Ajker Patrika

মাঝিরঘাট ফেরিঘাটে শহীদ চেংগার ‘রং সাইডের কারবার’

নুরুল আমীন রবীন, শরীয়তপুর
মাঝিরঘাট ফেরিঘাটে শহীদ চেংগার ‘রং সাইডের কারবার’

দিনভর দৌড়াদৌড়ি করে বেলা শেষে ঘাটে এসে ঠেকে যায় মানুষ। পার পাওয়ার ঠেকা। শরীয়তপুরের মাঝিরঘাট ফেরিঘাটে তখন দেখা মেলে একজন শহীদ চেংগা এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের। ঠেকে যাওয়া লোকজনকে নিয়ে তাঁরা রাতভর রং সাইডে খেলেন, রং সাইডে চলেন। তাঁদের সঙ্গে চললে ভালো, না চললে কপালে নির্যাতন নতুবা ভোগান্তি। কোনটা বেছে নেবেন সেটা ট্রাকচালকদের বিষয়। 

পারাপারের অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে যানবাহনের দীর্ঘ সারি। অথচ শহীদ চেংগার লোকজনকে টাকা দিলেই রাস্তার উল্টো পাশ দিয়ে সোজা চলে যাওয়া যায় ফেরিতে। আর টাকা না দিয়ে এ কাজ করতে চাইলেই বেধে যায় ঝামেলা, শুরু হয় মারধর। ঘাট কর্তৃপক্ষ বা পুলিশ-প্রশাসন, তাদের এসব নিয়ে যেন কোনো দায় নেই।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি) সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য মাদারীপুরের বাংলাবাজার ও শরীয়তপুরের মাঝিরঘাট ফেরিঘাট ব্যবহার করে দক্ষিণের ২১ জেলার মানুষ। গত বছর পদ্মা সেতুর সঙ্গে কয়েক দফা ফেরির ধাক্কা লাগার ঘটনায় শিমুলিয়া-বাংলাবাজার পথে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে জরুরি প্রয়োজনীয় যানবাহন পারাপারের জন্য ওই বছরের আগস্ট মাসে বিকল্প হিসেবে মঝিরঘাটে ফেরিঘাট নির্মাণ করা হয়। ডিসেম্বর থেকে এই পথে নিয়মিত যানবাহন পারাপার হচ্ছে। ৩টি ফেরিতে প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫৫০টি ছোট-বড় যানবাহন পারাপার হচ্ছে। কিন্তু পারাপারের অপেক্ষায় দীর্ঘ লাইনে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে যানবাহনের চালক-শ্রমিক ও যাত্রীদের। ট্রাকচালকদের জন্য এই যন্ত্রণাটা আরও দুঃসহ। সেই সুযোগটাই নিচ্ছে শহীদ চেংগা গং। 

গত রোববার রাতে মঝিরঘাট ফেরিঘাটে অবস্থান করে দেখা যায় শহীদ চেংগার লোকজনের কারবার। রাত ১০টার পর দিকে ফেরির জন্য অপেক্ষায় ছিল পণ্যবাহী ট্রাকের দুই কিলোমিটার দীর্ঘ সারি। এর মধ্যে হাজির শহীদ চেংগা ও ৮-১০ জন সাঙ্গপাঙ্গ। তাঁরা ফেরির সিরিয়াল পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ট্রাকপ্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ করে টাকা দাবি করছেন। ঘাটের একটি ফলের দোকান থেকে টাকা তোলার পর সক্রিয় হয় চক্রের সদস্যরা। 

টাকা দেওয়া ট্রাকগুলোকে তাঁরা লাইন থেকে বের করে রাস্তার উল্টো পাশে নিয়ে যান। এরপর উল্টো পথ ধরে সোজা ঘাট। দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরাও উল্টো পথে আসা ট্রাকগুলোকে পথ করে দিচ্ছেন। 

পারাপারের অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে যানবাহনের দীর্ঘ সারি। অথচ শহীদ চেংগার লোকজনকে টাকা দিলেই রাস্তার উল্টো পাশ দিয়ে সোজা চলে যাওয়া যায় ফেরিতে। রাত দেড়টার দিকে বেধে গেল ঝামেলা। চক্রের সদস্যরা এক ট্রাকচালকদের সঙ্গে শুরু করে দেন বাগ্‌বিতণ্ডা। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে ট্রাকচালককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। পরে ১ হাজার টাকায় দফারফা করে ফেরিতে ওঠার সিরিয়াল পান ওই ট্রাকচালক।

নির্যাতনের শিকার ট্রাকচালকের নাম রফিক। তিনি বলেন, ‘ট্রাক নিয়ে বিকেল থেকে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মধ্যরাতে সিরিয়াল অনুযায়ী ফেরিতে ওঠার জন্য ট্রাক চালু করার সঙ্গে সঙ্গে ছয়-সাতজনের একটি দল এসে ১ হাজার ২০০ টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা আমার গায়ে হাত তোলে। আমার মতো আরও বেশ কয়েকজন চালকের সঙ্গে ওরা একই আচরণ করেছে।’ 

গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতি টের পেয়ে চক্রের মূল হোতা শহীদ চেংগা ছুটে আসেন। রাস্তার পাশে একটি দোকানের পেছনে নিয়ে নিয়মিত আর্থিক সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এমন প্রস্তাবের জবাবে তাঁকে বিভিন্ন কৌশলে সড়কের ওপর নিয়ে আসেন সংবাদকর্মীরা। কিছুটা জনবহুল ও নিরাপদ এলাকায় আসার পর তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, ঘাটে চাঁদাবাজি কেন করছেন? শহীদ চেংগা ততক্ষণে উল্টো পথে। তাঁর সাফ জবাব, ‘কে বা কারা চাঁদা আদায় করছে আমি কিছু জানি না। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখেন।’ 

বরিশাল থেকে তরমুজবোঝাই ট্রাক নিয়ে ঘাটে আটকা পড়েন আমজাদ হোসেন। দীর্ঘ সময় আটকে থাকার পর শহীদ চেংগা চক্রের সদস্যদের ৯০০ টাকা দিয়ে ফেরিতে উঠতে পেরেছেন আমজাদ। সড়কে থাকা অবস্থায় শহীদ চেংগা বাহিনীর ভয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি তিনি। তবে ফেরিতে ট্রাকটি ওঠার পর তিনি বলেন, ‘ওদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। সারা রাত আটকে থেকেও অনেকে সিরিয়াল পায় না, অথচ ওদের টাকা দিলেই সোজা ফেরিতে উঠে যায় গাড়ি। প্রকাশ্যে এসব চললেও দেখার যেন কেউ নেই।’ 

দেখার দায়িত্ব তো শুরুতেই ছিল ট্রাফিক পুলিশের। জানতে চাইলে মাঝিরঘাট ফেরিঘাটের দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক বিভাগের পরিদর্শক আরিফুর রহমান বলেন, ‘চাঁদাবাজি ও ট্রাকচালকদের নাজেহাল করার কিছু অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছি। জাজিরা থানার পুলিশকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।’

বিআইডব্লিউটিসির ঘাট ব্যবস্থাপক মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘ফেরিঘাটে বা পন্টুনে যাত্রী বা চালকদের কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় না। পন্টুনের বাইরে সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পুলিশের।’ 

শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার এস এম আশ্রাফুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ফেরিঘাটে চাঁদাবাজির কোনো অভিযোগ পাইনি। চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

রাবিতে রেজিস্ট্রার ও রাকসু জিএস আম্মারের বাগ্‌বিতণ্ডা ভাইরাল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের সঙ্গে রাকসু জিএস আম্মারের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। ছবি: স্ক্রিনশট
ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের সঙ্গে রাকসু জিএস আম্মারের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। ছবি: স্ক্রিনশট

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম ও বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) সাধারণ সম্পাদক (জিএস) সালাহউদ্দিন আম্মারের মধ্যে তীব্র বাগ্‌বিতণ্ডার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এ নিয়ে ক্যাম্পাসজুড়ে এখন আলোচনার ঝড়। গত রোববার (৯ নভেম্বর) দুপুরে প্রশাসন ভবনের রেজিস্ট্রারের কক্ষে এই ঘটনা ঘটে। রাতের মধ্যেই একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ক্যাম্পাস সরগরম হয়ে ওঠে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিতর্কটির সূত্রপাত দুটি কারণে। প্রথমত, সম্প্রতি চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক এনামুল হকের অপসারণের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছিল। রোববার দুপুর ১২টার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব ওই শিক্ষকের অব্যাহতির চিঠিতে সই করলেও, চিঠিটি রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে বিভাগে পাঠানোয় বিলম্ব হচ্ছিল বলে অভিযোগ ওঠে।

দ্বিতীয়ত, জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার অভিযোগ পান, রেজিস্ট্রার তাঁর কক্ষে ‘মহানগর বিএনপির’ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সভা করছেন।

এই দুটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়েই আম্মার রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে প্রবেশ করেন।

রেজিস্ট্রার ও জিএস-এর মধ্যে সরাসরি বাগ্‌বিতণ্ডায় শোনা যায়, রেজিস্ট্রার তাঁর কক্ষে অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করায় আম্মারকে বের হয়ে যেতে বলছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে যেসব বাগ্‌বিতণ্ডা দেখা যায়:

জিএস আম্মার: আমি স্যার ভেতরে আসব না?

রেজিস্ট্রার: তোমাকে আমি বাইরে ১০ মিনিট ওয়েট (অপেক্ষা) করতে বলেছি।

জিএস আম্মার: আপনি স্যার চিঠি (চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতিকে অপসারণের চিঠি) আটকে রাখছেন।

রেজিস্ট্রার (ক্ষুব্ধ হয়ে) : এই বেয়াদব ছেলে, কীসের চিঠি আটকে রাখছি আমি?

জিএস আম্মার: বেয়াদব তো আমি। ডেফিনেটলি বেয়াদব।

রেজিস্ট্রার: আমার সঙ্গে বেয়াদবি কেন? তুমি কে ওই ডিপার্টমেন্টের?

জিএস আম্মার: আমি কে মানে? আমি রাকসুর নির্বাচিত জিএস।

এ নিয়ে পরে সালাহউদ্দিন আম্মার সাংবাদিকদের জানান, রেজিস্ট্রার প্রায়ই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন এবং সেদিনও তাঁকে বারবার ‘গেট আউট’ বলে চিৎকার করেন। তিনি বলেন, কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, বরং দায়িত্বশীল জায়গা থেকে তিনি ঘটনাটি যাচাই করতে গিয়েছিলেন।

অন্যদিকে অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম অভিযোগ করেন, সালাহউদ্দিন আম্মার অনুমতি ছাড়াই তাঁর দপ্তরে ঢুকে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। তিনি দাবি করেন, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগে সভাপতি নিয়োগপ্রক্রিয়া চলমান ছিল, কোনো ফাইল আটকে রাখা হয়নি। তিনি প্রশ্ন তোলেন, শিক্ষার্থীসংক্রান্ত বিষয় হলেও প্রশাসনিক নিয়োগ নিয়ে রাকসু নেতাদের হস্তক্ষেপ করা অনুচিত।

এদিকে রেজিস্ট্রারের কক্ষে বিএনপির নেতা-কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করার অভিযোগ নিয়ে ক্যাম্পাসে চলছে রাজনৈতিক বিতর্ক। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) রাজশাহী মহানগর শাখার আহ্বায়ক মোবাশ্বের রাজ ফেসবুকে লিখেছেন, বাগ্‌বিতণ্ডার সময় সেখানে বিএনপির কেউ ছিলেন না, কেবল এনসিপি-এর নেতৃত্ব সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। তিনি অনুমান করেন, রেজিস্ট্রারের পিএস ভুলবশত এনসিপি নেতাদের ‘বিএনপির কর্মী’ ভেবে ভুল তথ্য দেন, যেখান থেকে ভুল–বোঝাবুঝি শুরু।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান আহমেদ (রাহী) এই ঘটনায় বিএনপির নাম জড়ানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘রেজিস্ট্রার অফিসে আম্মার ও শিক্ষক পরস্পরকে ধমকাচ্ছেন, অথচ বিএনপির নাম টেনে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। সেখানে বিএনপির কেউ ছিল না।’

এদিকে, এই ঘটনায় প্রশাসনের একাংশের মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) মোস্তাকুর রহমান (জাহিদ)। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘নির্বাচন–পরবর্তী সময়ে তাঁদের এ আচরণ পরিবর্তন হওয়াটা সমীচীন ছিল; কিন্তু এখনো প্রশাসনের কারও কারও আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা রাকসুর প্রতিনিধি নির্বাচিত করে তাঁদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছেন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ঐকমত্য কমিশনের কোনো আইনি বৈধতা নেই: ফরহাদ মজহার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
‘নতুন বাংলাদেশ গঠনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছেন ফরহাদ মজহার। ছবি: আজকের পত্রিকা
‘নতুন বাংলাদেশ গঠনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছেন ফরহাদ মজহার। ছবি: আজকের পত্রিকা

যেকোনো জাতীয় সনদে সুপারিশ ও বাস্তবায়নে তথাকথিত ঐকমত্য কমিশনের কোনো আইনি বৈধতা নেই বলে মন্তব্য করেছেন কবি ও দার্শনিক ফরহাদ মজহার। তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় সনদ সাংবিধানিক বৈধতা একমাত্র দিতে পারে গণপরিষদ বা গণভোট, যা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে।’

আজ সোমবার ‘নতুন বাংলাদেশ গঠনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ভিআইপি লাউঞ্জে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড পিস স্টাডিজ।

কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, ৫ তারিখে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলেও ৫ তারিখ থেকে ৮ তারিখের মধ্যে জনগণের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। এই গণ-অভ্যুত্থানের পর অবিলম্বে নতুন গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত ছিল।

নতুন রাষ্ট্র গঠন না হয়ে শেখ হাসিনার রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ফরহাদ মজহার।

তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণ এবং পুরোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে রক্ষা করার মাধ্যমে আন্দোলনকারীরা কার্যত ৮ তারিখেই পরাজিত হয়ে গেছেন। এই সময়টাতে শেখ হাসিনার রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা হয়েছে, নতুন রাষ্ট্র গঠন নয়।’

এ সময় সংবিধানকে ফেলে দিয়ে সংবিধানের পরিবর্তে গঠনতন্ত্র শব্দটি ব্যবহারের পক্ষে মত দেন তিনি।

গণতন্ত্র মানেই নির্বাচন নয় বলে উল্লেখ করে ফরহাদ মজহার বলেন, গণতন্ত্র মানে জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায় বাস্তবায়িত করা, গণতন্ত্র মানেই নির্বাচন নয়। জনগণ ক্ষমতার উৎস হলে ওই একবারই ভোট দেওয়ায় কি শেষ? নতুন রাষ্ট্র গঠনের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের দরকার। এই গণপরিষদেই সব সাংবিধানিক, আইনি এবং রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নের ফয়সালা করবে।

বর্তমান সরকারকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার না বলে উপদেষ্টা সরকার হিসেবে অভিহিত করেন ফরহাদ মজহার।

যদি পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হতো, তবে সেই সরকার তিনটি মূল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করত। এই নীতিগুলোকে জুলাই ঘোষণা হিসেবে উল্লেখ করে ফরহাদ মজহার বলেন, রাষ্ট্র বিদ্যমান আইনে চলবে, তবে যদি তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তবে মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে হবে। রাষ্ট্র এমন কোনো আইন বা নীতি প্রয়োগ করতে পারবে না, যা ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। রাষ্ট্র এমন কোনো আইন বা নীতি প্রণয়ন করতে পারে না, যা প্রাণ, প্রকৃতি এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নষ্ট করে।

ফরহাদ মজহার এই তিন নীতিকে প্রাধান্য দিয়ে অনেক বেশি পাতার পরিবর্তে এক পৃষ্ঠার নীতি বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করেন।

সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গে ফরহাদ মজহার বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর যে ক্ষমতা আসে, তাকে কনস্টিটুয়েন্ট পাওয়ার বা গাঠনিক ক্ষমতা বলে। এই ক্ষমতা বাংলাদেশের জনগণ অভ্যুত্থানের শক্তির কাছে সমর্পণ করেছিল। সেই শক্তি কীসের যুক্তিতে এই ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিল এটাই প্রশ্ন করেন তিনি।

তিনি বলেন, সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান করলে যেমন সংবিধান স্থগিত করে ফরমানের দ্বারা দেশ চালায়, তেমনি গণ-অভ্যুত্থানের পর জনগণেরও আদেশের দ্বারা দেশ চালানোর ক্ষমতা থাকা উচিত ছিল। ৫ তারিখে আন্দোলনের নেতৃত্ব যদি ঘোষণা করত যে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের আদেশে দেশ চলবে, তবে সেই প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করা হতো না।

সামরিক বাহিনীকে ধ্বংস করার চেষ্টার সমালোচনা করে ফরহাদ মজহার বলেন, র‍্যাব গঠনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর লোক এনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। যেসব সেনাসদস্য অপরাধ করেছেন, তাদের সামরিক আইনে (মিলিটারি কোর্টে) দ্রুত বিচার না করে সিভিল কোর্টে এনে পুরো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এই ধরনের বিচারিক প্রক্রিয়া, যেমন আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারকারী আদালত, প্রশ্নবিদ্ধ নয় কি? বরং অভিযুক্তদের বিচার না করতে সিভিল আইনে তাদের আনা হয়েছে বলে অভিযোগ তাঁর।

জুলাই বেহাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত একটি পক্ষকে দায়ী করে তাদের খুঁজে বের করার জোর দাবি জানান তিনি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সাংবাদিক পান্নার জামিনও আপিল বিভাগে বহাল

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
মঞ্জুরুল আলম পান্না। ছবি: আজকের পত্রিকা
মঞ্জুরুল আলম পান্না। ছবি: আজকের পত্রিকা

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নার জামিন বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। আজ সোমবার বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এই আদেশ দেন।

এর আগে সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী ও সাংবাদিক পান্নার করা পৃথক আবেদনের শুনানি শেষে গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি এ এস এম আবদুল মোবিন ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের বেঞ্চ রুলসহ জামিন দেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষ ওই দিনই হাইকোর্টের দেওয়া জামিন স্থগিত চেয়ে আবেদন করে চেম্বার আদালতে।

রোববার আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. রেজাউল হক রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন শুনানির জন্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠান। তারই ধারাবাহিকতায় আজ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে।

আজ আপিল বিভাগ প্রথমে লতিফ সিদ্দিকীর জামিন বহাল রাখলেও সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলমের জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন এক সপ্তাহের জন্য মুলতবি রাখা হয়। পরে অস্বাক্ষরিত আদেশ রিকল করে আবেদনটি খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।

লতিফ সিদ্দিকীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না। আর মঞ্জুরুল আলমের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন।

গত ২৮ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান নিয়ে এক আলোচনা সভায় অংশ নিতে গেলে লতিফ সিদ্দিকী ও সাংবাদিক পান্নাসহ ১৬ জনকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। পরদিন তাদের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আইনি স্বীকৃতিসহ ১৫ দফা দাবিতে রাজধানীতে বাকপ্রতিবন্ধীদের অবস্থান কর্মসূচি-র‍্যালি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
পল্টন এলাকা থেকে একটি মিছিল শুরু করে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নেন শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
পল্টন এলাকা থেকে একটি মিছিল শুরু করে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নেন শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

আইনগত স্বীকৃতি ও সুরক্ষাসহ ১৫ দফা দাবি নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধীরা। আজ সোমবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয় বধির ঐক্য পরিষদ ব্যানারে এ অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন তাঁরা। এর আগে পল্টন এলাকা থেকে একটি মিছিল শুরু করে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা।

লিখিত বক্তব্যে শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধীরা জানান, প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন ২০১৩-এ শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী শব্দের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ‘বধির’ ব্যবহার করতে হবে। বাকপ্রতিবন্ধীদের মালিকানাধীন সম্পত্তি রক্ষায় বিরোধ মামলার জন্য ৫০ শতাংশ খরচ মওকুফ করতে হবে। জাতীয় সংসদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য মোট পাঁচ শতাংশ সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ এবং শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথকভাবে দুই শতাংশ কোটা নিশ্চিত করতে হবে।

তাঁরা আরও জানান, শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক আবাসিক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও কার্যকরীকরণ নিশ্চিত এবং শিক্ষকদের জন্য ইশারা ভাষায় প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এছাড়া প্রশিক্ষণ ও শিক্ষক নিয়োগ, আর্থিক ভাতা ও সহায়তা, কর্মসংস্থান ও কোটা, বাসস্থান ও ভূমি সংক্রান্ত সুবিধাসহ ১৫ দাবি জানান তাঁরা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত