Ajker Patrika

ঋণের ফাঁদে রাজশাহী

বাঁচতে গিয়ে মরছে মানুষ

  • গ্রামের ২৫০ বাড়ির দু-চারটি ছাড়া সবারই কোথাও না কোথাও ঋণ আছে: বাসিন্দা
  • আত্মহত্যা করা এক কৃষকের বাড়ি থেকে ১৮টি এনজিওর পাসবই উদ্ধার।
  • কিস্তি দিতে এক দিন দেরি হলে এনজিওর লোকেরা এসে বসে থাকেন: ঋণগ্রহীতা
  • কিস্তি আদায়ে কাউকেই আমরা চাপ দিই না: এনজিও কর্তা
 রিমন রহমান, রাজশাহী
একই পরিবারের চারজনের মৃত্যুতে স্বজনদের কান্না। ছবি: আজকের পত্রিকা
একই পরিবারের চারজনের মৃত্যুতে স্বজনদের কান্না। ছবি: আজকের পত্রিকা

ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে রাজশাহীর নিম্ন আয়ের মানুষ। চারদিক থেকে অভাব-অনটনে ঘিরে ধরা মানুষগুলো বাঁচার আশায় ঋণ নিচ্ছেন। কেউ চড়া সুদে নিচ্ছেন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে, কেউ সুদের কারবারি কিংবা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে। একসময় এই ঋণই অনেকের বোঝায় পরিণত হচ্ছে, যা তাঁদের ঠেলে দিচ্ছে হতাশা আর মৃত্যুর দিকে। বাঁচার জন্য ঋণ নিলেও তার কারণেই ঝরছে কারও কারও প্রাণ।

সম্প্রতি পরপর কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে ঋণের বিষয়টিই উঠে এসেছে। ঋণের কারণে স্ত্রী, ছেলে ও শিশুকন্যাকে হত্যার পর রাজশাহীর পবার বামনশিখর গ্রামের মিনারুল ইসলামের আত্মহত্যার ঘটনা সবাইকেই ভাবিয়ে তুলেছে। ওই এলাকার বেশির ভাগ মানুষই কোনো না কোনো সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছেন। তাঁরাও ঋণের কারণে চাপের কথা বলছেন। তবে এ দাবি অস্বীকার করেছেন এনজিওর কর্মকর্তারা।

একের পর এক মৃত্যু

ঋণের চাপে আত্মহত্যার ঘটনায় সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে সম্প্রতি এমন ঘটনা বেশি দেখা যাচ্ছে। ১৫ আগস্ট সকালে পবার বামনশিখর গ্রামের মিনারুল ইসলাম (৩০), তাঁর স্ত্রী মনিরা বেগম (২৮), ছেলে মাহিন (১৩) ও মেয়ে মিথিলার (৩) লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘরে মেলে মিনারুলের লিখে যাওয়া দুই পাতার চিরকুট। এতে তিনি লিখে যান, ঋণের চাপে ও খাবারের অভাবে তিনি একে একে মনিরা, মাহিন ও ছোট্ট মিথিলাকে হত্যার পর নিজে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই গত সোমবার মোহনপুর উপজেলার খাড়ইল গ্রামের পানবরজে আকবর শাহ (৫০) নামের এক কৃষকের ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়। তিনিও ঋণগ্রস্ত ছিলেন।

মোহনপুরের বেলনা গ্রামের রিকশাচালক ফজলুর রহমানও (৫৫) জর্জরিত ছিলেন ঋণে। ১৪ আগস্ট রাতে এলাকায় তাঁকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে পরদিন তাঁর মৃত্যু হয়। স্বজনদের দাবি, ২০২২ সালে কেশরহাট এলাকার সুদের কারবারি ধুলু মিয়ার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন ফজলুর। সুদসহ ৪৩ হাজার টাকা শোধ করলেও আরও টাকা দাবি করছিলেন ধুলু। তাঁদের অভিযোগ, টাকা না দেওয়ায় ধুলু মিয়াসহ কয়েকজন ফজলুরকে খুন করেছেন।

ঘরে ঘরে ঋণ

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার গোবিন্দপাড়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শহিদুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার নিজের গ্রাম গোবিন্দপাড়া। এই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ঋণগ্রস্ত। ধরতে গেলে এই হার ১ টাকার ভেতর ১২ আনা (৭৫ শতাংশ)। ৪ আনা কম থাকতে পারে। মানুষ তো গরিব, ঋণ না নিয়ে উপায় থাকে না। কিন্তু একবার ঋণ নিলে তা শোধ হয় না।’

ঋণের চাপে স্ত্রী-সন্তানদের হত্যার পর আত্মহত্যা করা মিনারুলের গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই ঋণগ্রস্ত। এই গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘গোটা গ্রামে প্রায় ২৫০ বাড়ি আছে। দু-চার বাড়ি হয়তো পাওয়া যাবে, তাদের ঋণ নাই। বাকি সবারই কোথাও না কোথাও ঋণ আছে।’

মিনারুলের ঋণ ছিল বেসরকারি সংস্থা টিএমএসএসে। সংস্থার খড়খড়ি শাখার ব্যবস্থাপক মশিউর রহমান বলেন, ‘বামনশিখরে আমাদের সদস্য আছে প্রায় ৮০ জন। মিনারুলের আর অল্প কিছু টাকা বাকি ছিল। সে জন্য তাঁকে চাপাচাপি করা হয়নি। কাউকেই আমরা চাপ দেই না।’

ঋণ থাকলেও ঋণ

দুর্গাপুরে আত্মহত্যা করা কৃষক রেন্টু পাইকের বাড়ি থেকে ১৮টি এনজিওর পাসবই উদ্ধার করেছিল পুলিশ। এর মধ্যে অর্ধেকের ঋণ পরিশোধ থাকলেও বাকিগুলোর ঋণ চলমান ছিল। গত সোমবার মোহনপুরে আত্মহত্যা করা পানচাষি আকবর শাহের বাড়িতে তাঁর স্ত্রীর নামে পাওয়া যায় ১১টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পাসবই। দফায় দফায় এ সংস্থাগুলো থেকে ঋণ নিয়েছিলেন আকবর শাহ।

মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান বলেন, ‘বাড়িতে ১১টা পাসবই পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬-৭টি বইয়ে ঋণ ছিল। সপ্তাহে ৫ হাজার টাকা কিস্তি লাগত। কিস্তি দিতে না পারার কারণে মানসিক চাপে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে আমাদের ধারণা।’

টাকা আদায়ে কঠিন চাপ

রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলামের ঋণ আছে। তিনি বলেন, ‘ঋণ আমি নিয়মিতই পরিশোধ করি। কিন্তু এক দিন যদি দেরি হয়, এনজিওর লোকেরা এসে বসে থাকেন। টাকা না নিয়ে ওঠেন না।’

স্ত্রী-সন্তানদের হত্যার পর আত্মহত্যা করা মিনারুলের চাচি জানেহার বেগম বলেন, ‘মিনারুল কিস্তির চাপে ঠিকমতো বাড়িতেই থাকতে পারত না। কিস্তির লোকেরা বাড়ি আসত, আমরা বুঝিয়ে পাঠাতাম যে, “বাবা, এখন তো মিনারুল বাড়িত নাই, পরে আইসো।” কিন্তু তারা ঘুরেফিরে আসত। রাত ৮টা বেজে গেলেও বাড়ির পাশে বসে থাকত।’

প্রয়োজন মনিটরিং

রাজশাহীর মানবাধিকার সংগঠন ‘বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রচেষ্টা’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ফয়েজুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘এনজিওগুলো সুদের হার ১৪ শতাংশ বলে প্রচার করলেও বাস্তবে তা দাঁড়ায় প্রায় ৩০ শতাংশে। এটা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা। একাধিক এনজিওতে এই উচ্চ সুদে ঋণ থাকলে মানুষ শোধ করতে পারে না। এ বিষয়ে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি মনিটরিং বাড়াতে হবে।’

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াকুব হোসেন বলেন, ‘একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে গেলে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, সেটা একক কোনো এনজিও দেয় না। ফলে মানুষ একাধিক এনজিও থেকে ঋণ নেন। সেটা সঠিকভাবে বিনিয়োগ হলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়, কিন্তু যখন ঋণের টাকার অপব্যবহার হয়, তখনই সেটা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা এনজিওগুলোকে পরামর্শ দিয়ে থাকি, যেন তারা যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেয় এবং টাকাটা সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়েছে কি না, তা দেখে। নিয়মিত পরিদর্শনের সময়ও আমরা এটা দেখে থাকি।’

ইয়াকুব হোসেন আরও বলেন, ‘অনেকের একাধিক এনজিওতে ঋণ থাকে। এটা কমিয়ে আনতে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। আগামী এক বছরের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে অনলাইনে সার্চ করলেই যেকোনো ব্যক্তির এনজিওর ঋণের অবস্থা জানা যাবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত