Ajker Patrika

১৫ বছরে ক্র্যাক আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্প

মিলন উল্লাহ, কুষ্টিয়া
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২১, ২০: ৫৭
১৫ বছরে ক্র্যাক আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্প

কুষ্টিয়ার রহিমপুরে ঢাকা-কুষ্টিয়া মহাসড়কের পাশে স্মরণ মৎস্য হ্যাচারিতে হয়ে গেল ক্র্যাক আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্প। এটি এই আয়োজনের ১৫তম আসর। প্রতিবছর ২৫-৩০ ডিসেম্বর বসে এ আয়োজন।

তৈরি হচ্ছে শিল্পকর্ম২৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই আর্ট ক্যাম্পটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ৩০ ডিসেম্বর বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭ পর্যন্ত। 

ইনস্টলেশন, পারফর্মিং আর্টসহ বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে দেশ ও বিদেশের শিল্পীরা একটি নির্দিষ্ট থিমকে কেন্দ্র করে এ আর্ট ক্যাম্পে তাঁদের শিল্পকর্ম তৈরি করেন। এবারের থিম ছিল ‘নৈঃশব্দ্যের গান’ বা দ্য সংস অব সাইলেন্স। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক সুরেশ কে নায়ার এবং শিল্পী শাওন আকন্দ এবারের আর্টক্যাম্পের কিউরেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

আর্ট ক্যাম্পের একটি ইনস্টলেশন আর্টকরোনা অতিমারির জন্য এবারের আসর কিছুটা সীমিত করা হয়। ১৫তম এ আসরে দেশ ও বিদেশের মাত্র ১৫ জন শিল্পী সরাসরি অংশ নেন। তবে ইচ্ছুক শিল্পীদের জন্য এবারের আয়োজনে ছিল ভার্চুয়াল অংশগ্রহণের সুযোগ। এবারের ক্যাম্পে সরাসরি ও অনলাইনে অংশগ্রহণকারী মিলে শিল্পী সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ জন।

২০০৭ সাল থেকে এই মাল্টিডিসিপ্লিনারি আর্ট ক্যাম্পটি নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়ায় এই আর্ট ক্যাম্পটির সূচনা হয়েছিল চারুশিল্পী, লেখক, কবিসহ বিভিন্ন মাধ্যমের মানুষদের উদ্যোগে, শিল্পী ও গবেষক শাওন আকন্দের নেতৃত্বে এবং শিল্পী দেলোয়ার হোসেনের সার্বিক সহযোগিতায়। এই ক্যাম্পে অংশ নেওয়া শিল্পীরা প্রধানত সাইট-স্পেসিফিক ও কন্সেপচুয়াল আর্টওয়ার্ক নিয়ে কাজ করেন। শিল্প নির্মাণ উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় স্থানীয় বিবিধ উপাদান ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশে পাওয়া বিভিন্ন সামগ্রী। স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে সমন্বিতভাবে শিল্প চর্চার ধারাকে সামনে এগিয়ে নিতে কাজ করেন অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা। অনুষ্ঠানে শিল্পীরা কুষ্টিয়া অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও অঙ্গনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ঘুরে দেখেন এবং স্থানীয় বিভিন্ন শিল্প উপকরণ সংগ্রহ করেন তাঁদের শিল্পকর্মের জন্য। করোনা অতিমারির কারণে গত বছর স্থগিত রাখার পর এ বছর আবারও এই ক্যাম্প আয়োজন করা হয়। 

একটি ইনস্টলেশন আর্টআর্ট ক্যাম্পে অংশ নেওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী তামান্না লীজা এবার প্রথমবারের মতো এসেছেন এই আর্ট ক্যাম্পে। তামান্না বলেন, ‘আমাদের এবারের থিমকে সামনে রেখে একটি নৌকাকে বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে একটি প্রজাপতির অবয়ব তৈরির চেষ্টা করা করছি। এখানে প্রজাপতি আমার নিজের জীবনের যে নীরবতা বা নৈঃশব্দ্য আছে তার প্রতীক। এ ধরনের ক্যাম্পে এই প্রথমবারের মতো আসলেও খুবই ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে।’

ট্রু ফ্রেন্ড নাম দিয়ে ‘সাইলেন্স’ থিমের ওপর কাজ করছেন সুমন্ত মোহন্ত নামের আরেক অংশগ্রহণকারী। তিনি  জানান, ‘আমাদের অনেক বন্ধু আছে যাদের সঙ্গে আমরা মতবিনিময় করি। কিন্তু অনেক সময় সবার কথা বুঝতে পাড়লেও আমার কথা অনেকে বুঝতে পারছেন না। তাই আমার না বলা কথা হয় মনের মাঝে লুকিয়ে রাখি, না হলে প্রকৃতির মাঝে ছেড়ে দিই। আমার সেই কথাগুলোই আমি নৌকা বানিয়ে প্রকৃতির মাঝে ছেড়ে দিয়ে মজা পাচ্ছি।’

আর্টক্যাম্প দেখতে আসা কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার স্কুলশিক্ষক মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘আমি এখানে প্রায় ৫ বছর যাবৎ আসি। ক্র্যাক তাদের দীর্ঘ এক যুগের বেশি চর্চায় এটি প্রমাণ করতে সফল হয়েছে যে, বাংলাদেশের চারুশিল্প চর্চার চর্চার নিজস্ব পথ আছে। সেই পথ কেবল প্রাতিষ্ঠানিকতায় বিকশিত নয় বরং জনপদের ইতিহাসের সঙ্গে এর রয়েছে গভীর যোগাযোগ। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শিল্পচর্চার ধারাবাহিক ইতিহাসে অনেকগুলো বাঁক আছে। প্রতিটি বাঁক এক একটি সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে। এক এক ধরনের উত্তরণের কথা বলে। ১৫ বছরের সফল প্রচেষ্টার পর ক্র্যাক আন্তর্জাতিক আর্ট ক্যাম্পকে সেই ধারাবাহিক ইতিহাসের অংশ বলা যায়।’

দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত প্রদর্শনীতে পারফর্মিং আর্টক্র্যাক আর্ট ক্যাম্পের আয়োজক শাওন আকন্দ ‘আজকের পত্রিকা’কে জানান, কুষ্টিয়া অঞ্চলের চারুকলার ইতিহাস বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ১৯৭০ দশকের শিল্পী দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর। সে সময় দেলোয়ার হোসেন শিল্পচর্চা ছেড়ে নিজের খামারে কৃষিকাজে মনোযোগী ছিলেন। কুষ্টিয়ার রহিমপুরে স্মরণ মৎস্য বীজ খামারের বিস্তীর্ণ জায়গাকে কাজে লাগিয়ে একটি আর্ট ক্যাম্প করার প্রস্তাব দিলে দেলোয়ার হোসেন তাতে সম্মত হন। 
 
শাওন আকন্দ বলেন, ‘প্রথম থেকে এই আর্ট ক্যাম্প পরিচালনার ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হয় বাউল সম্প্রদায়ের স্বতঃস্ফূর্ত ধারায় গড়ে ওঠা সাধুসঙ্গের ধারণাকে। সেই থেকে নিয়মিত ভাবে এই আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। কিন্তু করোনা অতিমারির কারণে আমরা গত বছর এই ক্যাম্পের আয়োজন করতে পারিনি, সেটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেত বলে। তাই এ বছর আমরা অনলাইন ও সরাসরি দুই ভাবেই ক্যাম্প করার উদ্যোগ নিয়েছি। সরাসরি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ১৫ জন শিল্পী এখানে অংশ নিলেও অনলাইনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫০ জন শিল্পী এই ক্যাম্পে অংশ নিয়েছেন।’

শাওন আকন্দ আরও বলেন, ‘বেশ কিছু বন্ধু ও স্বজনকে এই করোনাকালে হারিয়েছি আমরা। তাঁদের কথা স্মরণ ও বিবেচনা করে এবং আমাদের বাংলায় সহজিয় তরিকায় নৈঃশব্দ্যকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই নৈঃশব্দ্যকে আমরা দেখানোর চেষ্টা করেছি। আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে এভাবেই আমরা স্মরণ করছি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত