Ajker Patrika

অনুদানের ছবি কোন পথে

আপডেট : ১৭ জুন ২০২১, ১২: ৩৭
অনুদানের ছবি কোন পথে

ঢাকা: চলচ্চিত্রশিল্পে মেধা ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করাই সরকারের অনুদানের মূল লক্ষ্য। ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে দেশীয় চলচ্চিত্রে সরকারি এ অনুদান চালু করা হয়। মাঝে কয়েক বছর বাদে প্রতিবছরই অনুদান দেওয়া হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য অনুদান ঘোষণা করা হলো। বছর গড়ালেই সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু দীর্ঘ হচ্ছে না মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির তালিকা। সরকারি অনুদান নিয়ে একধরনের লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছেন পরিচালক। কেউ কেউ মাঝপথে শুটিং আটকে বসে আছেন। কোনো ছবি মুক্তি দিতে ২০ বছর কেটে যায়; কোনোটি আবার আলোর মুখই দেখে না।

মুক্তি না পাওয়া ছবির লম্বা লাইন
বছর বছর বেড়েছে অনুদানের টাকার পরিমাণ। এসেছে নিয়মনীতিতেও অনেক পরিবর্তন। সেই সঙ্গে বেড়েছে ছবি নির্মাণ নিয়ে অনিয়ম। গত এক দশকের হিসাব করলেও দেখা যাবে এর ভয়াবহ চিত্র। এর মধ্যে মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেনের ‘ধোঁকা’, ফারুক হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’, মারুফ হাসানের ‘নেকড়ে অরণ্য’, সালাউদ্দীন জাকীর ‘একা একা’, প্রশান্ত অধিকারীর ‘হাডসনের বন্দুক’, তারেক মাসুদের ‘কাগজের ফুল’, ড্যানি সিডাকের ‘কাঁসার থালায় রুপালি চাঁদ’, জাঁ নেসার ওসমানের ‘পঞ্চসঙ্গী’, মাহমুদ দিদারের ‘বিউটি সার্কাস’, নুরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’, সারা আফরীনের ‘শিকলবাহা’, লোরা তালুকদারের ‘বৃদ্ধাশ্রম’, পান্থ প্রসাদের ‘সাবিত্রী’, সোহানুর রহমান সোহানের ‘প্রিয় জন্মভূমি’, কমল সরকারের ‘দায়মুক্তি’, ফেরদৌস আলম সিদ্দিকীর ‘একজন মরিয়ম’, শবনম ফেরদৌসীর ‘আজব কারখানা’, মানিক মানবিকের ‘আজব ছেলে’, আবিদ হোসেন খানের ‘অবলম্বন’, সাইদুল আনাম টুটুলের ‘কালবেলা’, রুবাইয়াত হোসেনের ‘অবলম্বন’ ছবিগুলোর বেশির ভাগেরই অর্ধেক শুটিং হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি ছবি মুক্তির অপেক্ষায় আছে। কিছু ছবির শুটিংই শুরু হয়নি। ২০১৮-২০ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া কোনো ছবি মুক্তি পায়নি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ছবির শুটিং শুরু হলেও মাঝপথে থেমে আছে। কিছু ছবি শুটিংয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেও বেশির ভাগ ছবিরই কোনো খোঁজ নেই।

এভাবেও মুক্তি পায়
১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া অভিনেতা মাসুম আজিজ পরিচালিত ‘সনাতনী গল্প’ মুক্তি পেয়েছিল ২০ বছর পর। ২০১৮ সালের অক্টোবরে পাবনার একটি প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি মুক্তি পেলেও ঢাকায় কোনো হলে তা মুক্তি পায়নি। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরের নির্মাতা মনিরুজ্জামান মনিরের ছবি ‘পদ্মা আমার জীবন’ মুক্তি পেয়েছিল এক যুগ পর ২০০৮ সালে। আট বছর পর ‘যৌবতী কন্যার মন’ মুক্তি পায় এই বছর নামকাওয়াস্তে; ২০১৬ সালে পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল তথ্য মন্ত্রণালয়। নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ ছবিটি অনুদান পাওয়ার চার বছরের মাথায় এই বছর মুক্তি পায়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের হাবিবুর রহমানের পরিচালনায় ‘অলাতচক্র’ও এ বছর মুক্তি পায়।

সরকারি অনুদানের সিনেমা ‘বিউটি সার্কাস’ এ জয়া আহসান। মাহমুদ দিদার পরিচালিত এ ছবি এখনও মুক্তি পায়নিনির্মাতাদের অভিযোগ ও অপেক্ষা
সরকারের নির্ধারিত সময়ে ছবি নির্মাণ সম্পন্ন করতে না পারার কারণ হিসেবে সময়স্বল্পতা ও অনুদানের অর্থকে ‘অপর্যাপ্ত’ বলে অভিযোগ করছেন অনুদানপ্রাপ্ত নির্মাতারা। অনেকে হালও ছেড়ে দিয়েছেন। এনামুল করিম নির্ঝরের ‘নমুনা’ ছবিটি মুক্তি পায়নি। জানা গেছে, ছবির নির্মাণ চূড়ান্ত করেছিলেন পরিচালক। তবে সেন্সর বোর্ড থেকে এই ছবির সিংহভাগ গল্প পরিবর্তন করতে বলা হয়েছিল। ফলে ছবিটি আর নির্মাণ শেষ হয়নি।

বরেণ্য চিত্রপরিচালক ও সম্পাদক সাইদুল আনাম টুটুলের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘কালবেলা’ নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই মৃত্যু এসে থামিয়ে দেয়। সেই অসমাপ্ত কাজ শেষ করেছেন তাঁরই স্ত্রী মোবাশ্বেরা খানম। ছবিটি খুব শিগগির মুক্তি পাবে বলে জানা যায়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া ‘সূচনারেখা’ মুক্তি পায়নি। পরিচালক আখতারুজ্জামান মারা গেছেন ২০১১ সালের আগস্টে। তাঁর মৃত্যুর পর কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজটি শেষ করেননি। ২০১১-১২ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া ‘একা একা’র পরিচালক সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকী দীর্ঘদিন অসুস্থতার কারণে ছবিটি বানাতে পারেননি। তথ্য মন্ত্রণালয় তাঁকে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানিয়ে জমা দিতে বলেছে। নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর ‘কাগজের ফুল’ ছবির ভবিষ্যৎ পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে গেছে। অনুদানের টাকা ফেরত দিতে চাইছেন ক্যাথরিন মাসুদ, কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয় তারেক মাসুদের স্বপ্নের ছবিটি শেষ করার অনুরোধ করেছে। `কাঁসার থালায় রুপালি চাঁদ' ছবির কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি করেছেন পরিচালক ড্যানি সিডাক। তবে মুক্তি কবে, তা জানাতে পারেননি। `বিউটি সার্কাস'-এর পরিচালক মাহমুদ দিদার বলেন, ‘ছবির কাজ শেষ পর্যায়ে। মুক্তির জন্য প্রস্তুতি চলছে।’

তথ্য মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ
নির্ধারিত সময় শেষে কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠিয়ে সদুত্তর না পেয়ে ২০১৬ সালে পাঁচ নির্মাতার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল তথ্য মন্ত্রণালয়। অনুদান পাওয়ার আট বছরেও ছবির কাজ শেষ করতে না পারায় গত বছর কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক টোকন ঠাকুরকে গ্রেপ্তারের পর বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। যদিও জানা যায়নি কেন কবিকে গ্রেপ্তার করা হলো। কবির পক্ষে শিল্পী সমাজ সোচ্চার হলে তাঁকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই জামিন দেওয়া হয়। তাঁকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ‘কাঁটা’ ছবির জন্য অনুদান দেওয়া হয়। কিন্তু আজ অবধি তিনি তাঁর ছবির কাজ শেষ করতে পারেননি। এটা অনুদান ছবির অবস্থার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ছবিগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে নির্মাতাদের কাছে নিয়মিত ব্যাখ্যা চাওয়া হচ্ছে বলে জানান উপসচিব (চলচ্চিত্র) সাইফুল ইসলাম।

মতিন রহমানমতিন রহমান
চলচ্চিত্র অনুদান কমিটির সদস্য ও চলচ্চিত্র পরিচালক

চলচ্চিত্রকে উৎপাদন হিসেবে ধরলে তাতে সময় বেঁধে দেওয়া থাকবেই। কোনো প্রযোজকই অনির্দিষ্টকালের জন্য কোথাও বিনিয়োগ করে অর্থ ফেলে রাখেন না। পপুলার ধারার প্রডিউসাররাও ঈদ কিংবা পূজায় মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ করেন, পরিচালকেরা কিন্তু সেভাবেই চলচ্চিত্রের গল্প ও পরিবেশ নির্বাচন করেন।

প্রতিবছরই অনুদান দেওয়ার ফলে বছরের হিসাব বছরেই শেষ করতে না পারার কারণেই এই জটিলতা। আইনগত ব্যবস্থা নিতে গেলে অনেকেই শিল্প–সংস্কৃতির দোহাই দেন। ৯ মাসে না হলে নিজের অর্থে আপনি ৬ বছরে ‘ইডিপাস’ কিংবা ১০ বছরে ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য নিয়ে গবেষণা করে ছবি বানান। আর সরকারি অর্থ নেওয়ার আগে ভাবতে হবে, ৯ মাসের মধ্যে ছবিটি বানাতে পারবেন কি না। যুক্তিসংগত কারণ দেখিয়ে সময় বাড়ানোর আবেদন করলে তা বাড়ানো হয়। ছবি করতে লাগবে ১০ কোটি টাকা, সেখানে উৎসাহের জন্য সরকার ৫০ লাখ টাকা দিচ্ছে। বাকিটা আপনাকে ব্যবস্থা করতে হবে। আর পর্যাপ্ত বাজেট না পেলে স্বল্প বাজেটের গল্প নির্বাচন করতে হবে।

২০২০-২১ অর্থবছরে যে ছবিগুলো পেল অনুদান
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শাখা

প্রযোজক ও পরিচালক জেড এইচ মিন্টুর ‘ক্ষমা নেই’, নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুলের ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’, উজ্জ্বল কুমার মণ্ডলের ‘মৃত্যুঞ্জয়’।

শিশুতোষ শাখা
পরিচালক এফ এম শাহীন ও হাসান জাফরুলের ‘মাইক’, পরিচালক লুবনা শারমিনের ‘নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়’

সাধারণ শাখা
পরিচালক কাজী হায়াতের ‘জয় বাংলা’, অনিরুদ্ধ রাসেলের ‘জামদানী’, জাহিদুর রহিম অঞ্জনের ‘চাঁদের অমাবস্যা’, জয়া আহসান ও মেজবাউর রহমান সুমনের ‘রইদ’, অমিতাভ রেজার ‘পেন্সিলে আঁকা পরী’, অরুণ চৌধুরীর ‘জলে জ্বলে’, অরুণা বিশ্বাসের ‘অসম্ভব’, মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেনের ‘ভাঙন’, রকিবুল হাসান চৌধুরীর ‘দাওয়াল’, রেজাউর রহমান খান পিপলুর ‘বলী’, আবদুস সামাদ খোকনের ‘শ্রাবণ জ্যোৎস্নায়’, আশুতোষ সুজনের ‘দেশান্তর’, এস এ হক অলিকের ‘গলুই’, ইব্রাহিম খলিলের ‘দেয়ালের দেশ’, কবিরুল ইসলাম রানার ‘জলরঙ’।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মেঘমল্লারের জবাবের পর ডাকসু ও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যা লিখলেন শশী থারুর

অনিয়মের অভিযোগ এনে জাকসু নির্বাচন কমিশন সদস্যের পদত্যাগ

সমৃদ্ধ করা ইউরেনিয়াম ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে আছে: ইরান

একটি রাজনৈতিক দলের মুখে আল্লাহর নাম, নির্বাচনে জিততে করে মিথ্যাচার: জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম

চার্লি কার্কের সন্দেহভাজন হত্যাকারী আটক, বয়স ২২

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত