মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
দেশে চার দশকের বেশি সময় ধরে সংক্রামক রোগ অ্যানথ্রাক্সের (তড়কা রোগ) সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে মূলত উত্তরাঞ্চলসহ সব মিলিয়ে ১৬টি জেলায় রোগটির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। সম্প্রতি উত্তরাঞ্চলের রংপুর ও গাইবান্ধায় গবাদিপশুর মধ্যে রোগটি শনাক্ত হয়েছে। রংপুরে মানবদেহেও কয়েকটি সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে।
অ্যানথ্রাক্সের সাম্প্রতিক বিস্তার নিয়ে উপদ্রুত এলাকার প্রান্তিক মানুষের মধ্যে উদ্বেগ দেখা গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা অভয় দিয়ে বলছেন, গবাদিপশুকে টিকা দেওয়া এবং মানুষের আচরণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।
সংক্রমণের ইতিহাস
অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি রোগ। গবাদিপশুর মধ্যে বহু আগে থেকেই এটি হয়ে আসছে। রোগটি প্রাণী থেকে প্রাণী বা মানুষ থেকে মানুষে সহজেই সংক্রমিত হয় না। সংক্রমণ ঘটে তখনই যখন জীবাণুর স্পোর বা ‘বীজ’ মুখ, শ্বাসনালি বা ত্বকের ক্ষত দিয়ে দেহে প্রবেশ করে।
বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল থেকে গবাদিপশু এবং তা থেকে মানুষের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়। রোগটি প্রথম শনাক্ত হয়েছিল পাবনা জেলায়। পরে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, রাজশাহী, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, বগুড়া, সাতক্ষীরা, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, রাজবাড়ী ও চট্টগ্রামে সংক্রমণ দেখা গেছে। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) রিপোর্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী ‘হিলিয়ন’ ও সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী ‘ফ্রন্টিয়ার্স’-এর গবেষণায় এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯৮০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত ২৭টি প্রবন্ধের তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি করা একটি গবেষণাপত্র মার্কিন বিজ্ঞান সাময়িকী হিলিয়নে প্রকাশিত হয়েছে। ‘অ্যানিমেল, হিউম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল পারস্পেকটিভ অব অ্যানথ্রাক্স ইন বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের প্রাণিজ, মানব ও পরিবেশগত দিক) শিরোনামের গবেষণাটিতে বলা হয়, ১৯৮০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬ হাজারের বেশি পশু আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ মারা গেছে। এতে বলা হয়, মানুষের অ্যানথ্রাক্স সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় আক্রান্ত প্রাণী জবাই করা এবং তার মাংস কাটার সময় কাঁচা মাংস বা রক্তের সংস্পর্শে আসা। মৃত পশু জলাশয়ে ফেলাসহ বিভিন্নভাবে পরিবেশে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু ছড়ায়।
নিয়ন্ত্রণে ‘ওয়ান হেলথ’ পদ্ধতি
সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা বলেছেন, অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ‘ওয়ান হেলথ’ পদ্ধতি প্রয়োজন। এই পদ্ধতিতে শুধু পশুর টিকাদানই নয়, মানুষের সামাজিক আচরণ ও জীবনাচারের পরিবর্তন, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা এবং নিয়মিত নজরদারি কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত থাকে। এর মাধ্যমে রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে সমন্বিত কার্যক্রম চালানো সম্ভব হয়।
হিলিয়নের গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রাণী ও মানুষের উভয়ের ক্ষেত্রে সংক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের শরীরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কিউটেনিয়াস অ্যানথ্রাক্স (ত্বকের অ্যানথ্রাক্স) শনাক্ত হয়েছে। বিশেষ করে পরিবেশগত, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক কারণে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও মেহেরপুরের প্রাণী ও মানুষ উভয়ই সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই চার জেলার পাশাপাশি কুষ্টিয়া ও রাজশাহীকে অ্যানথ্রাক্সপ্রবণ এলাকা বলা হয়। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামে একাধিক প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।
সংক্রমণ ছড়ানোর কারণ
উল্লিখিত গবেষণায় বলা হয়েছে, গবাদিপশুতে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ বাড়ার মূল কারণ হলো কম টিকাদান, টিকার অপর্যাপ্ত সরবরাহ, দূষিত ঘাস বা পানি খাওয়া, সঠিকভাবে চিকিৎসা না হওয়া এবং মৃত প্রাণিদেহ সঠিকভাবে পুঁতে না ফেলা। মানুষের অ্যানথ্রাক্স সাধারণত প্রাণীর সংক্রমণের পর ঘটে। আক্রান্ত প্রাণী জবাই এবং তার কাঁচা মাংস, রক্ত, চামড়া ও অন্যান্য প্রাণিজ উপকরণের সংস্পর্শে এলে মানুষের সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। অসুস্থ প্রাণী জবাই করা ব্যক্তির সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ২২ গুণ বেশি। কাঁচা মাংস ব্যবস্থাপনায় যুক্তদের ঝুঁকি প্রায় দুই গুণ বেশি। মৃতদেহ বা প্রাণিজ বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে পরিবেশে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু দীর্ঘ সময় বিচরণ করতে পারে।
ওপরের গবেষণাপত্রের মুখ্য গবেষক ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. শেখ শাহিনুর ইসলাম বলেন, ‘অ্যানথ্রাক্সের ঝুঁকি পরিবেশ, প্রাণী ও মানুষের সংযোগে নিহিত। মাটি থেকে প্রাণী সংক্রমিত হয়, প্রাণীর মাধ্যমে মানুষে ছড়ায়। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের যমুনা অববাহিকা এলাকার মাটিতে এ জীবাণুর ঘনত্ব বেশি থাকতে পারে। এটি প্রতিরোধের মূল উপায় প্রাণীকে টিকাদান, সচেতনতা বৃদ্ধি, আচরণ পরিবর্তন এবং দ্রুত চিকিৎসা।’
মানব সংক্রমণ বেশি ছিল মেহেরপুরে
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী ফ্রন্টিয়ার্সে ‘রিস্ক ফ্যাক্টরস অ্যাসোসিয়েটেড উইথ কিউটেনিয়াস অ্যানথ্র্যাক্স আউটব্রেক ইন হিউম্যানস ইন বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে ত্বকের অ্যানথ্রাক্স ছড়ানোর ক্ষেত্রে ঝুঁকিগুলো) শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সন্দেহভাজন রোগীর মধ্যে ৬১ শতাংশই মেহেরপুরে। আক্রান্তদের বেশির ভাগই পশুপালন ও ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ছিলেন। ২০১৯ সালে পূর্ববর্তী প্রাদুর্ভাবের ভিত্তিতে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মেহেরপুর, টাঙ্গাইল ও রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় জোরদার নজরদারি চালানো হয়। ২০২০ সাল থেকে অধিকাংশ মানব সংক্রমণের তথ্য আসে মেহেরপুর জেলা থেকে। ২০২৩ সালে ৬৫৫ জন সন্দেহভাজন রোগীর শরীরের ১৪২টি নমুনা পরীক্ষা করে ৭৮টিতে রোগটি শনাক্ত হয়। সে বছরের প্রায় সব মানব সংক্রমণ পাওয়া যায় মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায়। এ ছাড়া ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ১৬টি জেলায় আড়াই হাজার সন্দেহভাজন রোগীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. তাহমিনা শিরীন গত রোববার আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন, এবার রংপুরের বিভিন্ন উপজেলার মানুষের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পীরগাছা থেকে ১২টি, কাউনিয়া থেকে ৪টি ও মিঠাপুকুর থেকে ৫টি—মোট ২১টি নমুনার মধ্যে ১১টিতেই পজিটিভ ধরা পড়েছে।
ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, নমুনার তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সরবরাহ করা হয়েছে। গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান এবং কমিউনিটি সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর টিকা কার্যক্রম চালাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
মানুষের অ্যানথ্র্যাক্সের তিন ধরন
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, মানুষের শরীরে অ্যানথ্রাক্স মূলত তিন ধরনের হয়—ত্বকের, পাচনতন্ত্রের ও শ্বাসনালির অ্যানথ্রাক্স। ত্বকের অ্যানথ্রাক্স সবচেয়ে সাধারণ। প্রায় ৯৫ শতাংশ সংক্রমণই এই ধরনের। যথাযথ অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে রোগী সুস্থ হয়ে যায়। এতে মৃত্যুর আশঙ্কা কম। পাচনতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণ ঘটে আক্রান্ত পশুর মাংস খাওয়ার মাধ্যমে। এতে মৃত্যুর হার ২৫ থেকে ৭৫ শতাংশ। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এই ধরনের সংক্রমণের ঘটনা পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়নি। শ্বাসনালির অ্যানথ্রাক্স অত্যন্ত বিরল ও মারাত্মক। প্রাথমিকভাবে এর উপসর্গ সর্দিজ্বরের মতো। সাময়িক স্বস্তির পর রোগী দ্রুত জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও শকে আক্রান্ত হয়। প্রথম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা দেওয়া না হলে মৃত্যুর হার প্রায় ৯৫ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও কর্তৃপক্ষের কথা
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন জানান, দেশে অ্যানথ্রাক্সে গবাদিপশুর মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেলেও মানুষের মৃত্যুর হার এখনো স্পষ্ট নয়। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে রোগটি ছড়ানো প্রতিরোধের জন্য অসুস্থ পশু জবাই এড়ানো, শরীরে কোনো ক্ষত থাকলে তা ঢেকে রাখা এবং পশুর টিকাদান ইত্যাদি জরুরি। যাঁরা পশুর মাংস কাটাকাটি করেন, তাঁদের সচেতনতা তথা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। মুশতাক হোসেনও ‘ওয়ান হেলথ’ কৌশলের তাগিদ দেন, যেখানে প্রাণী, মানুষ ও পরিবেশের সংযোগ বিবেচনা করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. হালিমুর রশিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং সিভিল সার্জনরা তথ্য সংগ্রহ করছেন এবং সতর্কতা অবলম্বন করছেন। গাইডলাইন অনুযায়ী রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর পশুকে টিকা দিচ্ছে।
দেশে চার দশকের বেশি সময় ধরে সংক্রামক রোগ অ্যানথ্রাক্সের (তড়কা রোগ) সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে মূলত উত্তরাঞ্চলসহ সব মিলিয়ে ১৬টি জেলায় রোগটির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। সম্প্রতি উত্তরাঞ্চলের রংপুর ও গাইবান্ধায় গবাদিপশুর মধ্যে রোগটি শনাক্ত হয়েছে। রংপুরে মানবদেহেও কয়েকটি সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে।
অ্যানথ্রাক্সের সাম্প্রতিক বিস্তার নিয়ে উপদ্রুত এলাকার প্রান্তিক মানুষের মধ্যে উদ্বেগ দেখা গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা অভয় দিয়ে বলছেন, গবাদিপশুকে টিকা দেওয়া এবং মানুষের আচরণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।
সংক্রমণের ইতিহাস
অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি রোগ। গবাদিপশুর মধ্যে বহু আগে থেকেই এটি হয়ে আসছে। রোগটি প্রাণী থেকে প্রাণী বা মানুষ থেকে মানুষে সহজেই সংক্রমিত হয় না। সংক্রমণ ঘটে তখনই যখন জীবাণুর স্পোর বা ‘বীজ’ মুখ, শ্বাসনালি বা ত্বকের ক্ষত দিয়ে দেহে প্রবেশ করে।
বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল থেকে গবাদিপশু এবং তা থেকে মানুষের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়। রোগটি প্রথম শনাক্ত হয়েছিল পাবনা জেলায়। পরে সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, রাজশাহী, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, বগুড়া, সাতক্ষীরা, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, রাজবাড়ী ও চট্টগ্রামে সংক্রমণ দেখা গেছে। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) রিপোর্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী ‘হিলিয়ন’ ও সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী ‘ফ্রন্টিয়ার্স’-এর গবেষণায় এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯৮০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত ২৭টি প্রবন্ধের তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি করা একটি গবেষণাপত্র মার্কিন বিজ্ঞান সাময়িকী হিলিয়নে প্রকাশিত হয়েছে। ‘অ্যানিমেল, হিউম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল পারস্পেকটিভ অব অ্যানথ্রাক্স ইন বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের প্রাণিজ, মানব ও পরিবেশগত দিক) শিরোনামের গবেষণাটিতে বলা হয়, ১৯৮০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬ হাজারের বেশি পশু আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ মারা গেছে। এতে বলা হয়, মানুষের অ্যানথ্রাক্স সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় আক্রান্ত প্রাণী জবাই করা এবং তার মাংস কাটার সময় কাঁচা মাংস বা রক্তের সংস্পর্শে আসা। মৃত পশু জলাশয়ে ফেলাসহ বিভিন্নভাবে পরিবেশে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু ছড়ায়।
নিয়ন্ত্রণে ‘ওয়ান হেলথ’ পদ্ধতি
সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা বলেছেন, অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ‘ওয়ান হেলথ’ পদ্ধতি প্রয়োজন। এই পদ্ধতিতে শুধু পশুর টিকাদানই নয়, মানুষের সামাজিক আচরণ ও জীবনাচারের পরিবর্তন, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা এবং নিয়মিত নজরদারি কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত থাকে। এর মাধ্যমে রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে সমন্বিত কার্যক্রম চালানো সম্ভব হয়।
হিলিয়নের গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রাণী ও মানুষের উভয়ের ক্ষেত্রে সংক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের শরীরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কিউটেনিয়াস অ্যানথ্রাক্স (ত্বকের অ্যানথ্রাক্স) শনাক্ত হয়েছে। বিশেষ করে পরিবেশগত, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক কারণে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও মেহেরপুরের প্রাণী ও মানুষ উভয়ই সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই চার জেলার পাশাপাশি কুষ্টিয়া ও রাজশাহীকে অ্যানথ্রাক্সপ্রবণ এলাকা বলা হয়। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামে একাধিক প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।
সংক্রমণ ছড়ানোর কারণ
উল্লিখিত গবেষণায় বলা হয়েছে, গবাদিপশুতে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ বাড়ার মূল কারণ হলো কম টিকাদান, টিকার অপর্যাপ্ত সরবরাহ, দূষিত ঘাস বা পানি খাওয়া, সঠিকভাবে চিকিৎসা না হওয়া এবং মৃত প্রাণিদেহ সঠিকভাবে পুঁতে না ফেলা। মানুষের অ্যানথ্রাক্স সাধারণত প্রাণীর সংক্রমণের পর ঘটে। আক্রান্ত প্রাণী জবাই এবং তার কাঁচা মাংস, রক্ত, চামড়া ও অন্যান্য প্রাণিজ উপকরণের সংস্পর্শে এলে মানুষের সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। অসুস্থ প্রাণী জবাই করা ব্যক্তির সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ২২ গুণ বেশি। কাঁচা মাংস ব্যবস্থাপনায় যুক্তদের ঝুঁকি প্রায় দুই গুণ বেশি। মৃতদেহ বা প্রাণিজ বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে পরিবেশে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু দীর্ঘ সময় বিচরণ করতে পারে।
ওপরের গবেষণাপত্রের মুখ্য গবেষক ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. শেখ শাহিনুর ইসলাম বলেন, ‘অ্যানথ্রাক্সের ঝুঁকি পরিবেশ, প্রাণী ও মানুষের সংযোগে নিহিত। মাটি থেকে প্রাণী সংক্রমিত হয়, প্রাণীর মাধ্যমে মানুষে ছড়ায়। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের যমুনা অববাহিকা এলাকার মাটিতে এ জীবাণুর ঘনত্ব বেশি থাকতে পারে। এটি প্রতিরোধের মূল উপায় প্রাণীকে টিকাদান, সচেতনতা বৃদ্ধি, আচরণ পরিবর্তন এবং দ্রুত চিকিৎসা।’
মানব সংক্রমণ বেশি ছিল মেহেরপুরে
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বৈজ্ঞানিক সাময়িকী ফ্রন্টিয়ার্সে ‘রিস্ক ফ্যাক্টরস অ্যাসোসিয়েটেড উইথ কিউটেনিয়াস অ্যানথ্র্যাক্স আউটব্রেক ইন হিউম্যানস ইন বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে ত্বকের অ্যানথ্রাক্স ছড়ানোর ক্ষেত্রে ঝুঁকিগুলো) শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সন্দেহভাজন রোগীর মধ্যে ৬১ শতাংশই মেহেরপুরে। আক্রান্তদের বেশির ভাগই পশুপালন ও ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ছিলেন। ২০১৯ সালে পূর্ববর্তী প্রাদুর্ভাবের ভিত্তিতে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মেহেরপুর, টাঙ্গাইল ও রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় জোরদার নজরদারি চালানো হয়। ২০২০ সাল থেকে অধিকাংশ মানব সংক্রমণের তথ্য আসে মেহেরপুর জেলা থেকে। ২০২৩ সালে ৬৫৫ জন সন্দেহভাজন রোগীর শরীরের ১৪২টি নমুনা পরীক্ষা করে ৭৮টিতে রোগটি শনাক্ত হয়। সে বছরের প্রায় সব মানব সংক্রমণ পাওয়া যায় মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায়। এ ছাড়া ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ১৬টি জেলায় আড়াই হাজার সন্দেহভাজন রোগীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. তাহমিনা শিরীন গত রোববার আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন, এবার রংপুরের বিভিন্ন উপজেলার মানুষের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পীরগাছা থেকে ১২টি, কাউনিয়া থেকে ৪টি ও মিঠাপুকুর থেকে ৫টি—মোট ২১টি নমুনার মধ্যে ১১টিতেই পজিটিভ ধরা পড়েছে।
ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, নমুনার তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সরবরাহ করা হয়েছে। গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান এবং কমিউনিটি সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর টিকা কার্যক্রম চালাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
মানুষের অ্যানথ্র্যাক্সের তিন ধরন
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, মানুষের শরীরে অ্যানথ্রাক্স মূলত তিন ধরনের হয়—ত্বকের, পাচনতন্ত্রের ও শ্বাসনালির অ্যানথ্রাক্স। ত্বকের অ্যানথ্রাক্স সবচেয়ে সাধারণ। প্রায় ৯৫ শতাংশ সংক্রমণই এই ধরনের। যথাযথ অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে রোগী সুস্থ হয়ে যায়। এতে মৃত্যুর আশঙ্কা কম। পাচনতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণ ঘটে আক্রান্ত পশুর মাংস খাওয়ার মাধ্যমে। এতে মৃত্যুর হার ২৫ থেকে ৭৫ শতাংশ। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এই ধরনের সংক্রমণের ঘটনা পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়নি। শ্বাসনালির অ্যানথ্রাক্স অত্যন্ত বিরল ও মারাত্মক। প্রাথমিকভাবে এর উপসর্গ সর্দিজ্বরের মতো। সাময়িক স্বস্তির পর রোগী দ্রুত জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও শকে আক্রান্ত হয়। প্রথম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা দেওয়া না হলে মৃত্যুর হার প্রায় ৯৫ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও কর্তৃপক্ষের কথা
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন জানান, দেশে অ্যানথ্রাক্সে গবাদিপশুর মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেলেও মানুষের মৃত্যুর হার এখনো স্পষ্ট নয়। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে রোগটি ছড়ানো প্রতিরোধের জন্য অসুস্থ পশু জবাই এড়ানো, শরীরে কোনো ক্ষত থাকলে তা ঢেকে রাখা এবং পশুর টিকাদান ইত্যাদি জরুরি। যাঁরা পশুর মাংস কাটাকাটি করেন, তাঁদের সচেতনতা তথা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। মুশতাক হোসেনও ‘ওয়ান হেলথ’ কৌশলের তাগিদ দেন, যেখানে প্রাণী, মানুষ ও পরিবেশের সংযোগ বিবেচনা করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. হালিমুর রশিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং সিভিল সার্জনরা তথ্য সংগ্রহ করছেন এবং সতর্কতা অবলম্বন করছেন। গাইডলাইন অনুযায়ী রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর পশুকে টিকা দিচ্ছে।
পরিত্যক্ত ভবনে ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসাসেবা, অতিরিক্ত রোগীর চাপ, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন সংকটে ভুগছে জামালপুরের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল। এ অবস্থায় নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনেরা। এদিকে পরিত্যক্ত ভবন এবং অতিরিক্ত রোগীর চাপে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
৩ ঘণ্টা আগেবয়স কম, স্বপ্নও কাঁচা—তবু গলায় মালা, কপালে সিঁদুর। দারিদ্র্য, অনিরাপত্তা আর সামাজিক চাপে বাল্যবিবাহ যেন থামছেই না। কিশোরী থাকতেই হচ্ছে শিশুর মা। বই-খাতা নয়, কোলে এখন শিশু। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গ্রামগঞ্জে এমন দৃশ্য এখনো সাধারণ বিষয়। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি, প্রশাসনের অভিযান...
৩ ঘণ্টা আগেফেনীতে আট বছরের এক শিশুকে গলা টিপে হত্যার দায়ে অপর এক শিশুকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। সোমবার (৬ অক্টোবর) বিকেলে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এন এম মোর্শেদ খান আসামির উপস্থিতিতে এ রায় ঘোষণা করেন।
৩ ঘণ্টা আগেরাজধানীর লালবাগ এলাকায় রাস্তার ওপর সবজি, মাছ, মুরগি ইত্যাদির দোকান বসিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জনদুর্ভোগ সৃষ্টির অভিযোগে ছয়জনকে সড়ক পরিবহন আইনে ৫ দিনের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেছেন আদালত। এ ছাড়া মিটফোর্ড হাসপাতালে এক নারী রোগীর ব্যাগ থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকা চুরির অভিযোগে এক নারীকে তিন মাসের সশ্রম...
৪ ঘণ্টা আগে