Ajker Patrika

রাজশাহী নগর: শহরের বর্জ্যে বিষাক্ত বারনই নদ

  • প্রায় তিন লাখ মানুষ জটিল চর্মরোগে আক্রান্ত— জরিপের ফল।
  • ঝুঁকিতে পড়েছে নদের জীববৈচিত্র্য।
  • বিপন্ন জেলে সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকা।
নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী
খাল হয়ে রাজশাহী শহরের বর্জ্যমিশ্রিত পানি চলে যাচ্ছে বারনই নদে। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। সম্প্রতি রাজশাহীর পবা উপজেলার পাকুড়িয়া এলাকায়। ছবি: আজকের পত্রিকা
খাল হয়ে রাজশাহী শহরের বর্জ্যমিশ্রিত পানি চলে যাচ্ছে বারনই নদে। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। সম্প্রতি রাজশাহীর পবা উপজেলার পাকুড়িয়া এলাকায়। ছবি: আজকের পত্রিকা

রাজশাহী শহরের বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে বারনই নদ। নদের পানি ব্যবহার করায় চর্মসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ছোঁয়াচে হওয়ায় অনেক রোগ ছড়াচ্ছে দ্রুত। রাজশাহীর ‘বাঁচার আশা সাংস্কৃতিক সংগঠন’ রাজশাহী ও নাটোরের সাতটি উপজেলায় সম্প্রতি জরিপ চালিয়ে এমন তথ্য পেয়েছে।

সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, বারনই নদের বিষাক্ত পানির কারণে শিশু-বৃদ্ধসহ প্রায় তিন লাখ মানুষ জটিল চর্মরোগে আক্রান্ত। তারা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট আরও বেড়েছে। পাশাপাশি ঝুঁকিতে পড়েছে নদের জীববৈচিত্র্য। নদের মাছ মারা যাচ্ছে। বিপন্ন হয়ে পড়েছে জেলে সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকা।

সরেজমিন দেখা গেছে, রাজশাহী শহরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অপরিশোধিত বর্জ্য, বিসিক শিল্প এলাকার বর্জ্য, বিভিন্ন কলকারখানার রাসায়নিকমিশ্রিত পানি, গৃহস্থালি বর্জ্য এবং পয়োনিষ্কাশনের বিষাক্ত পানি সরাসরি সিটি হাটের পাশের ড্রেন, পবা উপজেলার দুয়ারি খাল, পবা গাঙ্গপাড়া ও বায়া-মহনন্দখালী খালের মাধ্যমে নওহাটায় গিয়ে বারনই নদে মিশছে। ফলে নদের পানি ভয়াবহভাবে দূষিত হচ্ছে।

এই নদের পানি ব্যবহার করে রাজশাহী ও নাটোর জেলার নদপারের গ্রামগুলোর মানুষ দাদ, ফাঙ্গাস, স্ক্যাবিস, খোসপাঁচড়া, শুকনো চুলকানি, চর্মদল ও জকইচসহ নানা জটিল চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় দিনের পর দিন এসব চর্মরোগ শরীরেই থেকে যাচ্ছে। অনেক মানুষ দিনের পর দিন কষ্ট সহ্য করছে। এমনকি ছোঁয়াচে হওয়ায় অনেক রোগ ছড়াচ্ছে অন্যদের মধ্যে।

রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার বিভিন্ন মহল্লার মানুষ নানা ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত। পৌরসভার পুঠিয়াপাড়া এলাকার ভ্যানচালক শাহীন আলম জানান, মহল্লায় পাঁচ শতাধিক মানুষ চর্মরোগে আক্রান্ত। তিনি বলেন, ‘এক বছর ধরে আমি এবং আমার বাড়ির তিনজন দাদে আক্রান্ত। সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, টাকাও খরচ হয়েছে, কিন্তু ভালো হয়নি। আমার পাশের বাড়ির হেলালের বাড়ির নয়জনেরও একই অবস্থা। ছোট্ট একটা শিশু রাহুল, সে-ও ছয় মাস ধরে ভুগছে।’

বারনইয়ের সঙ্গে যুক্ত তানোরের শিব নদের পানিও এখন দূষিত হয়ে পড়ছে। তানোরের বাসিন্দা মোস্তফা সরকার বলেন, ‘শিব নদে এক মাস গোসল করার পর আমি ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হই। অনেক চিকিৎসা করিয়েও ভালো হইনি। ভীষণ রকমের যন্ত্রণা হয়।’

নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী জানান, বারনই নদের উৎপত্তি নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার আত্রাই নদ থেকে। এটি মান্দার বিল ও তানোরের শিব নদ পেরিয়ে রাজশাহীর পবা উপজেলার শিতলাই এলাকায় জামদহ নদীতে মিশেছে। এরপর নওহাটা এলাকায় এটি বারনই নামে পরিচিতি পেয়েছে। বারনই রাজশাহীর পবা, মোহনপুর, দুর্গাপুর, বাগমারা এবং নাটোরের নলডাঙ্গা ও সিংড়া উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলনবিলে গিয়ে মিশেছে।

নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার বাঁশিলা ইসলাপাড়ার বাসিন্দা রুবিনা বেগম বলেন, ‘আমার বাড়ির ছয়জন প্রায় দেড় বছর ধরে চর্মরোগে আক্রান্ত। আশপাশের মানুষেরও এটা আছে। ওষুধে কাজ হচ্ছে না।’

বাঁচার আশা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা বিজলী বলেন, ‘শুধু পবা উপজেলার নওহাটা এলাকার নিম্ন আয়ের কয়েক হাজার মানুষ বিভিন্ন চর্মরোগে আক্রান্ত। আমরা গত ১৯ আগস্ট একটি স্বাস্থ্য ক্যাম্পের মাধ্যমে ৫০ জনকে চিকিৎসা দিয়েছি। এটা আক্রান্তের তুলনায় অতি সামান্য।’

রাজশাহীর সিভিল সার্জন এস আই এম রাজিউল করিম বলেন, ‘বারনই নদের পানি ব্যবহার ও ওই নদের মাছ খাওয়ার কারণে মানুষ চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। প্রয়োজনে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য ক্যাম্প পরিচালনা করা হবে। আপাতত এই পানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।’

এদিকে দূষণের কারণে জেলে সম্প্রদায়ের জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সিংড়া উপজেলার শেরকোল এলাকার জেলে আবদুল আলিম বলেন, ‘বছর কয়েক ধরে বিষাক্ত পানির কারণে মাছ মরে যাচ্ছে। আগে নদের মাছ ধরে সংসার চলত, এখন হয় না। তাই পাঁচ বছর ধরে ভ্যান চালাই।’

নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশন ও ওয়াসাকে বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় দেখা দেবে। ইতিমধ্যে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে। জীববৈচিত্র্যও পড়েছে ঝুঁকিতে। এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।

রাজশাহী ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী পারভেজ মাসুদ বলেন, ‘মানুষকে চর্মরোগ থেকে বাঁচাতে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমরা বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছি।’

আর সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আহমদ আল মঈন জানিয়েছেন, রাজশাহী শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন একটি প্রকল্প প্রণয়ন পর্যায়ে আছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

৭৫ কোটি টাকার কর ফাঁকি: এনবিআর কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর

ধর্ষণের আলামত নষ্ট, ধুনট থানার সাবেক ওসির বিরুদ্ধে পরোয়ানা

হিমাগারে ডেকে নির্যাতন: রাজশাহীতে আ.লীগ নেতার তিন ছেলে-মেয়ের জামিন, পুলিশের ‘দুর্বল’ ভূমিকা

ফার্মগেটে হলিক্রস কলেজ ও চার্চের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ

যাদের একাধিক দেশের পাসপোর্ট আছে, তারাই অন্যদের সেফ এক্সিটের তালিকা করে: আসিফ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত