Ajker Patrika

জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেল ফুলবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী লাল চিনি

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় আখের রস চুলায় জ্বালিয়ে হাতে তৈরি লাল চিনি। ছবি: সংগৃহীত
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় আখের রস চুলায় জ্বালিয়ে হাতে তৈরি লাল চিনি। ছবি: সংগৃহীত

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় আখের রস থেকে হাতে তৈরি লাল চিনি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। আড়াই শ বছরের ঐতিহ্যবাহী মিহি দানার এ চিনি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় আনন্দে ভাসছে এ পেশার সঙ্গে জড়িত মানুষ ও কৃষি বিভাগ।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে ফুলবাড়িয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘ওয়েবসাইট চেক করে আজ আমরা জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০২৪ সালের ১১ জুলাই ফুলবাড়িয়ার লাল চিনির জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করা হয়েছিল।’

জানা গেছে, এ চিনি কেবল আখের রস থেকে তৈরি হয়, যা স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। কোনো ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে চুলায় রস জ্বালিয়ে এ চিনির পাউডার তৈরি করা হয়। এর অনেক কদর রয়েছে। উপজেলাটিতে প্রতিবছর শতকোটি টাকার লাল চিনি বিক্রি হয় বলে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে। উপজেলার বাকতা, কালাদহ ও রাধাকানাই ইউনিয়নের প্রায় ২০টি গ্রামের কিষান-কিষানিরা আখ উৎপাদন ও চিনি তৈরির কাজ করেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘ফুলবাড়িয়ার লাল চিনির বিষয়ে গত ২৭ মে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর থেকে জার্নালে প্রকাশ করা হয়। আর কোনো পক্ষের দাবি আছে কি না, সে জন্য জার্নালটি প্রকাশ করা হলেও কারও দাবি না থাকায় সব প্রক্রিয়া শেষে আমরা স্বীকৃতি পেয়েছি। সনদের জন্য আজ সরকার নির্ধারিত ফি জমা দিয়েছি।’

নূর মোহাম্মদ আরও বলেন, জিআই স্বীকৃতির মাধ্যমে অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসবে। আগে যাঁরা লাল চিনি সম্পর্কে জানতেন না, তাঁরাও এখন জানতে পারবেন। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় কৃষকেরাও এটির উৎপাদন বাড়াতে আগ্রহী হবেন এবং সরকারেরও পৃষ্ঠপোষকতা বাড়বে। অর্গানিক পণ্য হিসেবে দেশের বাইরে রপ্তানি করা গেলে চাষিদের জন্য অন্য রকম সুযোগ তৈরি হবে।

স্থানীয় কৃষক আবুল কালাম ও হাফিজ উদ্দিন জানান, লাল চিনি তৈরির একমাত্র কাঁচামাল হলো আখ। আখের রস আগুনে জ্বাল দিয়ে লাল চিনি তৈরি করা হয়। আখমাড়াইয়ের আগে চাষিরা লাল চিনি তৈরির জন্য জ্বালঘর তৈরি করেন। লাল চিনি তৈরির জন্য প্রথমে আখ জমি থেকে সংগ্রহ করে তা পরিষ্কার করে যন্ত্রচালিত আখমাড়াই কলের সাহায্যে আখ থেকে রস বের করা হয়। চুলায় সাতটি লোহার কড়াই বসানো হয়। তারপর প্রথম কড়াইয়ে পরিমাণমতো কাঁচা রস দিয়ে জ্বাল দেওয়া শুরু করা হয়। জ্বাল দেওয়ার আধা ঘণ্টা পর প্রথম কড়াই থেকে দ্বিতীয় কড়াইয়ে, তারপর তৃতীয় কড়াইয়ে এভাবে সপ্তম কড়াইয়ে জ্বাল দেওয়া রস ঘন হলে চুলা থেকে নামিয়ে কাঠের তৈরি মুগুর দিয়ে বারবার ঘর্ষণ করে অদানাদার বাদামি রঙের লাল চিনি তৈরি করা হয়।

আবুল কালাম ও হাফিজ উদ্দিন আরও জানান, যতক্ষণ না পাকা রস শুকনো ধুলার মতো আকার ধারণ করে, ততক্ষণ পর্যন্ত ঘোঁটা হয়। আখের গুণগত মান খারাপ হলে ধুলার মতো না হয়ে গুটি গুটি আকার ধারণ করে। ধুলার মতো বা গুটির মতো যা-ই হোক, ফুলবাড়িয়ার ভাষায় এটিই হলো ঐতিহ্যবাহী লাল চিনি। দেখতে ধূসর বাদামি বা হালকা খয়েরি হলেও সাদা চিনির বিপরীতেই হয়তো ‘লাল চিনি’ নামকরণ করা হয়। চিনি হওয়ার পর তা রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। জমিতে আখগুলো চৈত্র মাসে লাগানো হয়। আখমাড়াই শুরু হয় পৌষ মাসের শুরু থেকে। দীর্ঘ এক বছরে একটি ফসল হয়। আড়াই মাস সময়ের মধ্যে এ চিনি তৈরি হয়।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এই উপজেলা একটি বৈচিত্র্যময় উপজেলা। এখানে প্রধান ফসল ধানের পাশাপাশি আখসহ অন্যান্য ফসলও হয়। আখ থেকে বিশেষ একধরনের পণ্য তৈরি হয়, যাকে বলা হয় লাল চিনি। ২০২৫ সালে ৬৫০ হেক্টর জমিতে আখ হয়। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ জমিতে দেশি জাতের আখের আবাদ হয়। অন্য জমিতে ঈশ্বরদী-৪১ ও ঈশ্বরদী-৪২ জাতের আখ হয়। এক হেক্টর জমি থেকে প্রায় ৮ টন লাল চিনি উৎপাদন হয়। লাল চিনি গড়ে ৮ হাজার টাকা মণ বিক্রি হয়। এ বছর প্রায় ১০৮ কোটি টাকা লাল চিনি বিক্রি করে আয় করেন কৃষকেরা। এক টন আখ থেকে প্রায় ৩২ হাজার লিটার রস হয়। চার কেজি রস থেকে এক কেজি লাল চিনি বের হয়।

রাধাকানাই ইউনিয়নের পলাশতলী গ্রামের আব্দুস সবুর বলেন, ‘আমরা বাপ-দাদার আমল থেকে লাল চিনি বানাই। কোনো ধরনের কেমিক্যাল দিই না। আখের জমিতে আখ ছাড়া অন্য কোনো ফসল উৎপাদন হয় না। লাল চিনি তৈরির পর ব্যাপারীরা বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে কিনে নেন। লাল চিনি জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার খবরে আমরা খুশি।’

লাল চিনির স্থানীয় পাইকারি ক্রেতা মো. আবদুল মজিদ বলেন, ‘জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় চিনির চাহিদা আরও বাড়বে। আমাদের ব্যবসার বিস্তৃতি ঘটবে বলে আশা করছি।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, ‘লাল চিনির জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেতে অনেক মানুষের শ্রম ও মেধা জড়িয়ে রয়েছে। এটি আমাদের ময়মনসিংহ অঞ্চলের অনন্য প্রাপ্তি বা স্বীকৃতি। লাল চিনির জিআই পণ্যের স্বীকৃতি প্রাপ্তিতে যাঁরা নেপথ্যে থেকে কাজ করেছেন, প্রত্যেকের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন।’

ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফুর ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘লাল চিনির জিআই স্বীকৃতির বিষয়টি আজ আমরা নিশ্চিত হয়ে সনদের জন্য টাকা জমা দিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছি। এ স্বীকৃতিতে এই অঞ্চলের মানুষ উচ্ছ্বসিত।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত