাঁর যন্ত্রসঙ্গী যেন হেসে উঠত, পুরো মহলকে তিনি কী এক অপার্থিব রোমাঞ্চে ডুবিয়ে দিতেন, সেটা যাঁরা তাঁকে সেভাবে শোনেননি, দেখেননি, তাঁরা কখনোই বুঝবেন না।

আমি জানি, ওস্তাদ জাকির হোসেনের মতো শিল্পীদের মৃত্যু নেই। এই বছরটা শুরু হয়েছিল ওস্তাদ রশিদ খানের প্রয়াণ দিয়ে। ৯ জানুয়ারি, ২০২৪-এ তিনি আমাদের হৃদয় শূন্য করে চলে গিয়েছিলেন আর গত রোববার চলে গেলেন তবলার বরপুত্র ওস্তাদ জাকির হোসেন। আসা-যাওয়ার পথের ধারেই জীবন। প্রকৃতির অমোঘ সত্য আমাদের মানতেই হবে। তারপরও মনে হয় এই লেভেলের মানুষদের আরও দীর্ঘদিন পৃথিবীতে থাকা পৃথিবীর জন্যই প্রয়োজন। ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার্ঘ্য এই মহান শিল্পীর জন্য।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

বগুড়ায় ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা, পাঁচ নেতা-কর্মীকে শোকজ

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত